মানুষ এই বিশ্বপ্রকৃতির অংশ। মানুষকে মনোযোগ দিয়া বিশ্লেষণ করিলে বিশ্বপ্রকৃতির রহস্য উপলব্ধি করা যায়। আবার বিশ্বপ্রকৃতির মাধ্যমেও চেনা যায় মানুষের প্রকৃতি। আমরা নৈর্ব্যক্তিকভাবে পুরা বিষয়টি বুঝিতে চেষ্টা করিলে দেখিতে পাইব—যে কোনো দ্বন্দ্ব-সংঘাতে ন্যূনতম দুইটি পক্ষের অস্তিত্ব থাকে। উজান হইতে পানি ভাটির দিকে গড়াইয়া পড়ে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির দ্বন্দ্বে। গ্রীষ্মের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাইলে বায়ুমণ্ডলে তাপমাত্রার হেরফের ঘটে। উষ্ণ বায়ু হালকা হইয়া ধাবিত হয় তুলনামূলক শীতল বায়ুর দিকে। তাহার সহিত জলীয়বাষ্প যুক্ত হইয়া সৃষ্টি হয় ঝড়ের। ঝড় শেষে ঠান্ডা হয় প্রকৃতি। উষ্ণতাও চলিয়া যায়, ঝড়ও থামিয়া যায়। প্রকৃতির রাজ্য ও মানবপ্রকৃতির ধারণা বিষয়ে মৌলিক কিছু কথা প্রায় ৪০০ বৎসর পূর্বে আমাদের জানাইয়াছেন বিখ্যাত ব্রিটিশ তাত্ত্বিক টমাস হবস্। তাহার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘লেভিয়েথান’-এ বলিয়াছেন, মানুষ সম্পূর্ণভাবে স্বাতন্ত্র্যবাদী। অপরের সর্বস্ব হরণ করিয়া স্বীয় স্বার্থ রক্ষা ও স্বীয় উন্নতি সাধনই তাহার অন্তর্নিহিত প্রকৃতি। হবস্ আরো বলিয়াছেন যে, মানুষের আকাঙ্ক্ষার শেষ নাই। একটি আকাঙ্ক্ষা পূরণ হইলে অপর একটি আকাঙ্ক্ষার উদয় ঘটে। কোনো বস্তু একবার ভোগ করিলে তাহা ভবিষ্যতে ভোগ করিবার স্পৃহা জাগ্রত হয়। আর এই ক্ষেত্রে একজন মানুষ নিজের প্রতিপক্ষ হিসাবে তাহার স্বজাতির অন্যজনকে দাঁড় করাইতে দ্বিধা করে না।
বিশ্ব জুড়িয়া মানুষে মানুষে হানাহানির মনস্তত্ত্ব মূলত এইখানে। অন্যদিকে, জড়জগতের বাহিরে জীবজগতের দিকে লক্ষ করিলে দেখা যায়, শক্তিশালী প্রাণী হইতে নিজেকে রক্ষার্থে নানা ধরনের কৌশল অর্জন করিতে হয় তুলনামূলক দুর্বল প্রাণীদের। এই কারণে বিচিত্র সকল কেমোফ্লেজ দেখা যায় প্রাণিজগতে। ইহা দেখা যায় শিকার ও শিকারি—উভয় শ্রেণির মধ্যেই। আবার, একদম ক্ষুদ্র প্রাণীকে ধ্বংস করিতে যেই সকল রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হয়, তাহাদের বিরুদ্ধে কিছুদিন পর প্রতিরক্ষার দেওয়াল গড়িয়া তোলে ঐ সকল প্রাণী। প্রাণ ও প্রকৃতি এমনই ভারসাম্যপূর্ণ। এইখানে যখনই বাড়াবাড়ি ঘটে, তখনই পালটা ব্যবস্থাও আমরা দেখিতে পাই। সহজ কথায়, প্রকৃতিজগতে কেহ ঢিল মারিলে তাহাকে পাটকেলটি খাইতেই হয়। নচেৎ বিলীন হইয়া যাইতে হইবে তাহাদের। কে চাহে নিজেদের বিলীন করিতে?
এখন প্রশ্ন হইল, জগতে শক্তিধররা যদি দুর্বলের ওপর নিরন্তর গদা ঘুরাইতে থাকে, ক্ষতবিক্ষত করিতে থাকে—তাহা হইলে দুর্বলের কী উপায় হইবে? মানুষের শরীরের কোথাও মশা বসিয়া রক্ত চুষিতে শুরু করিলে মশাটিকে না দেখিয়াও মানুষের হাত তৎক্ষণাৎ সেইখানে পৌঁছাইয়া যায়, চপেটাঘাতে কুপোকাত করিতে চাহে মশাটিকে। কেন? ইহা মানুষের শরীরের সহজাত আত্মরক্ষার কৌশল। একইভাবে শক্তিধররা যদি রক্ত চুষিতে থাকে, তাহা হইলে সহজাতভাবেই শোষিতরা নিজস্ব শক্তি-বুদ্ধিতে পালটা ব্যবস্থা লইবে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়া গেলে পরিস্থিতি হইয়া পড়ে ডু অর ডাই। নচেৎ উপায় কী? ইহাই প্রকৃতিজগতে সর্বত্র দেখা যায়। আর ১০টি প্রাণীর মতোই মানুষের টিকিয়া থাকিতে চাওয়াটা তাহার সহজাত প্রবৃত্তির অংশ। এই কারণে আমরা দেখিতে পাই—কোনো জনপদে কোনো এক গোষ্ঠীকে সর্বশক্তি দিয়া নির্মূলের পরও তাহাদের সামান্য অবশিষ্টাংশ কয়েক মাস কিংবা কয়েক বৎসর পর পুনরায় মাথাচাড়া দিয়া উঠিয়াছে। শক্তিধররা যখন প্রবল শক্তি ব্যবহার করে, তখন দুর্বলেরা টিকিয়া থাকিবার জন্য কী ধরনের নূতন উপায় খোঁজে বা খুঁজিতে চেষ্টা করে—ইহা লইয়া তাৎপর্যপূর্ণ গবেষণা হইতে পারে।
তবে সকল কিছুর ঊর্ধ্বে নিরপরাধ মানুষের জীবন। ধর্মেই বলা হইয়াছে, মানবজাতির জীবনমরণ, মানসম্মান—সকল কিছুই মহান সৃষ্টিকর্তার পবিত্র আমানত। সেই কারণে বলা হয় যে, যদি তুমি কাউকে হত্যা করো তবে তুমি যেন পুরো মানবজাতিকেই হত্যা করিলে। আবার যদি তুমি কাউকে রক্ষা করো তাহা হইলে তুমি পুরো মানবজাতিকেই রক্ষা করিলে। সুতরাং যে কোনো ধরনের নিরপরাধ মানবহত্যাই নিন্দনীয়। আর এইখানে পুনরায় ব্যক্ত করিতে হয় বড়~ চণ্ডীদাসের বাণী—‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’