শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ধন্য তাহার জীবন

আপডেট : ১৫ আগস্ট ২০২২, ০৩:২৬

আজ শোকের দিন। বাঙালির জাতির পিতাকে প্রায় সপরিবারে হত্যার নির্মম দিন; কিন্তু এমন শোকের দিন কেন আসিল? যাহার ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বে আমরা একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ পাইলাম, তাহাকে কেন বাঙালিদের হাতেই প্রাণ দিতে হইল? ইহার উত্তর খুঁজিয়া পাওয়া সহজ নহে। ইহার অনুসন্ধানে আমাদের একটু পিছনে ফিরিয়া দেখিতে হইবে।

ইতিহাসের দিকে তাকাইলে দেখা যাইবে, শতাব্দীর পর শতাব্দী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ উপনিবেশবাদীদের দ্বারা শাসিত ও শোষিত ছিল। দীর্ঘ সংগ্রাম করিয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বহু জাতি স্বাধীনতা অর্জন করিয়াছে। সেই সময় জাতীয়তাবাদী নেতাদের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় জাতিরাষ্ট্র। অধিকাংশ জাতিরাষ্ট্রের নেতাদের অঙ্গীকার ছিল শোষণযুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি ন্যায়ভিত্তিক অর্থনীতি প্রবর্তন করা। আমরা দেখিতে পাই, গত শতাব্দীর পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তরের দশকে বিশ্বে দ্বিমেরুকরণে বিভাজিত ছিল। সেই সময় তৈরি হয় বিপরীতমুখী দুই মতবাদ। একদিকে পুঁজিবাদ, অন্যদিকে সমাজতন্ত্র। এই দুই মতবাদের শীতল যুদ্ধের প্রেক্ষাপটটি স্মরণে রাখা প্রয়োজন। এই প্রেক্ষাপটে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় ও জনদরদি অনেক নেতাই নিষ্ঠুর হত্যার শিকার হন। বহু দেশে ঘটে রক্তাক্ত সামরিক অভ্যুত্থান। কোথাও কোথাও ঘটে রক্তপাতহীন অভ্যুত্থান। আব্রাহাম লিংকন, মহাত্মা গান্ধী, জন এফ কেনেডি, মার্টিন লুথার কিং, লুলুম্বা, নক্রুমা, বেনবেল্লা, সুকর্ণর মতো বিশ্ববরেণ্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হত্যাকাণ্ডের নির্মম শিকার হইয়াছেন। শুধু প্রেসিডেন্ট কেনেডি নন, তাহার ভাই সিনেটর কেনেডিও শিকার হইয়াছেন হত্যাকাণ্ডের। চিলির নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট সালভাদর আলেন্দেকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীও ভারত স্বাধীন হইবার পরের বৎসরই নিহত হন। পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানও শিকার হইয়াছেন হত্যাকাণ্ডের। পরবর্তী সময়ে ভারতে দুই জন প্রধানমন্ত্রী নিহত হইয়াছেন। হত্যা করা হইয়াছে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট বন্দরনায়েককেও। তবে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড যেন সকল প্রকার নৃশংসতা ও ট্র্যাজেডিকে হার মানাইয়া দিয়াছিল। এমনকি তাহাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যার পর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করিয়া রুদ্ধ করা হইয়াছিল বিচারের পথও। ইহার পর বৎসরের পর বৎসর ধরিয়া কুৎসা ও অপপ্রচার চালানো হইয়াছে জাতির মহত্তম এই অবিসংবাদিত নেতার বিরুদ্ধে। ইতিহাস হইতে তাহার নাম মুছিয়া ফেলিতে সর্বশক্তি নিয়োগ করিয়াছিল অপশক্তি; কিন্তু তাহা বুমেরাং হইয়াছে। যাহারা তাহার মতো মহত্তম মানবিক সত্তার মানুষকে নিচে নামাইতে চাহিয়াছিল, তাহারাই ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হইয়াছে।

ইতিহাসের পাঠ হইতে অনুধাবন করা যায়, অধিকাংশ জাতীয়তাবাদী নেতার নিয়তিই করুণ; কিন্তু ইতিহাসে তাহাদের স্থান অতি উঁচুতে। প্রকৃতপক্ষে, রাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালনা করিতে গিয়া সিদ্ধান্তে ভুল করেন নাই, এমন শাসক পৃথিবীর ৫ হাজার বৎসরের ইতিহাসে এক জনও পাওয়া যাইবে না; কিন্তু রাষ্ট্রপরিচালনার সকল ভুল কি কেবল রাষ্ট্রপ্রধানের কাঁধেই বর্তায়? সরকারের ভিতরে সহযোগী হিসাবে যাহারা থাকেন তাহারা কি ভুল করেন না? তাহাদের সেই ভুলের দায়ও তো রাষ্ট্রপ্রধানের স্কন্ধে গিয়া পড়ে। বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন ভাষণ হইতে জানা যায়, দলীয় নেতাকর্মীদের গণবিরোধী কাজে তিনি নিজেও একপর্যায়ে অতিষ্ঠ হইয়া গিয়াছিলেন। বঙ্গবন্ধু নিজেই তাহার আত্মসমালোচনা করিয়া ১৯৭৫ সালের ১৯ জুন বলিয়াছেন—‘আমি ফেরেশতা নই, শয়তানও নই, আমি মানুষ, আমি ভুল করবই।’ এই জন্যই তিনি রক্তমাংসের মহামানব! তিনি আমাদের আত্মপরিচয়ের জনক, তিনি আমাদের উপহার দিয়াছেন একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের ‘পাসপোর্ট’। তিনি আসিয়াছিলেন বাঙালি জাতিকে হাজার বৎসরের শৃঙ্খল হইতে মুক্ত করিতে। তাহার কারণেই বাঙালি জাতিকেও দাবাইয়া রাখা যায় নাই। এই জন্য তাহাকে কারাভোগ করিতে হইয়াছিল ৪ হাজার ৬৮২ দিন! জীবনের প্রতিটি ক্ষণ ও তাহার অর্জন মিলিয়া বঙ্গবন্ধু একজন সার্থক মানুষ! তাহার আপামর অর্জন চিরকালই অন্য সকল কিছুর ঊর্ধ্বে উচ্চারিত হইবে। ধন্য তাহার জীবন। তাহার মৃত্যুশোক আমাদের যেন জাতি হিসাবে চির উন্নত শির থাকিতে শক্তি দেয়!

ইত্তেফাক/ইআ