জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘সংকল্প’ কবিতায় লিখিয়াছেন, ‘আমার সীমার বাঁধন টুটে/ দশদিকেতে পড়ব লুটে:/ পাতাল ফেড়ে নামব নীচে, উঠব আবার আকাশ ফুঁড়ে:/ বিশ্ব-জগৎ দেখব আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে।’ বাংলাদেশের দুর্বার তরুণরা অনেক ক্ষেত্রে কাজী নজরুল ইসলামের সেই সংকল্পকে বাস্তবে রূপ দিয়া চলিয়াছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাহারা বিশ্ব জয় করিতেছে এবং দেশমাতৃকার নাম ও গৌরবকে সমগ্র বিশ্বে ছড়াইয়া দিতেছে। তাহাদের এই অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশের মানুষের মুখ উজ্জ্বল হইতেছে।
বিদেশে লাল-সবুজের পতাকা উড্ডয়নের মাধ্যমে এই তরুণরা প্রমাণ করিতেছে—এই দেশ আর দুর্ভিক্ষ, খরা ও দুর্যোগের দেশ নহে, অনেক সম্ভাবনাময় একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ। গত ২৭ জুলাই সাইবেরিয়ার বেলগ্রেডে অনুষ্ঠিত হইল ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটিজ ডিবেটিং চ্যাম্পিয়নশিপের (ডব্লিউইউডিসি)-২০২২-এর ওপেন ফাইনাল। সুখবর হইল, ইহাতে চ্যাম্পিয়ন হইয়াছে বাংলাদেশের ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই তরুণ বিতার্কিক। তাহারা প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি, ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর ও অ্যাতেনিউ ডি ম্যানিলা ইউনিভার্সিটিকে হারাইয়া বিতর্কের এই বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হইয়াছে। তাহারা ক্যামব্রিজ ইউনিয়ন আয়োজিত বিতর্ক টুর্নামেন্টেও চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জন করে। এই সকল কৃতিত্বের জন্য আমরা তাহাদের অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানাই।
আমরা প্রায়শ পত্রপত্রিকায় আমাদের তরুণদের নানা ক্ষেত্রে বিশ্বজয়ের খবর পাই। সংগত কারণে আমরা এই সকল খবরে আহ্লাদিত ও উচ্ছ্বসিত হই। গণিত অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সাফল্য অর্জনের কথা আমরা অনেকেই জানি। বিভিন্ন প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনেও তাহারা কৃতিত্বের পরিচয় প্রদান করিতেছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে ইউনিভার্সিটি রোভার চ্যালেঞ্জ আন্তর্জাতিক রোবটিক প্রতিযোগিতায় বিশ্বের সেরা দশে জায়গা করিয়া লইয়াছে ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশের (আইইউবি) ১১ তরুণ। তাহারা নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রযুক্তি উদ্ভাবকদের তাক লাগাইয়া দিয়াছে। বাংলাদেশে শিক্ষার বেসরকারিকরণ যে ফলদায়ক হইয়াছে, তাহা এই দুইটি ঘটনা হইতে প্রমাণিত হয়। বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাহাদের সাফল্যের পরিচয় প্রদান করিতেছে। সম্প্রতি ফেসবুক গ্লোবাল ডিজিটাল আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশি তরুণদের একটি টিম চ্যাম্পিয়ন হইয়াছে। এইরূপ বহু দৃষ্টান্ত তুলিয়া ধরা যায় এবং তরুণদের এই সকল সাফল্য আগামীর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্নকে জাগ্রত করিয়া তুলিতেছে।
এদিকে ক্রিকেটসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক খেলাধুলায় বাংলাদেশি তরুণরা তাহাদের সাফল্য অব্যাহত রাখিয়াছেন। শুধু তরুণরাই নহে, বয়স্ক ব্যক্তিরাও নানাভাবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাফল্যের পরিচয় দিতেছেন। যাহারা প্রবাসে আছেন তাহারা এবং তাহাদের সন্তানরাও নানাভাবে বাংলাদেশকে তুলিয়া ধরিতেছেন বহির্বিশ্বে। সম্প্রতি বহুল আলোচিত নাসার জেমস ওয়েব সিরিজে অংশগ্রহণকারী টিমে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নারী লামীয়ার অবদানের কথাও আমরা জানিতে পারিয়াছি। নাসার বিজ্ঞানী ড. আতিক উজ জামান, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামার উপদেষ্টা বিজ্ঞানী ড. এন নীনা আহমদ, সৌদি আরবের সেরা বিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ রেজাউল করিম, মার্কিন সেরা সংবাদ প্রযোজক তাসমিন মাহফুজ, কৃত্রিম কিডনি আবিষ্কারক বিজ্ঞানী ড. এস রায়, গোল্ডম্যান স্যাকসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নওশাদ শাহ, অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় বিজ্ঞান সংস্থার প্রধান বিজ্ঞানী ড. আবেদ চৌধুরী, গুগলের টেকনিক্যাল প্রোডাক্ট ম্যানেজার ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ শিশির খান, বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী বিজ্ঞানী ড. সাইদুর রহমান প্রমুখ ব্যক্তির সঙ্গে জড়াইয়া রহিয়াছে বাংলাদেশের নাম। তাহারা আমাদের তরুণদের জন্য আদর্শস্বরূপ।
এই সকল সফলতার কাহিনি পড়িয়া আমরা আনন্দে আপ্লুত এবং দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হই; কিন্তু প্রশ্ন হইল, এই সকল মেধাবীকে কি আমরা ধরিয়া রাখিতে পারিব? যাহারা প্রবাসে ভালো করিতেছেন তাহাদের কি দেশের উন্নয়নের জন্য ফিরাইয়া আনিতে পারিব? ভারতসহ বিভিন্ন দেশ উদ্যোগ লইলেও আমরা কি কোনো উদ্যোগ লইয়াছি? যাহারা মেধাবী তাহারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিদেশে চলিয়া যাইতেছে এবং আর ফিরিয়া আসিতেছে না। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির ইহা এক নির্মম বাস্তবতা। এই সকল দেশে চাকুরিবাকরি পাইতে মামার জোর লাগে, মেধা বিকাশে রহিয়াছে নানা প্রতিবন্ধকতা, সমান সুযোগ ও সুস্থ প্রতিযোগিতার পরিবেশ নাই বলিলেই চলে। কাঙ্ক্ষিত সুযোগ-সুবিধা ও মূল্যায়নের অভাবও বিদ্যমান। এই সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করিতে পারিলে আমাদের তরুণ মেধাবীরা নূতন নূতন উদ্ভাবনী শক্তির মাধ্যমে বিশ্বে আরো কার্যকরভাবে নেতৃত্ব প্রদানে সক্ষম হইবে নিশ্চয়ই।