ভেজাল পণ্যে আসল উধাও। ভেজালহীন পণ্য অনেক সময় খুঁজিয়া পাওয়া মুশকিল। এই সম্পর্কে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য ‘ভেজাল’ নামক একটি চমৎকার কবিতা লিখিয়াছেন। তিনি লিখিয়াছেন, ‘খাঁটি জিনিস’ এই কথাটা রেখোনা আর চিত্তে,/ ‘ভেজাল’ নামটা খাঁটি কেবল আর সকলই মিথ্যে।’ করোনা মহামারির ধকল, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ডামাডোল, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা ইত্যাদির খবরের ভিড়ে ভেজাল পণ্যের খবর যেন হারাইয়া গিয়াছে। দুর্দিন-দুঃসময় চলিবার কারণে ইহা লইয়া আমাদের যেন মাথাব্যথা নাই। ভেজালবিরোধী অভিযানও আর তেমন চোখে পড়ে না। ইহার মানে এই নহে, আমরা সকল কিছু খাঁটি পাইতেছি। তবে আশার কথা হইল, বিদ্যমান ভেজাল আইনটি সংশোধিত হইতেছে। ভোক্তা অধিকার আইন-২০০৯ সংশোধিত হইয়া ইহা ভোক্তা অধিকার আইন-২০১৮ নামে অভিহিত হইবে। এই আইনটি খুব শিগিগরই জাতীয় সংসদে পাশ হইবে বলিয়া জানা যায়।
সংশোধিত আইনটি নানা কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এই আইনের বেশ কিছু ধারা পরিবর্তন ও সংযোজন করা হইয়াছে। বাড়িতেছে সেবা ও শাস্তির পরিধি। ইহাতে ভোক্তারা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নিকট শুধু অভিযোগই নহে, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নিকট মামলাও করিতে পারিবেন। এমনকি কোনো ভোক্তা প্রতারিত হইলে পণ্য উৎপাদনকারী, সরবরাহকারী এবং পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতার বিরুদ্ধে মামলা করিতে পারিবেন। আবার নতুন আইনে দোষী ব্যক্তির আপিলেরও ব্যবস্থা রহিয়াছে। বাড়িভাড়া, পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পাসপোর্ট, কুরিয়ার সার্ভিস, শিক্ষা (কোচিং), হজ রিক্রুটিং এজেন্সি, লাইসেন্স, বিউটি পার্লার, সেলুন, পরিবহন, টেলিযোগাযোগ, আবাসিক হোটেল, রেস্তোরাঁ, স্বাস্থ্যসেবা, ভূমি, রিয়েল এস্টেট, কর্মসংস্থান, মোবাইল ব্যাংকিংসহ নানা ক্ষেত্রে প্রতারণা প্রতিরোধে এই আইনটি কার্যকর ভূমিকা রাখিতে পারে। কেননা ভেজাল বা প্রতারণা শুধু খাদ্যে নহে, বহুরকম পণ্যেই রহিয়াছে। দোষী সাব্যস্ত হইলে বিভিন্ন ধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ তিন বৎসরের কারাদণ্ড বা ৩ লক্ষ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান থাকিতেছে। দেশে উৎপাদিত বা আমদানি মোড়কজাত পণ্যে উৎপাদনের তারিখ, মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ, মডেল বা ব্যাচ নম্বর ইত্যাদি না থাকিলে কিংবা মোড়কে নির্ধারিত মূল্যের চাইতে অধিক মূল্যে পণ্য বা সেবা বিক্রি করিলে তাহাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলিয়া বিবেচিত হইবে।
সাম্প্রতিককালে জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলিয়াছেন যে, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন অবশ্যই সময়োপযোগী এবং যথাযথ উদ্যোগের মাধ্যমে এই আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করা হইবে। নূতন আইনটি দ্রুত জাতীয় সংসদে পাশ করিবার মাধ্যমে সেই প্রক্রিয়া শুরু করিতে হইবে। তবে শুধু আইন প্রণয়ন করিলেই চলিবে না, ভেজাল ও নকল পণ্য প্রতিরোধে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সচেতনতাও অপরিহার্য। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিরা এই নকল ও ভেজাল পণ্য প্রতিরোধে বিভিন্ন ক্যাম্পেইন পরিচালনার মাধ্যমে সামগ্রিক পরিস্থিতির উন্নয়নে সম্পৃক্ত হইতে পারেন। দৈনিক ইত্তেফাক ‘আমরা কী খাচ্ছি’ শিরোনামে সিরিজ রিপোর্ট প্রকাশ করিয়া এই ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করিবার উদ্যোগ গ্রহণ করে; কিন্তু নিয়মিত বাজার তদারকি না থাকিবার কারণে ভেজাল কারবারিদের দৌরাত্ম্য বন্ধ হইতেছে না কিছুতেই। আমরা এইবারও ঈদসহ বিভিন্ন উৎসব-পার্বণে বিভিন্ন প্রকার মসলা, সেমাই, নুডুলস, দুধ ইত্যাদিতে ভেজালের ছড়াছড়ি লক্ষ করিয়াছি। মাছে এখন শুধু ফরমালিনই নহে, মিশানো হইতেছে প্লাস্টিকের কণা এবং গুড়ে ও মুড়িতে মিশানো হইতেছে যথাক্রমে চুন ও ইউরিয়া। হোটেল-রেস্তোরাঁর খাবারে বাসি-পচা ও পোড়া তৈলের ব্যবহার এখনো চলিতেছে। বিশেষত খাদ্যে ভেজালের কারণে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ডায়রিয়া, পেটে ব্যথা, বমিসহ দীর্ঘমেয়াদে হৃদরোগ, কিডনির রোগ, ক্যানসার, লিভার সিরোসিস, ব্রেনের সমস্যাসহ বিবিধ প্রকারের অসুখবিসুখে আক্রান্ত হইতেছে মানুষ। খাদ্যে মেশানো বিভিন্ন প্রকার কেমিক্যাল ও প্রিজারভেটিভের কারণেও জনস্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হইতেছে মারাত্মকভাবে। এমনকি জীবন রক্ষাকারী ঔষধেও ভেজালের সংমিশ্রণ চলিতেছে দুঃখজনকভাবে। এই জন্য ভেজালবিরোধী আইনের সর্বাত্মক প্রয়োগ জরুরি। আমরা আশা করি, নূতন আইনটি যথাযথভাবে কার্যকর হইয়া উঠিবে।