মঙ্গলবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১১ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

বিভক্ত ব্রিটেনকে পরীক্ষায় ফেলবে রানির প্রয়াণ

আপডেট : ১০ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৬:১৯

স্বভাবতই অনুমেয় ছিল যে, শত বর্ষ ছুঁই ছুঁই ব্রিটেনের রানি বিদায় গ্রহণ করবেন। ছেড়ে যাবেন যুক্তরাজ্য। ছেড়ে যাবেন পৃথিবী। প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে মৃত্যু অনিবার্য যদিও, ব্রিটেনের সম্রাটের প্রয়াণ ও রাজবংশীয় উত্তরাধিকারের আচার-অনুষ্ঠানের কঠোর আনুষ্ঠানিকতা সবারই জানা। যুক্তরাজ্যের রাজার প্রয়াণ এবং একে ঘিরে তত্পরবর্তী কার্যপ্রণালি, রেওয়াজ পালন যে কোনো সময়ই একটি জটিল কাজ। চলমান বৈশ্বিক সংকটের উত্তাপে কিংবা ব্রিটেনের থমথমে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অবস্থার পটভূমিকায় দাঁড়িয়ে শতভাগ নির্ভুলভাবে উদ্ভূত পরিস্থিতি সামলাতে পারা কঠিন বৈকি।

স্কটল্যান্ডের বালমোরাল প্রাসাদে ৯৬ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এলিজাবেথ আলেকজান্দ্রা মেরি উইন্ডসর—রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। এলিজাবেথকে বিদায় জানাতে ব্রিটিশরা প্রস্তুত যদিও, তবে পুরো জাতি হতবাক এই জন্য যে, এমন একটি মুহূর্তে রানি চলে গেলেন যখন নানা অস্থিরতায় টালমাটাল অবস্থা যুক্তরাজ্যের। রানির মহাপ্রয়াণের এই শোকাতুর মুহূর্তে জরুরি বিষয় হলো, রাজনীতিক, শোকাভিভূত সুশীল সমাজ এবং সর্বোপরি ব্রিটেনের জনগণকে যতটা সম্ভব শান্তভাবে ও সংবেদনশীলতার সঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। এক্ষেত্রে বলে রাখতে হয়, নানা ঘটনায় স্থবির হয়ে পড়েছে বিশ্ব। চরম ক্রান্তিকাল চলছে যুক্তরাজ্য জুড়ে। ঠিক এরূপ একটি মুহূর্তে রানির চলে যাওয়া যুক্তরাজ্যকে ঘিরে অনুনাদ সৃষ্টি করবে আগামী বছরগুলোতে। সাংবিধানিক কাঠামো কিংবা রাজনৈতিক অঙ্গনে এই বিদায়ের প্রতিধ্বনি আছড়ে পড়লে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না।

বহু বছর ধরে রাজকার্য সামলেছেন এলিজাবেথ। ব্রিটিশ ইতিহাসে অন্য যে কোনো রাজার চেয়ে বেশি সময় রাজত্ব করেছিলেন তিনি। অন্য রাজাদের সঙ্গে এই ব্যবধানটা বেশ লম্বা। তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি ৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সিংহাসনে বসেছেন। এটি এমন একটি লম্বা সময় যার পুনরাবৃত্তি হওয়ার সম্ভাবনা নেই অদূর ভবিষ্যতে। মোটাদাগে উল্লেখ করার মতো আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, দীর্ঘকাল ধরে সিংহাসনে থাকলেও রানি এলিজাবেথ ছিলেন ত্রুটি-বিচ্যুতির ঊর্ধ্বে। এই বিষয়টি তাকে এনে দিয়েছে মর্যাদার আসন। মৃত্যুর আগ দিন পর্যন্ত রানি মাত্রই এলিজাবেথকেই জানত সমগ্র বিশ্ব। তিনিই ছিলেন একমাত্র সম্রাট। বিশ্বের অধিকাংশ মানুষের মনে সম্রাট হিসেবে রানি এলিজাবেথের ছিল একচ্ছত্র আসন। এর পেছনে যুক্তি হলো, রানির পূর্ববর্তী সম্রাট তথা রানির পিতা ষষ্ঠ জর্জের রাজত্বের স্মৃতি বহু পুরোনো; জর্জের স্মৃতি খুঁজতে গেলে আপনাকে হাতড়াতে হবে বহু আগের ইতিহাস, যা রানির উজ্জ্বল ইতিহাসের স্তূপে চাপা পড়ে গেছে। সহজভাবে বলতে গেলে, আগের সম্রাটকে খুঁজতে গেলে আপনাকে ফিরে যেতে হবে সেই ইতিহাসের পাতায় যা কমপক্ষে ৭৫ বছর আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বলতে হয়, রানি এলিজাবেথ, তার শাসনকার্য পরিচালনা এবং সর্বোপরি তার প্রয়াণ ব্রিটেনের জন্য নিঃসন্দেহে এক বড় ঘটনা—মহাকাব্য।

উল্লেখ করা প্রয়োজন, রাজতন্ত্র ধরে রাখতে পারার প্রশ্নে সর্বোচ্চ সফলতা দেখিয়েছেন এলিজাবেথ। তিনি এমন একটি ‘ব্যবস্থা’ যুগ যুগ ধরে চালিয়ে গেছেন যাকে বলা যায় ‘বয়ে চলা অন্তহীন-নিরবধি’ ব্যবস্থা। এলিজাবেথ এমন এক সফল ব্যবস্থা-পদ্ধতি দাঁড় করিয়েছেন যা আজকের বিশ্বেও বিশেষ স্বাতন্ত্র্যভাব বজায় রেখে চলেছে। তিনি এই ব্যবস্থাকে এমনই এক ভিত্তির ওপর প্রথিত করেছেন যা আধুনিক বিশ্বব্যবস্থার সঙ্গেও খাঁপ খাইয়ে চলতে পারে। এলিজাবেথের হাত ধরে এক দারুণ অভিযোজন গুণের আধারে পরিণত হয়ে ওঠে ব্রিটেনের রাজতন্ত্র। রানি হিসেবে এলিজাবেথের বিচক্ষণতা, একাগ্রতা এবং দূরত্ব বজায় রেখে চলার ক্ষেত্রে তার সুনিপুণ দক্ষতা রাজতন্ত্রকে এমন এক মডেল হিসেবে দাঁড় করিয়েছে যাকে আজকের দিনেও উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। এই ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠতে পারে, সম্রাট হিসেবে রানি এলিজাবেথ রাজতন্ত্রকে যে উচ্চ পর্যায়ে উন্নীত করেছেন তার ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারবেন তৃতীয় চার্লস (রানি এলিজাবেথের মৃত্যুর পর নতুন রাজা বা সম্রাট)? নাকি ঘটবে ভিন্ন কিছু? ইতিমধ্যেই অনেকেই বলতে শুরু করেছেন, চার্লসের জন্য তা সহজ হবে না মোটেও। কঠিন পথ পাড়ি দিতে হতে পারে চার্লসকে। এমনকি তিনি যদি সফল হনও, এলিজাবেথ যেরূপ বিশাল সম্মানের জায়গায় বসতে পেরেছিলেন তেমন জায়গায় বসতে চার্লসকে বহু কাঠখড় পোড়াতে হবে এবং তিনি ব্যর্থ হলে, সেই ব্যর্থতাকে কোনো ‘অস্বাভাবিক ঘটনা’ হিসেবে দেখার কোনো অবকাশ থাকবে না।

রাজতন্ত্র বিকশিত হয় বটে, যদিও তা বেশ ধীর গতিতে। এলিজাবেথের অধীনে রাজতন্ত্র বিকশিত হয়েছে বিস্তৃত পরিসরে। ষষ্ঠ জর্জের অধীনেও এই ব্যবস্থা বিবর্তিত হয়েছিল একইভাবে। চার্লসের অধীনে আরও বিকশিত হবে বলেই আপাতত ধরে নিতে হবে। রয়েল ফ্যামিলির পরিসর ছোট করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ নতুন রাজা চার্লস। এমনকি কতিপয় কমনওয়েলথভুক্ত রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানের পদ হতে ইস্তফা দিতে চান তিনি। কিন্তু এসব সত্ত্বেও রয়্যাল ফ্যামেলির চার দেয়ালের বাইরে গুঞ্জন রয়েছে, এলিজাবেথকে ছাড়া ব্রিটিশ জীবন তথা ব্রিটিশ ব্যবস্থার বিকাশ কল্পনা করা যায় না। রানি এলিজাবেথ ছিলেন জনগণের এক আবেগ-অনুভূতির জায়গা। কিন্তু তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সম্রাটের মর্যাদার জায়গায় কতটুকু হেরফের হবে তা সময়ই বলে দেবে।

গত জানুয়ারির ঘটনার দিকে দৃষ্টি দিলেই এর প্রমাণ মিলবে। পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে কেয়ার স্টারমার (লেবার পার্টির নেতা) বলেছিলেন, ‘কোভিড মহামারি চলাকালে ২০২১ সালে প্রিন্স ফিলিপের (এলিজাবেথের স্বামী) মর্মস্পর্শী অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় বিধবা রানি যেখানে স্বাস্থ্যবিধি পালনে কঠোর ছিলেন সেখানে বিপরীত কাজ করেছেন জনসন। কোভিড নিয়ম ভঙ্গ করে জন্মদিনে মদের পার্টি করেছেন তিনি!’ এই বক্তব্যে পার্টিগেটের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রানির প্রসঙ্গ টানতেই বিতর্কের মধ্যে পড়ে যান কেয়ার স্টারমার। পার্লামেন্টের স্পিকার লিন্ডসে হোয়েল তাকে তাত্ক্ষণিক তিরস্কার করে বলেছিলেন, ‘রাজপরিবারের কথা উল্লেখ করা আমাদের উচিত হবে না। আমরা রাজপরিবার নিয়ে আলোচনায় যেতে চাই না। আলোচনার বাইরেই থাক রাজপরিবার।’

সংসদে রাজপরিবার নিয়ে আলোচনা নাও হতে পারে, তবে দেশের জনগণের মাঝে আলোচনা তো থেমে থাকে না। প্রেসের কথাই যদি ধরা হয়, সাংবাদিকরা রাজপরিবারের সদস্যদের সম্পর্কে সব খোঁজখবরই রাখেন। কেমব্রিজের ঘটনা, সমস্যাকবলিত সাসেক্স, অপদস্থ অ্যান্ডরু কিংবা ডায়ানার পিছু ধাওয়া করার মতো বিষয়গুলো থেকে কখনো দূরে থাকেনি গণমাধ্যমগুলো। এরকম বহু বিষয় নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা আছে। রাজপরিবারকে ঘিরে আছে জল্পনা-কল্পনা । আছে বহু হিসাবনিকাশ। বহু আইনকানুন ও সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের অনেক শর্তাবলী রয়েছে যা নিয়ে আজকের ব্রিটেন যুক্তিসঙ্গতভাবে আলোচনায় বসতে চায়। বিশেষ করে, এলিজাবেথের দীর্ঘ শাসনের শেষে এই আলোচনায় বসার উপলক্ষ্য আসতে পারে।

ব্রিটিশ রাজতন্ত্র ব্রিটেনের জাতীয় জীবনে আগামী দিনে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে—এই দাবি পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ৭০ বছর শাসন কাজ চালিয়েছেন। তিনি রাজতন্ত্রকে এমন একটি অবস্থানে দাঁড় করিয়ে গেছেন যার প্রভাব খুব একটা বেশি না হলেও এর কার্যকারিতাকে পাশ কাটানো যায় না কোনোভাবেই। এই ব্যবস্থা ব্রিটিশদের এমন একটি জাতিতে পরিণত করেছে যার ফলে তারা দৃশ্যত অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে উঠেছে। এলিজাবেথের চলে যাওয়ার মাধ্যমে এই শক্তির জায়গাটি ভিন্ন রূপ নিতে পারে, ম্লান করে দিতে পারে শক্তির উত্পত্তিস্থলকে। তার উত্তরাধিকারীরা এর ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে সক্ষম হবে বলে মনে হয় না। এমনকি তার উত্তরসূরিদের আধুনিক ব্রিটেনের মুখোমুখি হওয়ার মতো কঠিন পরীক্ষায় ফেলতে পারে। নতুন রাজাকে মোকাবিলা করতে হতে পারে রাজনীতির জটিল সমীকরণ।

দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে যখন ব্রিটেনের প্রভাব ক্রমশ কমেছে, সমাজে আমূল পরিবর্তন এসেছে, রাজতন্ত্র প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, তখনো অনেকের কাছে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের জনপ্রিয়তা কমেনি এতটুকু। ব্রিটেনের রাজসিংহাসনে নিজ কর্তৃত্বে অটল থেকেছেন তিনি। রানির রাজত্বকালের শুরুর সময় ব্রিটিশ রাজতন্ত্র যে শক্ত ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল, যে রাজতন্ত্রের প্রতি মানুষের তখন প্রবল আনুগত্য ছিল, তার রাজত্বকালের শেষ সময়ে সেই উচ্ছ্বাস ও আনুগত্যে কিছুটা ভাটা পড়েছিল বটে; কিন্তু ব্রিটিশ জনগণের হূদয়ে রাজপরিবারের প্রতি ভালোবাসা যাতে চিরস্থায়ী হয়, তা নিশ্চিত করতে সারা জীবন সচেষ্ট ছিলেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ।

লেখক: কলামিস্ট
ইংরেজি থেকে ভাষান্তর: সুমৃৎ খান সুজন

ইত্তেফাক/এএইচপি

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন