শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

বিশেষায়িত চিকিৎসার সুযোগ নেই চট্টগ্রামে!

আপডেট : ১২ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৬:০১

বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবায় পিছিয়ে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী চট্টগ্রাম। এখানে সরকারিভাবে কোনো বিশেষায়িত হাসপাতাল নেই। এমনকি বেসরকারিভাবেও গড়ে ওঠেনি তেমন চিকিৎসা সুবিধা। বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত রোগীকে একই জায়গায় চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এতে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত রোগীরা উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিক্যালে ভিড় জমাচ্ছে। চিকিৎসকরা জানান, একই জায়গায় বিভিন্ন রোগে আক্রান্তদের অবস্থানের কারণে সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

চিকিৎসকরা জানান, বন্দরনগরী চট্টগ্রাম ব্যবসাবাণিজ্যসহ নানা কারণে গুরুত্ব বহন করে। জীবনজীবিকার তাগিদে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ চট্টগ্রামে বসবাস করে। দক্ষিণে কক্সবাজার থেকে তিন পার্বত্য জেলা ও নোয়াখালী ফেনী পর্যন্ত বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য উন্নত চিকিৎসাকেন্দ্র চমেক হাসপাতাল। আগুনে পোড়া, ক্যানসারে আক্রান্ত, অর্থোপেডিক, হৃদরোগ, শিশু, মানসিক রোগী, কিডনি রোগে আক্রান্ত, ডায়াবেটিক ও বিভিন্ন ধরনের সার্জারি রোগীরা চট্টগ্রাম মেডিক্যালে ছুটে আসছে। এত ধরনের রোগীকে এক জায়গায় চিকিৎসাসেবা প্রদান জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণও বটে। এতে সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, চট্টগ্রামে বিশেষ করে বার্ন, অর্থোপেডিক, ক্যানসার, শিশু ও হৃদরোগের বিশেষায়িত হাসপাতালের প্রয়োজন রয়েছে। চট্টগ্রামে বিশেষায়িত হাসপাতালের গুরুত্ব তুলে ধরে বিভিন্ন সভা সেমিনারে আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে গুরুত্ব পাচ্ছে না। এসব রোগের চট্টগ্রামে উন্নত চিকিৎসা না থাকায় প্রতিদিন অসংখ্য রোগী ভারত, সিঙ্গাপুর, ব্যাংককসহ বিভিন্ন দেশে চিকিৎসার জন্য চলে যাচ্ছে। এতে বিত্তশালীদের বিদেশে গিয়ে বিশেষায়িত চিকিৎসা লাভে সক্ষম হলেও গরিব রোগীরা উন্নত চিকিৎসা বঞ্চিত হচ্ছে। এমনকি ঢাকায়ও সরকারিভাবে এক ডজন বিশেষায়িত হাসপাতাল রয়েছে।

জানা যায়, গত পাঁচ/ছয় বছর আগে সরকারিভাবে  চট্টগ্রামে ২০০ শয্যার একটি শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠানর জন্য উদ্যোগ নেয় স্বাস্থ্য বিভাগ। বিষয়টি দেখভাল করার জন্য চট্টগ্রামের সিভিল সার্জনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। হাসপাতালের জন্য কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতুর উত্তর পাশে কর্ণফুলীর তীরবর্তী এলাকায় একটি সরকারি খাস জমি নির্ধারণ করা হয়। এখানে পৌনে দুই একর জায়গা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু শিশু হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ পরবর্তী সময়ে ঝিমিয়ে পড়ে। জানতে চাইলে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী ইত্তেফাককে বলেন, কর্ণফুলী তীরবর্তী নির্ধারণ করা জায়গায় হাসপাতাল নির্মাণ করা গেলেও চিকিত্সকসহ অন্যান্য স্টাফদের আবাসন ব্যবস্থার জায়গা হচ্ছে না। তাই এখন হাসপাতাল নির্মাণের জন্য নির্ধারিত জায়গা ঠিক রেখে চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয়সংলগ্ন জায়গায় আবাসন ব্যবস্থার প্রস্তাব করা হয়েছে। গণপূর্ত বিভাগ প্রস্তাবটি তাদের অধিদপ্তরে পাঠিয়েছে।’

চট্টগ্রামে বিভিন্ন সময়ে অগ্নিদগ্ধ হয়ে অসংখ্য মানুষ হতাহত হচ্ছে। কিন্তু চট্টগ্রামে আগুনে পোড়া রোগীদের কোনো বিশেষায়িত চিকিত্সাব্যবস্থা নেই। চমেক হাসপাতালের ২৬ শয্যার বার্ন ইউনিটে আগুনে পোড়া রোগীর চিকিৎসা পরিচালিত হচ্ছে। এখানে নেই কোনো অপারেশন থিয়েটার, আইসিইউ বেড। ফলে শরীরে ২০ শতাংশের বেশি আগুনে পোড়া রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। সম্প্রতি সীতাকুণ্ডে কনটেইনার ডিপোতে ভয়াভয় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় চট্টগ্রামে বিশেষায়িত বার্ন হাসপাতালের গুরুত্ব অনুভব হয়। প্রতিদিনই শিল্প কারখানায়, পুরাতন জাহাজ ভাঙা শিপ ইয়ার্ডে , সিলিন্ডার বিস্ফোরণে দগ্ধ হয়ে পোড়া রোগীরা চমেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি হচ্ছে। চট্টগ্রাম মেডিক্যালে চীনা অর্থায়নে আলাদা একটি বার্ন ওয়ার্ড নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা দৃশ্যমান হচ্ছে না।

চট্টগ্রামে বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবা সংকটে ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীরা সুচিকিৎসা পাচ্ছেন না। চমেক হাসপাতালে ক্যানসার চিকিৎসার  ২৫ শয্যার রেডিওথেরাপি ওয়ার্ড রয়েছে। এখানে একটি মাত্র কোবাল্ড মেশিন রয়েছে। রোগীদের সিরিয়াল পেতে এক মাস সময় লেগে যায়। প্রতিদিন বহির্বিভাগে দুই শতাধিক ক্যানসার রোগী চিকিৎসা নিতে বিভিন্ন স্থান থেকে আসছে।

সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন অসংখ্য লোক হতাহত হচ্ছে। অনেকেই পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে। অথচ চট্টগ্রামে কোনো ট্রমা হাসপাতাল নেই। চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলায় চট্টগ্রাম কক্সবাজার মহাসড়কের পাশে ২০০৭ সালে ২০ শয্যার একটি ট্রমা হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ট্রমা হাসপাতালের জন্য কিছু  চিকিৎসা সরঞ্জাম, আসবাবপত্র বরাদ্দ দেওয়া হলেও জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়নি। দীর্ঘদিন বিল্ডিংটি অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। করোনার প্রাদুর্ভাবের সময় সেখানে করোনা রোগীদের চিকিৎসাকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। চমেক হাসপাতালের অর্থোপেডিকস ওয়ার্ডে প্রতিদিন দেড় শতাধিক রোগী ভর্তি থাকে। ওয়ার্ডে জায়গা না হওয়ায় রোগীদের ওয়ার্ডের বাইরে বারান্দায় ও ফ্লোরে রেখে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে।

বেসরকারিভাবেও চট্টগ্রামে বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণে বিনিয়োগ হচ্ছে না। জানতে চাইলে পার্কভিউ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. রেজাউল করিম বলেন, বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণে বিনিয়োগ বেশি। এ কারণে তেমন কেউ এগিয়ে আসছে না। আশানুরূপ রোগী প্রাপ্তি নিয়েও ঝুঁকি আছে। চমেক হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. অং সু ফ্লো বলেন, চমেক হাসপাতাল রোগী চাপ সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। চট্টগ্রামে শিশু অর্থোপেডিক, ক্যানসার চিকিৎসার বিশেষায়িত হাসপাতালের প্রয়োজন। চমেক হাসপাতালে শিশু ওয়ার্ডে এক বেডে দুইটি শিশু রাখতে হচ্ছে। অর্থোপেডিক ওয়ার্ডে জায়গা হচ্ছে না। চমেক হাসপাতাল ২ হাজার ২০০ শয্যার অনুমোদন পেয়েছে। তবে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে আমরা সাড়ে ৩ হাজার শয্যার অবকাঠামো ও জনবলের অরগানোগ্রাম তৈরির কাজ করছি।

ইত্তেফাক/ইআ