জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়ার মৃত্যুর শোক কাটতে না কাটতেই ওই আসনে জমে উঠেছে নির্বাচনী প্রচারণা। কে হবেন নৌকার মাঝি, তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক এখন সরগরম। পাশাপাশি স্থানীয় হাট-বাজার ও মোড়ের চায়ের স্টল থেকে শুরু করে সর্বত্র চলছে এই জল্পনা-কল্পনা। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এ আসনে বিগত এগারটি নির্বাচনে পাঁচবার জাতীয় পার্টি, চারবার আওয়ামী লীগ ও দুইবার বিএনপি জয়ী হয়। তাই উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মনোনয়নে ভুল করলে আসনটি জাপার (এরশাদ) হাতে চলে যেতে পারে।
এদিকে গত ২৪ জুলাই তার গাইবান্ধা-৫ (ফুলছড়ি-সাঘাটা) আসনটি শুন্য ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু এখনো তফসিল ঘোষণা হয়নি।
জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৭৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত জাতীয় সংসদের মোট এগারটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে পাঁচবার জাতীয় পার্টি, চারবার আওয়ামী লীগ ও দুইবার বিএনপি জয়ী হয়। এর মধ্যে ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগের ওয়ালিউর রহমান ও ১৯৭৯ সালে বিএনপির রোস্তম আলী মোল্লা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরপর ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত জাতীয় পার্টির টিকিটে পরপর চারবার (১৯৮৬, ১৯৮৮, ১৯৯১ ও ১৯৯৬ (১২ জুন) মরহুম ফজলে রাব্বী মিয়া সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এছাড়া ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে বিএনপির মতিউর রহমান (পরে তিনি মারা যান) সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
পরে দল বদল করে ফজলে রাব্বী মিয়া ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিটে প্রথমবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এই নির্বাচনে দল বদলানো ফজলে রাব্বী হেরে যান। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন জাতীয় পার্টির রওশন এরশাদ। এরপর দীর্ঘ ৪৫ বছর পর ২০০৮ সালে ফজলে রাব্বী মিয়া আসনটি আওয়ামী লীগকে উপহার দেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালের একাদশ নির্বাচনেও তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
আসন্ন উপ-নির্বাচনকে ঘিরে এ আসনে আওয়ামী লীগের তিনজন প্রার্থীর নাম শোনা যাচ্ছে। তারা হলেন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মাহমুদ হাসান রিপন, সদ্য প্রয়াত ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বীর মেয়ে ফারজানা রাব্বী বুবলী ও ফুলছড়ি উপজেলা আ’লীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জিএম সেলিম পারভেজ।
আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতারা জানান, দীর্ঘদিন ধরে ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দুইটি ধারায় বিভক্ত। একটি মরহুম ফজলে রাব্বী সমর্থিত; অপরটি মাহমুদ হাসান রিপন সমর্থিত। এ দ্বন্দ্ব এখনো বিদ্যমান।
রিপন সমর্থিত নেতারা দাবি করেন, ফজলে রাব্বী বেঁচে থাকতে প্রতিটি নির্বাচনে মাহমুদ হাসান রিপন দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিলেন। মনোনয়ন না পেয়েও তিনি নিজে সক্রিয় থেকে দলকে চাঙ্গা রেখেছেন।
মাহমুদ হাসান রিপন বলেন, তিনি ২০০৬ সালের ৪ এপ্রিল থেকে ২০১১ সালের ১১ জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন। এ সুবাদে দুই উপজেলার তরুণ ও যুব সমাজের মধ্যে তার যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। এছাড়া সাঘাটা ও ফুলছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের মুল নেতৃত্ব তার সঙ্গে কাজ করছে। তাদের সঙ্গে নিয়ে তিনি এলাকার উন্নয়ন করেছেন। তাই তিনি জনপ্রিয়তায় এগিয়ে আছেন। উপ-নির্বাচনে মনোনয়ন পেলে তিনি আসনটি পুন:উদ্ধার করতে পারবেন।
এদিকে বাবা ফজলে রাব্বীর অসুস্থতা ও গত ১৪ মার্চ অনুষ্ঠিত ফুলছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হওয়ার পর ফারজানা রাব্বী বুবলী রাজনীতিতে সক্রিয় হন। তিনি দলীয় মনোনয়ন চাইছেন। মরহুম বাবার সুখ্যাতি কাজে লাগিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন।
ফজলে রাব্বীর সমর্থকরা বলেন, সাতবার সংসদ সদস্য ও দুই দফায় ডেপুটি স্পিকার হিসেবে রাব্বী রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ এলাকার অনেক উন্নয়ন করেছেন। বাবার সফলতা মেয়েকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
ফারজানা রাব্বী বলেন, দলীয় মনোনয়ন পাবেন বলে তিনি শতভাগ আশাবাদী। নির্বাচিত হলে বাবার অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করবেন। বাবা যে সাঘাটা-ফুলছড়িকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন, যে মডেল টাউন করবেন, সেই স্বপ্ন পূরণ করতে তাঁর এখানে আসা।
অপরদিকে মাহমুদ হাসানের ঘনিষ্টজন ছিলেন জিএম সেলিম পারভেজ। তার খ্যাতি কাজে লাগিয়ে সেলিম পারভেজ উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। বিগত জাতীয় নির্বাচনের আগে তিনি মাহমুদ হাসান রিপনকে দলীয় মনোনয়ন দিতে আন্দোলন করেছেন। গণমাধ্যমে সাক্ষাতকারও দিয়েছেন। যে সাক্ষাতকার বর্তমানে ফেসবুকে ভাইরাল হচ্ছে। আসন্ন উপ-নির্বাচনে সেলিম পারভেজ দলীয় মনোনয়ন চাইবেন বলে শোনা যাচ্ছে।
সেলিম পারভেজ জানান, চেয়ারম্যান হয়ে তিনি অনেক উন্নয়ন করেছেন। সংসদ সদস্য হলে এই উন্নয়ন করার পথ আরও সুগম হবে। তাই মনোনয়ন চাইবেন। তৃণমূলের মতামতের ভিত্তিতে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হলে তিনি আশাবাদী।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এখানে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মনোনয়নে ভুল করলে আসনটি জাপার (এরশাদ) হাতে চলে যেতে পারে। কারণ উপ-নির্বাচনে সাঘাটা উপজেলা জাপার সভাপতি ও পরপর দুইবার নির্বাচিত সাঘাটা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বিশিষ্ট আইনজীবী গোলাম শহীদ রঞ্জু প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
জাপা নেতারা মনে করেন, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনকালে এলাকায় গোলাম শহীদ রঞ্জুর প্রভাব বেড়েছে। এ সুনাম কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যেতে পারেন তিনি। জাপা নেতা গোলাম শহীদ রঞ্জু বলেন, আসনটি দীর্ঘদিন জাপার দখলে ছিল। জাপা এখনও এই আসনে সুসংগঠিত। তাই উপ-নির্বাচন সুষ্ঠু হলে এ আসনটি তিনি জাপাকে ফিরিয়ে দিতে পারবেন।