বুধবার, ০৭ জুন ২০২৩, ২৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

ইহার অন্তর্নিহিত কারণ অজানা নহে

আপডেট : ১১ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৪:২০

পাবনা সদর উপজেলায় একজন আওয়ামী লীগ নেতাকে প্রকাশ্যে গুলি করিয়া হত্যা করা হইয়াছে। তিনি পাবনা পৌর আওয়ামী লীগের নির্বাহী সদস্য ছিলেন। তাহার নাম সায়েদুর রহমান মালিথা (৫০)। জুমার নামাজ পড়িতে যাওয়ার পথে দুর্বৃত্তরা তাহাকে এলোপাতাড়ি গুলি করিয়া নির্মমভাবে হত্যা করে। তাহার এই হত্যাকাণ্ডের পশ্চাতে দুইটি কারণ থাকিবার কথা বলা হইতেছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে। প্রথমত, তিনি জমিজমা লইয়া পারিবারিক বিরোধের কারণে হত্যাকাণ্ডের শিকার হইতে পারেন। দ্বিতীয়ত, ইহা রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডেরও অংশ হইতে পারে। আবার ইহা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনাও হইতে পারে। তবে ইহা হইতে আমাদের সতর্কতা অবলম্বন করিতে হইবে। কেননা আগামী ১৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হইবে ৬১ জেলা পরিষদ নির্বাচন। যে কোনো নির্বাচন আসিলেই আমাদের দেশে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বাড়িয়া যায়। ইহা যে ভারতীয় উপমহাদেশের নির্বাচনি অপসংস্কৃতির অংশ তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই।

৬১ জেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নের জন্য আবেদন ক্রয় করিয়াছেন ৫০০ নেতা। তবে স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচনে বিএনপি ও জাতীয় পার্টি অংশগ্রহণ করিতেছে না। ফলে প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা সকল কিছুই হইবে আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সহিত। কোথাও কোথাও মহাজোটের শরিক দলের সহিতও ইহা লইয়া বিবাদ দেখা দিতে পারে। এই নির্বাচনে দলীয় প্রতীক নাই। তাহার পরও আওয়ামী লীগের সমর্থন পাইতে অনেকেই মরিয়া। গতকাল প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মনোনয়ন বোর্ডের বৈঠক হইয়াছে। যেইহেতু দলীয় প্রতীক নাই, তাই ‘মনোনয়ন’ শব্দটির পরিবর্তে বলা হইতেছে ‘সমর্থন’ প্রদানের কথা। যাহারা এই সমর্থন পাইবেন, তাহাদের বিজয় প্রায় নিশ্চিত। এই সমর্থন লাভের দৌড়ঝাঁপ হইতেই দলীয় কোন্দল দেখা দেওয়াটা অমূলক নহে। যাহারা সমর্থন পাইবেন না, তাহাদের ‘বিদ্রোহী’ আখ্যা দেওয়াটা যেন নিয়ম হইয়া দাঁড়াইয়াছে; কিন্তু ইহা কতটা যুক্তি ও ন্যায়সংগত? আবার বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তথাকথিত বিদ্রোহী না থাকিলে সেই নির্বাচনই বা কীভাবে অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিযোগিতাপূর্ণ হইবে?  ইহাতে কি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচনি বৈতরণী পার হইবার সম্ভাবনাই বাড়িবে না?

রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ মনে করেন, বাংলাদেশে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের বড় একটি অংশ ঘটে জাতীয় ও স্থানীয় বিভিন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করিয়া। গত ইউপি নির্বাচনেও আমরা তাহার প্রমাণ পাইয়াছি। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এক হিসাব অনুযায়ী গত বৎসরের জানুয়ারি হইতে অক্টোবর পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হইয়াছেন ৭৪ জন। ইহার মধ্যে নির্বাচনি সহিংসতায় মারা গিয়াছেন ৪৩ জন। পৌর ও সংসদীয় উপনির্বাচনেও সহিংসতায় অনেক নেতাকর্মী প্রাণ হারান। ২০২০ সালে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটে ৩১টি। তাহার মধ্যে নির্বাচনি সংঘাতে মারা যান পাঁচ জন। তাহার পূর্বের বৎসর ২০১৯ সালে এই পরিস্থিতি ছিল আরও ভয়াবহ। ৩৯টি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের মধ্যে নির্বাচনি সহিংসতায় নিহত হন ২৫ জন। এই কারণে ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখিলেই যেমন ভয় পায়, তেমনি আসন্ন জেলা পরিষদ নির্বাচন লইয়াও কেহ কেহ চিন্তিত ও আতঙ্কিত। বিরোধী দল অংশগ্রহণ না করিলেও সেই নির্বাচনে কেন উত্তেজনা বাড়ে তাহা রীতিমতো গবেষণাযোগ্য। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা হত্যাকাণ্ডের শিকার হইতেছেন ইহা যেমন সত্য, তেমনি তাহারা ক্ষমতায় থাকিবার পরও কেন মারা যাইতেছেন তাহার কারণও নির্ণয় করিতে হইবে। যাহারা দেশ পরিচালনা করিতেছেন, ইহার অন্তর্নিহিত কারণ তাহাদের একেবারে অজানা এমনটি নিশ্চয়তা দিয়া বলা যায় না। বিশেষ করিয়া দলের অভ্যন্তরে যখন রাজাকার-আলবদর-আলশামসের মতাদর্শী লোকেরা ঘাপটি মারিয়া থাকে, তখন এমন পরিস্থিতিকে কি অনভিপ্রেত বলা যায়? অর্থের বিনিময়ে তাহারা কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট পাইয়া যায়, তাহা আমাদের অজানা নহে। অতএব, পূর্বাপর সকল কিছু চিন্তা করিয়াই আমাদের সাবধান হইতে হইবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সতর্ক পদক্ষেপের পাশাপাশি বন্ধ করিতে হইবে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের বিচার না পাইবার সংস্কৃতিও।

ইত্তেফাক/ইআ