অধিক সংখ্যক বেকারের চাকরির পেছনে দৌড়ানো ও উদ্যোক্তা হওয়ার অনাগ্রসরতার চিত্র থেকে বোঝা যায়, বেকাররা উদ্যোক্তা হওয়ার চেয়ে চাকরিপ্রাপ্তির জন্য বেশি আগ্রহী। দুর্মূল্যের বাজারে চাকরি পাওয়া যেন সোনার হরিণ পাওয়ার মতোই আর তা যদি হয় সরকারি চাকরি। তবু বেকারসমাজের চাওয়া—একটা চাকরি চাই। না-চেয়ে উপায়ও নেই। পরিবারও চায় বেকার ছেলেটা বা মেয়েটা চাকরি করুক। কেননা চাকরি করলে মাস শেষে বেতন আসে। আরো অনেক সুবিধা আছে চাকরি করার। অন্যদিকে উদ্যোক্তা হলে কি মাস শেষে চাকরিজীবীর মতো বেতন হাতে আসে? আসে না, বরং মাস শেষে তাকে নানাবিধ খরচখরচা পরিশোধ করতে হয়। প্রয়োজনে ধারদেনা করতে হয়। ঋণের জন্য ব্যাংকের দ্বারে দ্বারে দৌড়াতে হয়। উদ্যোক্তা হওয়ার শুরুর দিনগুলোতে যে সংগ্রাম করতে হয়, তা একজন বেকার করতে রাজি নয়।
একজন বেকার চাইলেই বিনা পুঁজিতে, নিজের মেধা দিয়ে, নিজের কৌশল খাটিয়ে, নিজের হাতে থাকা মোবাইল ফোন দিয়ে, পড়াশোনার সময় ব্যবহূত ল্যাপটপ দিয়েই নিজেকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। কিন্তু সে ভাবনা না-ভেবে স্নাতক পাস করার পর সরকারি চাকরির জন্য পাগল হয়ে ওঠে। ঘুষ দিয়ে হলেও সরকারি চাকরি পেতে হবে! যে বেকার বিপুল অঙ্কের টাকা ঘুষ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত, সে কি সেই টাকা লগ্নি করে উদ্যোক্তা হতে পারে না? পারে না গ্রামের বাড়িতে পশুখামার তৈরি করতে? পারে না মত্স্য চাষ করতে? পারে। কিন্তু কষ্ট করতে কেউ আগ্রহী নয়। প্রতিটি সফল ব্যক্তির সফলতার পেছনে আছে ব্যর্থতার গল্প।
বেকার তরুণরা উদ্যোক্তা হতে পারে না, তার প্রধান কারণ পারিবারিক ও সামাজিক বাধা। এই বাধা হয়তো সবার পক্ষে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয় না। পরিণামে সমাজে অস্থিরতা, অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা বিরাজ করে।
দেশে এখন চাকরিক্ষেত্র যেমন বেশি, তেমনি উদ্যোক্তা হওয়ার পথ ও সুযোগ বেশি। বেসরকারি খাতের যতটা উন্নয়ন হয়েছে, কাজ জানলে সেখানে চাকরির অভাব নেই। বেসরকারি খাতের প্রতিটি প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিই শুরুতে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ছিলেন। সমাজের নানান প্রতিবন্ধকতা রুখে তাঁরা আজ সফল ব্যবসায়ী। হাজার হাজার বেকারের কর্মসংস্থান করে সরকারের পাশাপাশি তারাও দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। তাই শুরুতে যারা নিজেকে উদ্যোক্তা হিসেবে প্রমাণ করতে পারছে না, তারা বেসরকারি খাতে নিজের দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে কাজ শুরু করতে পারে। সেখান থেকে অর্জিত বাস্তব জ্ঞান, নিজের দক্ষতা ও সঞ্চিত বেতন দিয়ে নিজেই শুরু করতে পারে নিজের ব্যবসা যদি কি না উদ্যোক্তা হওয়ার মনোভাব থাকে।
সবাই উদ্যোক্তা হবে—এমনটা অবশ্যই না। প্রত্যেককেই আগ্রহের জায়গাকে প্রাধান্য দিতে হবে। কেউ বেসরকারি চাকরিতে ঢুকবে; যাদের মেধা ও ধৈর্য আছে, তারা সরকারি চাকরির জন্য চেষ্টা করবে। যাদের উদ্যোক্তা হওয়ার কৌশল জানা আছে, তারা উদ্যোক্তা হবে। যে যাই করুক, নিজেদের দক্ষ, আত্মপ্রত্যয়ী ও পরিশ্রমী করে গড়ে তুলতে হবে। স্নাতক পাস করার পরপরই নিজের নামের আগে বেকার উপাধিটা ডিলিট করে সিইও, অফিসার, উদ্যোক্তা ইত্যাদি পদবি লাগাতে হবে। সরকারি চাকরি মিলছে না বলে বসে না-থেকে, হতাশ না-হয়ে বেসরকারি চাকরিতে ঢুকে ভাগ্য বদলানো শুরু করতে হবে। ‘সরকারি চাকরি ছাড়া করব না’—এমন ইগোকে বিসর্জন দিতে হবে। বেসরকারি চাকরি করেও অসংখ্য মানুষ উচ্চপর্যায়ে চলে গেছেন। আবার বেসরকারিতে ভালো লাগছে না, সেটা ছেড়ে উদ্যোক্তা হতে হবে। মোটকথা, নিজের জন্য তো বটেই পরিবারের জন্য হলেও কিছু একটা করতেই হবে। পরিবারের জন্য কিছু করা মানে সমাজের জন্য কিছু করা, সমাজের জন্য কিছু করা মানে দেশের জন্য কিছু করা।
ঢাকা