শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

পবিত্র আশুরা: অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের চেতনা

আপডেট : ০৯ আগস্ট ২০২২, ০৩:৫২

পৃথিবীতে সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্ব চিরন্তন। এই মহাসত্যকে পাশ কাটানো যায় না। অন্যায়, অসত্য ও জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াই করিতে গিয়া শেষ পর্যন্ত ইসলামের সোনালি যুগের মানুষদেরও নিদারুণ কষ্ট করিতে হইয়াছে, জানমালের কোরবানি দিতে হইয়াছে। সেই নির্মম বাস্তবতার অন্যতম সাক্ষী পবিত্র আশুরা (এখানে আশুরা অর্থ হইল দশম। অর্থাত্ মহরমের দশম দিন)। ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দ মোতাবেক ৬১ হিজরি সালের ১০ মহরম তারিখে ইরাকের কুফা নগরীর অদূরে ফোরাত নদীতীরবর্তী কারবালা প্রান্তরে উমাইয়া শাসক ইয়াজিদ বাহিনী কতৃ‌র্ক অবরুদ্ধ হইয়া ৭২ জন পরিবার-পরিজন ও সঙ্গী-সাথিসহ নির্মমভাবে শাহাদতবরণ করেন মহানবি হজরত মুহম্মদ (স.)-এর প্রিয় দৌহিত্র হজরত হোসাইন বিন আলি (রা.)। ইসলামের ইতিহাসে তাহাদেরকে বলা হয় শোহাদায়ে কারবালা। তাই এই দিনটি সারা বিশ্বের মুসলমানদের জন্য গভীর শোকের দিন।

আইয়্যামে জাহেলিয়ার যুগে আরবরা ছিল বর্বর ও অসভ্য এক জাতি। গোত্রতান্ত্রিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত, যুদ্ধবিগ্রহ ও নানা পাপাচার-অনাচার লাগিয়াই থাকিত আরব সমাজে। মহানবির (স.) মতো পরশপাথরের সংস্পর্শে আসিয়া সেই আরবরা সভ্য ও দিগ্বিজয়ী জাতিতে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু শেষ নবির (স.) ওফাতের পর ইসলামি সাম্রাজ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্য, রোম, পারস্যসহ বড় বড় শক্তির বিরুদ্ধে সংঘটিত বিভিন্ন যুদ্ধে ইসলামের বিজয়ের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, উমাইয়া-হাশেমি বংশের দ্বন্দ্বের নূতন রূপ, গোত্রতান্ত্রিকতা, হোদাইবিয়ার সন্ধি ও মক্কাবিজয়ের পর যাহারা ব্যাপকভাবে মুসলমান হইয়াছিলেন তাহাদের ইসলামি শিক্ষার অভাব, মুনাফিক ও ছদ্মবেশী ইহুদি সাবিয়িদের চক্রান্ত ইত্যাদির জের ধরিয়া সংঘটিত হয় কারবালার ঘটনা। ইহার আগে জঙ্গে জামাল ও সিফফিনের মতো ভয়াবহ ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এবং কারবালার ঘটনার মাধ্যমে ইসলামি খেলাফতের পতন ত্বরান্বিত হয় এবং সূচনা হয় রাজতন্ত্রের। পবিত্র মাস মহরমে সেই প্রাচীনকাল হইতেই যুদ্ধবিগ্রহ নিষিদ্ধ হইলেও প্রায় নিরস্ত্র আহলে বায়েত বা নবি (স.) পরিবারকে ষড়যন্ত্র ও শঠতার মাধ্যমে কুফায় ডাকিয়া আনিয়া পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়। এইভাবে চুক্তিভঙ্গকারী ইয়াজিদ অবৈধভাবে তাহার ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে।

কারবালার ঘটনা বিশ্ব ইতিহাসের এক কালো অধ্যায় নিঃসন্দেহে। নিষ্ঠুর ইয়াজিদ বাহিনী ও পাষণ্ড সীমারের দল নবির (স.) পরিবারের অসহায় নারী ও শিশুদের পানি পর্যন্ত পান করিতে দেয় নাই। ইহার পরও ইমাম হোসাইন অসত্য ও অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেন নাই। অসমযুদ্ধে অংশগ্রহণ করিয়া পরিবার-পরিজনসহ আত্মত্যাগের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্হাপন করিয়াছেন। এই জন্য পবিত্র আশুরার মূল চেতনাই হইল অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের সংগ্রাম। সেই সংগ্রামে সাময়িক আঘাত আসিলেও শেষ পর্যন্ত ন্যায় ও সত্যেরই চূড়ান্ত বিজয় অবধারিত। ইহাই ১০ মহরমের শিক্ষা। এই জন্য জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখিয়াছেন, ‘ফিরে এলো আজ মুহররম মাহিনা/ ত্যাগ চাই, মর্সিয়া-ক্রন্দন চাহি না’।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কারবালার নৃশংসতম ঘটনার আগে ১০ মহরম একপ্রকার শুকরিয়া দিবস হিসাবে পালিত হইত বিভিন্ন নবি-রসুলের জামানায়। কেননা এই দিনে বিভিন্ন সৃষ্টির সূচনা, হজরত আদম (আ.)-এর দোয়া কবুল, হজরত নূহ (আ.) এর মহাপ্লাবন হইতে মুক্তি, নমরুদের অগ্নিকুণ্ড হইতে হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর পরিত্রাণ, হজরত আইউব (আ.)-এর রোগ হইতে আরোগ্য লাভ, হজরত ইউনুসের (আ.) মাছের উদর হইতে মুক্তি, অত্যাচারী ফেরআউনের হাত হইতে হজরত মুসা (আ.)-এর কওমের নিষ্কৃতি ইত্যাদিসহ নানা ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটিয়াছে। তবে সর্বশেষ সংঘটিত কারবালার ঘটনাটি এতটাই মর্মন্তুদ যে, এই দিনটিকে তাহা নূতন মাত্রা দিয়াছে এবং শোকাচ্ছন্ন করিয়া তুলিয়াছে। এই দিন আমরা সারা বত্সরের গুনাহের কাফফারা হিসাবে নফল রোজা পালনসহ বিভিন্ন ইবাদত-বন্দিগি করিব এবং যে কোনো অনৈসলামিক কর্মকাণ্ড হইতে বিরত থাকিব। আল্লাহ মুসলমানদের ভ্রাতৃত্ববন্ধনকে সুদৃঢ় করুন ও ইসলামের পথে অবিচল থাকিবার তওফিক দিন। আমিন ।

ইত্তেফাক/এসজেড