'অটিস্টিক সন্তান মানেই সবার জন্য একটি অবহেলার পাত্র, আদতে কিন্তু এটি সম্পূর্ণ ভুল। তারাও কিন্তু আমাদের সমাজেরই একজন', মোবাইল ফোনে লন্ডন থেকে যুক্ত হয়ে কথাগুলো বলছিলেন সাজমুন নাহার।
গল্পটা একদম শুরু থেকেই শুরু করা যাক। অটিজমের শিশু যেন নিজেই মগ্ন থাকে। অপার বিস্ময়ে ভরা তাদের এক জগৎ। সে জগৎকে যেন ছোঁয়ার ইচ্ছা। কখনও ধরা দেয়, কখনও দেয় না। তারা তাদের মতোই। কখনও হাসি, কখনও কান্না, ওদের নিয়েই থাকে। একি কোনো অভিমানের চিহ্ন? তবে অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের কথা বলতে গিয়ে তাদের মা-বাবার কথা যেন ভুলে না যাই। অপরিসীম ত্যাগ আর কষ্ট স্বীকার করা এসব বাবা-মায়েরই একজনের গল্প এটি।
সাজমুন নাহার এবং লুৎফর রহমান দম্পতি। নিজেদের কর্মসূত্রে বসবাস করছেন যুক্তরাজ্যের লন্ডন শহরে। একজন পেশাদার অনুষ্ঠান আয়োজক লুৎফর। আজ থেকে ১০ বছর পূর্বে লুৎফর-সাজমুন দম্পতির কোল আলো করে জন্ম নেয় তাদের যমজ সন্তান সানিয়া ও সানিকা। তবে পরে জানা যায় এরমধ্যে সানিয়া অটিস্টিক। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের সমাজের অধিকাংশ পরিবারের মতে অটিজম শিশুর অর্থ নিজেদের 'বোঝা'। লুৎফর-সাজমুন দম্পতিও এটি ভাবতে পারতেন, তবে তারা ভাবেননি। তারা যেন সন্তুষ্ট সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত সন্তানকে নিয়েই। তবে নিজেদের ব্যস্ত জীবনের মাঝেই যেন উঁকি দিচ্ছিল সমাজের অটিস্টিক শিশুদের নিয়ে তৈরি হওয়া 'অবহেলা' শব্দটি নিয়ে।
আসলেই কি তারা অবহেলার পাত্র? নতুন গল্পের শুরুটা এখান থেকেই। খোঁজ নেন কেন তাদের অবহেলা করা হচ্ছে! সমাধান হিসেবে খুঁজে পেলেন- অধিকাংশ অটিস্টিক শিশুর পরিবারের যেন খানিকটা বেগ পেতে হয় সন্তানদের চাহিদা বুঝতে কিংবা নানান কারণে, বিপরীতে অবশ্য লুৎফর-সাজমুন দম্পতির ক্ষেত্রে তেমনটি হয়নি। সেই থেকেই চিন্তা করলেন নিজের সন্তানকে যত্ন করার ভিডিও অনলাইনে দিয়ে অন্যান্য অটিজম শিশুর পরিবারের জন্য সহায়ক হিসেবে ভূমিকা রাখবেন।
চিন্তার সঙ্গে মিলিয়ে বাস্তবায়নে খুব একটা বেশি সময় নেননি। শুরু করলেন মেয়ের নামে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ভিত্তিক চ্যানেল সানিয়া রহমান ভ্লগ। যেখানে দেওয়া শুরু করেন নিজেদের শিশুর নানান ভিডিও, প্রতিদিনের চিত্র। লক্ষ্যটা খুবই সাধারণ, যেন বাংলাদেশি মা-বাবারা নিজেদের অটিস্টিক সন্তানদের নানান বিষয়ে জানতে পারেন। যেখানের প্রতিটি ভিডিওতে ফুটে উঠছে সানিয়ার প্রতিদিনের গল্পের চিত্র এবং মা-বাবার কর্তব্য। ব্যতিক্রমী এই উদ্যোগ সাড়া জাগাতেও খুব একটা সময় নেয়নি। অল্প সময়ের মধ্যেই ১ লক্ষেরো অধিক মানুষ যুক্ত হয় তাদের এই পথচলায়। প্রতিটি ভিডিও ছড়িয়ে যাচ্ছে লাখো মানুষের মাঝে।
এর পাশাপাশি ১৫ হাজার অটিস্টিক শিশুর অভিভাবক নিয়ে রয়েছে তাদের আরও একটি সোশ্যাল মিডিয়া চ্যানেল। যেখানে অটিজম আক্রান্ত শিশুদের অভিভাবকদের জন্য নিয়মিত আয়োজন হচ্ছে অনলাইন লাইভ সেশনের, যেখানে অস্টিটিক শিশুর প্রতি কর্তব্য, যত্ন নিয়ে আলোচনা করতে হাজির হচ্ছেন বাংলাদেশের নানান বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিত্ব, অন্যান্য অটিজম আক্রান্ত শিশুদের জীবনযাত্রার গল্প ভাগাভাগি করতে হাজির হচ্ছে তাদের অভিভাবকরাও।
আয়োজিত হচ্ছে অটিজম বিষয় বিশেষ সেমিনারেরও। নিয়মিত বাংলাদেশের অনেক অভিভাবক তাদের অটিস্টিক সন্তানদের নিয়ে তাদের কাছে নানান প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে আসছেন, মিলছে উত্তরও! গরীব অসহায় পরিবারে জন্মগ্রহণ করা অটিজম সন্তানরা সু-চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রেখে দেশ এবং বিভিন্ন দেশের উচ্চ পদ মযার্দা সম্পন্ন ডাক্তার দ্বারা বিনামূল্যে থেরাপিসহ অন-লাইনের মাধ্যমে আলোচনা করে অভিভাবকদের সচেতনতার জন্যও কাজ করে আসছে।
শুধু অনলাইনেই সীমাবদ্ধ নয় তাদের কার্যক্রম। আছে অফলাইন জগতজুড়েও। দেশের বন্যাকবলিত প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে যে সকল অটিজম স্কুল রয়েছে সেগুলোতে বিনামূল্যে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাসহ গরীব অসহায় অটিজম শিশুদের পাশে দাড়িয়ে সার্বিক সহযোগিতা করে আসছে এই দম্পতি। প্রতি ঈদ কিংবা নানান সময়ে হাজারো শিশুর কাছে পোঁছে দেওয়া হচ্ছে প্রয়োজনীয় সামগ্রী। অটিজমের বাইরেও নানান দূর্যোগে সহায়তা দিয়ে এসেছেন শতাধিক পরিবারকে।
কেমন সাড়া পাচ্ছেন? উত্তরটা শুনুন লুৎফরের মুখ থেকেই, 'আসলে শুরুর দিকে চিন্তায় আসেনি মানুষ এতটা ভালোভাবে গ্রহণ করবে। বেশ ভালো সাড়া পেয়েছি এবং পাচ্ছি। আমাদের সাথে সারাদেশের লক্ষাধিক মানুষ আছে। সবার ভালোবাসা আমাদের প্রতিনিয়ত অবাক করছে'।
বর্তমানে সানিয়ার বয়স ১০ বছর। পড়াশোনার অংশ হিসেবে নিয়মিত যাচ্ছেন লন্ডনের জন এফ কেনেডি নামের একটি বিশেষ বিদ্যালয়ে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ক্লাস ৭ এ প্রবেশ করবে।
লুৎফর আরো জানান, 'সানিয়ার কমিউনিকেশন অনেক উন্নতি হয়েছে এবং সে অনেক কিছু বুঝতে পারে এবং আমাদের বোঝাতে পারে। দেশের অন্যান্য পরিবারের প্রতি লুৎফরের বক্তব্য- অটিস্টিক শিশুরাও সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। তাদের সবার মাঝে নিয়ে এসে সুন্দরভাবে বাঁচতে দেওয়া উচিত।
আগামীর পরিকল্পনা কী? লুৎফর যোগ করলেন বাংলাদেশের সমাজে অটিস্টিক শিশু নিয়ে বর্তমান অবস্থা সবার মাঝে তুলে ধরে কীভাবে বিষয়টি নিয়ে আরও ভালোভাবে কাজ করা যায়- সে লক্ষ্যে ছুটে চলা। গরিব অটিজম সন্তানরা বিনামূল্যে প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জন করতে পারে, কাজ চলছে সেটি বাস্তবায়নে। লুৎফর-সাজমুন দম্পতি ছুটছেন নিজেদের গন্তব্যে; কিন্তু একা নয়, ছুটতে চান দেশের লাখো অটিস্টিক শিশুর পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে