করোনা-উত্তর বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রম শুরু হওয়ার লগ্নে আবারও বিশ্ব অর্থনীতিতে কালো মেঘের ছায়া নেমে এসেছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ভবিষ্যদ্বাণী করছে, বিশ্ব অর্থনীতি ভয়াবহ মন্দার দিকে ধাবিত হচ্ছে। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ইতিমধ্যেই মন্দাক্রান্ত হয়ে পড়েছে। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে দেশটি এখনো মন্দা ঘোষণা করেনি। মার্কিন অর্থনীতি পরপর দুই প্রান্তিকে সংকুচিত হলেই মন্দা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এ বছর মার্কিন অর্থনীতি ধারাবাহিকভাবে দুই প্রান্তিকে সংকুচিত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে জীবনযাত্রার ব্যয়কে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা। মূল্যস্ফীতির প্রতিকারহীন ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা কমানোর জন্য অধিকাংশ দেশই নীতি সুদের হার বাড়িয়ে দিয়েছে।
প্রচলিত অর্থনৈতিক ধারণা বা সূত্র মতে, নীতি সুদের হার বাড়িয়ে দিলে বাজারে মানি সাকুর্লেশন কমে যায়। ফলে এক পর্যায়ে মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসে; কিন্তু এবারের ঘটনা সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপ ধারণ করেছে। কোনো দেশেই নীতি সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। বরং অর্থনীতি সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থায় আগামীতে বিশ্বব্যাপী ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দা নিশ্চিত হয়ে উঠেছে। অধিকাংশ দেশেই মূল্যস্ফীতি সহনীয় মাত্রার অনেক ওপরে চলে গেছে। গত ৪০ বছরের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকগণ এতটা উচ্চ মূল্যস্ফীতি আর কখনোই প্রত্যক্ষ করেনি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর গড় মূল্যস্ফীতির হার ৮ শতাংশের ওপরে উঠে গেছে। আমদানিব্যয় মেটাতে গিয়ে অধিকাংশ দেশই তাদের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ আশঙ্কাজনভাবে কমিয়ে ফেলতে বাধ্য হচ্ছে। ভারত এ বছর রেকর্ড পরিমাণ বাণিজ্য ঘাটতির মুখে পতিত হয়েছে। জুন মাসে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ভারতের প্রতিকূলে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২৬ দশমিক ১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। জুলাইতে এসে তা ৩১ দশমিক শূন্য ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। বাণিজ্য ঘাটতি ক্রমশ বাড়তে থাকায় দেশটির স্থানীয় মুদ্রা রুপির দরপতন ঘটছে প্রতিনিয়তই। যুক্তরাজ্য এ বছর শেষের দিকে মন্দার কবলে পড়বে বলে অর্থনীতিবিদগণ আশঙ্কা করছেন। ইতিমধ্যেই তার লক্ষণ পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার লক্ষ্যে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড আবারও নীতি সুদের হার বাড়িয়েছে। ১ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে নীতি সুদের হার ১ দশমিক ৭৫ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে। গত ২৭ বছরের মধ্যে নীতি সুদের হার বৃদ্ধির এটাই সর্বোচ্চ রেকর্ড।
দেশটির অর্থনীতিবিদগণ মনে করছেন, নীতি সুদের হার বৃদ্ধি করেও মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হবে না। বর্তমানে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের নিচে থাকলেও এ বছর শেষের দিকে তা ১৩ শতাংশ অতিক্রম করে যেতে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ তুরস্কের মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৭৯ দশমিক ৯ শতাংশ, যা গত ২৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। আগামীতে বিশ্ব অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতিই হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি অনেক দেশের পক্ষেই সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না। করোনার প্রকোপ ছাড়াও রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্যের সাপ্লাই চেইন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ফলে বিভিন্ন দেশ তাদের উৎপাদিত খাদ্যপণ্য বিদেশে রপ্তানি করতে পারছে না। বিশ্বে এমন অনেক দেশ আছে যারা সামান্যতম খাদ্যপণ্য নিজেরা উৎপাদন করতে পারে না। তাদের চাহিদার পুরো খাদ্যপণ্যই অন্য দেশ থেকে আমদানি করতে হয়। বিশ্ব বাজারে মোট খাদ্যপণ্যের ৩০ শতাংশই রাশিয়া এবং ইউক্রেন জোগান দিয়ে থাকে; কিন্তু এ বছর যুদ্ধের কারণে ইউক্রেনের খাদ্য উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া যে খাদ্য উৎপাদিত হয়েছে তা-ও তুলতে পারছে না। এ বছর ইউক্রেনে মোট ৮ কোটি ৬০ লাখ টন খাদ্যপণ্য উৎপাদিত হয়েছে; কিন্তু যুদ্ধের কারণে ৩০ শতাংশ খাদ্যপণ্য মাঠেই থেকে যাবে, উত্তোলন করা সম্ভব হবে না। ইউক্রেনের গম এবং অন্যান্য খাদ্যপণ্যের ওপর মিশর, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ বিশেষভাবে নির্ভরশীল। রাশিয়া জ্বালানি তেল এবং গ্যাসের জোগান বন্ধ অথবা কমিয়ে দেওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য পরিবহন ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন দেশে খাদ্যপণ্যের মূল্য মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে মূল্যস্ফীতিও অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে।
বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বিভিন্ন দেশের খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতির যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে তা রীতিমতো উদ্বেগজনক। এতে বলা হয়, মার্চ-জুন সময়ে লেবাননের খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৩৩২ শতাংশ। জিম্বাবুয়েতে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি ২২৫ শতাংশ, ভেনেজুয়েলায় ১৫৫ শতাংশ, তুরস্কে ৯৪ শতাংশ, ইরানে ৮৬ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ৮০ শতাংশ এবং আর্জেন্টিনায় ৬৬ শতাংশ। অতিমাত্রায় মূল্যস্ফীতি দেশগুলোর বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ওপর প্রভাব ফেলছে। খাদ্য ও অন্যান্য নিত্যপণ্য আমদানির জন্য তাদেরকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হচ্ছে। ফলে তাদের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ কমে যাচ্ছে দ্রুত। এসব বিপন্নপ্রায় দেশগুলোর ঋণ-জিডিপি অনুপাত উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বের অন্তত ৯টি দেশ শ্রীলঙ্কার মতো ঋণখেলাপিতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে। এর মধ্যে জাম্বিয়া ঋণ-জিডিপি অনুপাত হচ্ছে ১০৪ শতাংশ। অন্যান্য দেশের মধ্যে মিশরের ঋণ-জিডিপি অনুপাত হচ্ছে ৯৫ শতাংশ, কঙ্গোর ৮৩ শতাংশ, ঘানার ৮১ শতাংশ, মরক্কোর ৭৬ শতাংশ, রুয়ান্ডার ৭৯ শতাংশ, দক্ষিণ আফ্রিকার ৭৬ শতাংশ এবং কেনিয়ার ৭১ শতাংশ। এসব দেশ যে কোনো সময় ঋণখেলাপিতে পরিণত হয়ে দেউলিয়াত্ব বরণ করতে পারে। বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতিই সবচেয়ে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৮৫৭ সাল থেকে ২০২৭-২০০৮ সাল পর্যন্ত অন্তত ৩৪ বার অর্থনৈতিক মন্দার কবলে পতিত হয়েছে; কিন্তু অতীতের মন্দাগুলো এবারের মতো এতটা উদ্বেগ সৃষ্টি করতে পারেনি।
প্রশ্ন উঠতে পারে, বাংলাদেশ কি পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে? বাংলাদেশ যদি সম্ভাব্য বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে চায় তাহলে বেশ কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। প্রথমেই আমাদের আমদানিব্যয় কমানোর মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের স্ফীত অবস্থা ধরে রাখতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যেই আমদানিব্যয় কমনোর জন্য বেশ কিছু বাস্তবধর্মী কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। অপ্রয়োজনীয় এবং বিলাসজাত পণ্য আমদানি নিরুত্সাহিত করা হচ্ছে। আমদানি নিষিদ্ধ পণ্যের তালিকায় ১২টির পরিবর্তে ২৬টি পণ্যকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অন্তত ১২৩টি পণ্যের আমদানি শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে এলসি মার্জিন শতভাগ করা হয়েছে। এসব কার্যক্রমের ফলে জুন মাসের তুলনায় জুলাই মাসে আমদানিব্যয় ২ দশমিক ১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হ্রাস পেয়েছে। এলসি খোলার হার ৩ শতাংশ কমেছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ সংকোচন করা হয়েছে। অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কোনো কোনো উন্নয়ন প্রকল্প যা তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ তার বাস্তবায়ন স্থগিত করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মতে, বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ সর্বশেষ ৩৯ দশমিক ৭২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে নেমে এসেছে; কিন্তু আইএমএফ বাংলাদেশ ব্যাংকের এই পরিসংখ্যানের সঙ্গে একমত নয়। তারা বলছে, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের প্রকৃত স্থিতি হচ্ছে ৩১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আইএমএফ বলছে, বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে অর্থ নিয়ে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলসহ বিভিন্ন ধরনের ঋণ তহবিল গঠন করেছে। এই ঋণ তহবিলের অর্থকে এখনো রিজার্ভ হিসেবে দেখানো হচ্ছে। এটা আন্তর্জাতিক রীতির পরিপন্থি। রিজার্ভ অর্থ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক ৭০০ কোটি মার্কিন ডলার দিয়ে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল গঠন করেছে; কিন্তু অর্থনীতিবিদগণ মনে করছেন, বাংলাদেশের ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভের পরিমাণ ৩১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হলেও মোট রিজার্ভের পরিমাণ ৩৯ দশমিক ৭২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কারণ ঋণ দেওয়া হলেও এগুলো একসময় ঠিকই বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ফেরত আসবে।
বাংলাদেশের পণ্য চাহিদার ২৩ শতাংশ আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হয়। সম্ভাব্য আন্তর্জাতিক মন্দার সময় বাংলাদেশের অর্থনীতি খুব একটা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা নেই। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রথম উৎস রপ্তানি আয় মন্দাকালীন সময়ে আরো বৃদ্ধি পেতে পারে। বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য মূলত তৈরি পোশাকনির্ভর। আর্থিক মন্দার সময় উন্নত বিশ্বের ভোক্তারা তুলনামূলক কম মূল্যের তৈরি পোশাক ক্রয়ের দিকে ঝুঁকে পড়বে। এই সুযোগে বাংলাদেশি তৈরি পোশাক রপ্তানি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। জনশক্তি খাতের রেমিট্যান্স প্রবাহ সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরে অনেকটাই কমে গেছে। এর মূল কারণ হচ্ছে মার্কিন ডলারের ব্যাংক রেট ও কার্ব মার্কেট রেটের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য। ব্যাংকে মার্কিন ডলারের যে রেট কার্ব মার্কেটে তার চেয়ে অন্তত ৮/১০ টাকা বেশি। কাজেই প্রবাসী বাংলাদেশিরা হুন্ডির মাধ্যমে তাদের রেমিট্যান্স দেশে পাঠাচ্ছেন করছেন। অর্থনীতিবিদগণ মনে করছেন, মার্কিন ডলারের বিনিময় হার মার্কেটের ওপর ছেড়ে দিলেই এই সমস্যার সমাধান হতে পারে। ব্যাংক রেট এবং কার্ব মার্কেট রেটের মধ্যে মূল্যের পার্থক্য খুব একটা বেশি না হলেই প্রবাসী বাংলাদেশিরা বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠাবেন।
বাংলাদেশের অর্থনীতির মৌল ভিত্তি অত্যন্ত শক্তিশালী। কাজেই মন্দা বা কোনো দৈবদুর্বিপাকে অর্থনীতি ভেঙে পড়ার আশঙ্কা নেই বললেই চলে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড ও অর্থনীতিবিষয়ক লেখক