শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ইউক্রেনের অগ্রসর রাশিয়ার সামরিক পরাশক্তি পরিচয় ধূলিসাৎ করছে!

আপডেট : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৪:১০

অর্ধবার্ষিক অতিক্রম করলেও থামানো যায়নি ইউক্রেন যুদ্ধ। ইউক্রেনের দুর্বার প্রতিরোধের মুখে পুতিন বাহিনী কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। ইউক্রেনীয় যোদ্ধাদের মুহুর্মুহু আক্রমণ ও পালটা আক্রমণের অভূতপূর্ব সাফল্য শক্তিধর রাশিয়ান বাহিনীকে ফেলে দিয়েছে নাজুক পরিস্থিতিতে। সামরিক পরাশক্তি হিসেবে রাশিয়ার সুখ্যাতির যে তথাকথিত গল্প শোনা যেত এযাবতকাল, সেই গল্পের বাস্তব রূপ সামনে এনেছে চলমান ইউক্রেন যুদ্ধ। ভ্লাদিমির পুতিনের ইউক্রেন আক্রমণের এই লম্বা সময়কালে একটি বিষয় অন্তত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, পুতিনের সেনাবাহিনী আসলে এমন এক প্রতিষ্ঠান, যা বড়সড় ত্রুটিতে পরিপূর্ণ। 

রাশিয়ান বাহিনীর সক্ষমতা জাহির করতে যে প্রকাণ্ড ফাইটিং ফোর্সের কথা বলে আসছে রেড স্কয়ার প্যারেড কিংবা ক্রেমলিন, তার সঙ্গে ইউক্রেনে লড়াইরত রুশ বাহিনীর আদৌ কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বরং লক্ষ করা যাচ্ছে, নিষ্কলুষ দাবি করা রাশিয়ান সামরিক বাহিনী অনিয়ম-দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। মনোবলের ঘাটতির সঙ্গে সৈন্যদের ভোগাচ্ছে দুর্বল নেতৃত্ব। স্বল্পমাত্রায় সৈন্য সরবরাহের কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রাধান্য পাচ্ছে স্বতন্ত্র উদ্যোগ, যার বড় মাশুল গুনতে হচ্ছে লড়াইরত সৈন্যদের। মোটা দাগে উল্লেখ করার মতো আরেকটি বিষয় হলো, দায়িত্ব গ্রহণে অনীহা দেখা যাচ্ছে রাশিয়ান কমান্ডারদের মধ্যে। লড়াই চালিয়ে যেতে ব্যক্তিগত অনিচ্ছার কথাও বলেছেন অনেকেই। উপরন্তু, উত্তর-পূর্ব ইউক্রেনে বিপর্যয়কর পরাজয় আরও জটিল করে তুলছে পরিস্থিতিকে। সব মিলিয়ে সেনা অফিসারদের ঘিরে ধরেছে ‘চরম ভয়’। তাদের এই ভয় পেয়ে বসার অন্যতম কারণ হলো, রাশিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে লজ্জাজনক সামরিক পরাজয় থেকে বাঁচতে মস্কোর বলির পাঁঠা হয়ে উঠেছে লড়াইয়ে বাধ্য হওয়া রুশ সৈন্যরা।

চলমান যুদ্ধে বিভিন্ন অঞ্চলে ইউক্রেনের সাম্প্রতিক বিজয়গুলো স্তম্ভিত করেছে পুরো বিশ্বকে। সম্ভবত সবচেয়ে অবাক-বিস্মিত হয়েছে স্বয়ং রাশিয়া! হয়তোবা তাদের  মতো অবাক হয়নি আর কেউ-ই। রাশিয়ান বাহিনীর আক্রমণের জবাবে ইউক্রেনীয় যোদ্ধাদের পালটা আক্রমণের খবর ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল ক্রেমলিন। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছেন পুতিন। ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাত ও রুশ বাহিনীর মুখ থুবড়ে পড়ার দৃশ্য দেখে সহজ-স্পষ্টভাবে বুঝে নেওয়া যায়, ব্যর্থতা ঢাকতে পুতিন সর্বোত্তম চেষ্টাটাই চালিয়েছেন বটে! যদিও বহু প্রচেষ্টা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত প্রকৃত সত্য চেপে রাখা যায়নি। এর ফলে যা ঘটেছে তা হলো, রাশিয়ার জনসাধারণের উপলব্ধিতে লেগেছে একটি বিশাল মনস্তাত্ত্বিক আঘাত। রাশিয়ান জনগণ যখন প্রথম বারের মতো জেনেছিল ইউক্রেনে তাদের সৈন্যরা ব্যর্থ হচ্ছে, এমনকি আটক সৈন্যদের চরম মারধর করা হচ্ছে, তা তাদের চরমভাবে হতাশ করে তোলে। খারকিভ ও ব্লাস্টে রাশিয়ান বাহিনীর পতন টনক নাড়ায় ইউক্রেনের সহযোগীদের। তারা ভাবতে শুরু করে ভিন্ন চিন্তা। তারা বুঝতে পারে, রাশিয়ার ওপর অতিমাত্রায় নির্ভর করাটা হবে বড় ধরনের বোকামি। কাজেই পুতিনের সঙ্গ পরিত্যাগ করতে দুবার চিন্তা না করাটাই হবে যুক্তিযুক্ত ও বুদ্ধিমানের কাজ।

এসব বিষয়ের বাইরে ইউক্রেনের পালটা আক্রমণ রাশিয়ান সামরিক বাহিনীর সামগ্রিক অবস্থা সম্পর্কে ক্রমাগতভাবে বহু ভবিতব্য উন্মোচন করছে। ইউক্রেন যুদ্ধে পুতিনের ভরাডুবি বলে দিচ্ছে অনেক কিছু। আগামী দিনগুলোতে রাশিয়া কিংবা তার সামরিক বাহিনী ঠিক কতটুকু আশা-প্রত্যাশা পূরণ করার ক্ষমতা রাখে, তারও ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। যে ভয় ঘিরে ধরেছে রাশিয়ান কমান্ডারদের, তাকে পাশ কাটানো সহজ নয় মোটেও। রাশিয়ার জাতীয় স্বার্থের ক্ষয়ক্ষতির চিন্তাকে বড় করে না দেখে নিজের মূল্যবান জীবন হারানোর ভয় তথা ব্যক্তিগত চিন্তাকে বড় করে দেখার বিষয়টি রাশিয়ান সেনাবাহিনীর জন্য অনিবার্যভাবে পতন ডেকে আনবে। রুশ সেনাবাহিনীর দুর্বল নেতৃত্বের ফলে ইউক্রেনে ধুঁকতে থাকেব রাশিয়া।

রাশিয়ান সামরিক বাহিনীর দুর্বলতা বোঝার জন্য দুটি বিষয়ই যথেষ্ট। এ দুটি বিষয় হলো—ইউক্রেন যুদ্ধে রুশ বাহিনীর অদক্ষতা ও জবাবদিহির অভাব। এখানে একটি বিষয় বলে রাখা অত্যন্ত জরুরি, ইউক্রেনীয় সামরিক বাহিনী সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সোভিয়েত ঐতিহ্য থেকে বেশ দূরে সরে গেছে; যাতে করে সৈন্যরা একটি আমূল পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সক্রিয় রয়েছে। একই সঙ্গে ন্যাটো-পারদর্শিতাপূর্ণ সংস্কারগুলো তথা যুদ্ধের আধুনিক সব কলাকৌশল রপ্ত করেছে তারা। এসব ইউক্রেনীয় বাহিনীকে গড়ে তুলেছে এক শক্তিশালী ইউনিট হিসেবে। অন্যদিকে রাশিয়ান সেনাবাহিনী রয়ে গেছে গত্বাঁধা ‘অনমনীয় ফাইটিং মেশিন’ হিসেবেই। তাছাড়া টপ-ডাউন নানা রকম সিদ্ধান্ত বাধাগ্রস্ত করেছে রুশ বাহিনীর দক্ষতা বৃদ্ধিকে। আধুনিক কঠোরতর যুদ্ধের  প্রশ্নে রুশ বাহিনী যা রপ্ত করেছে, তা আধুনিক বিশ্বে সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত। আজকের দিনে দাঁড়িয়েও রাশিয়ান কমান্ডাররা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার রেড আর্মির সামরিক কৃতিত্ব থেকে অনুপ্রেরণা খোঁজার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে—কী অদ্ভুত বিষয়! মূলত এসব কারণেই অনেক বেশি সক্রিয়, আধুনিক, বুদ্ধিমান ও কৌশল রপ্ত করা ইউক্রেনীয় বাহিনীর কাছে নতি স্বীকারে বাধ্য হচ্ছে রাশিয়ান বাহিনী। পুতিনের ‘অপার শক্তিধর’ বাহিনীকে ক্রমাগতভাবে পশ্চাত্পসরণ করতে হচ্ছে।

ইউক্রেনের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো রাশিয়ার বলে আসা বহু অতিরঞ্জন ঘটনার পেছনের অন্তর্নিহিত সত্য প্রকাশ করেছে। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের বর্ণনায় রাশিয়া বিশ্বের ২ নম্বর সামরিক শক্তিধর দেশ হিসেবে স্থান করে নিয়েছে সত্য, তবে আজকের রাশিয়াকে দেখে তা কি মনে হচ্ছে আদৌ? শান্তিকালীন বিশ্বব্যবস্থায় এ ধরনের ভুল ধারণা বিশ্বাস করেছে সবাই যদিও, কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধের আদ্যোপান্ত লক্ষ করে এই দাবিকে স্বীকার করতে চাইবে না যে কেউ-ই। সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে, রাশিয়ার বার্ষিক প্রতিরক্ষা বাজেট থাকে ৬০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি, যা বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম। কিন্তু প্রতিরক্ষা খাতে এই বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের পরও রুশ বাহিনীর বেহাল দশা দেখে এই বাজেটই শুধু নয়, পুতিনের জাহির করা নানা গালগল্প নিয়ে উঠতে পারে নানা প্রশ্ন, বিতর্ক।

এটা এখন স্পষ্ট, পশ্চিমা পর্যবেক্ষকেরা রাশিয়াকে গণনা করতে ভুল করেছিলেন। বেশির ভাগ বিশ্লেষণে সৈন্য, ট্যাংক, ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমানের সংখ্যার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু এখন প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে, প্রতিটি পরিসংখ্যান ছিল বিভ্রান্তিকর। এটি আজ চরম সত্য, রাশিয়ার প্রতিটি তথ্যই সম্পূর্ণরূপে মিথ্যা, বানোয়াট।

একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ইউক্রেনে রাশিয়ান সেনাবাহিনী যেসব অসুবিধায় পড়েছে বা পড়ছে, তাতে করে ভ্লাদিমির পুতিনের কর্তৃত্ববাদী শাসনের সীমাবদ্ধতাগুলো প্রকাশ্যে আসছে। ২০২২ সালের গোড়ার দিকে পুতিন ইউক্রেন আক্রমণ করে বসলে তাকে কেউ থামানোর সাহস করেনি। ইউক্রেনের ধ্বংস নিয়ে পুতিনের ব্যক্তিগত আবেশের মাধ্যমে এটা স্পষ্ট হয়, কেউ তাকে বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করার সাহস করেনি। এর সঙ্গে যোগ হয় রাশিয়ান সেনাবাহিনীর অপরাজেয়তার প্রতি পুতিনের অন্ধ বিশ্বাস। আর ইউক্রেনের ওপর তার পুঞ্জীভূত চিরকালীন জেদ তো ছিলই। সব মিলিয়ে আক্রমণ করে ইউক্রেনকে গুঁড়িয়ে দিতে মরিয়া হয়ে ওঠেন পুতিন।

সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উবে গেছে পুতিনের ফ্যান্টাসি ভিশন (রাশিয়াকে নতুন করে সৃষ্টি করার মিশন)। বাস্তবতার বিচারে আত্মস্বীকৃত রাশিয়া আজ দাঁড়িয়ে আছে খাদের কিনারায়। কিয়েভে পরাজয়ের পরে ২০২২ সালের এপ্রিলে উত্তর ইউক্রেন থেকে রাশিয়ান সৈন্য প্রত্যাহার এবং পরবর্তী সময়ে স্নেক আইল্যান্ড থেকে পশ্চাত্পসরণ—উভয়কেই হাস্যকরভাবে চিত্রিত করতে চেষ্টা করেছে রাশিয়া। তাদের ভাবটা এমন ছিল, যেন কিছুই হয়নি! একইভাবে যখন রাশিয়ান ব্ল্যাক সি ফ্লিট ফ্ল্যাগশিপ মস্কভা ডুবিয়ে দেয় ইউক্রেন, তখন ঘটনাটিকে ‘জাহাজে দুর্ঘটনাজনিত আগুন’ বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল মস্কো। কী আশ্চর্যজনক! এসব ঘটনাকে বিকৃত করে প্রচার করতেও পিছপা হয়নি ক্রেমলিন। ক্রেমলিনের প্রচার করা প্রতিটি তথ্য ছিল নিছক বানোয়াট। নানা অযৌক্তিক অজুহাতের আশ্রয় নিলেও পুতিন আসল সত্যকে চাপা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন শেষ পর্যন্ত। পরাজয় স্বীকার করতে পুতিনের মিথ্যা আঁকড়ে ধরার মরিয়া চেষ্টা রাশিয়ার ব্যর্থতা-অক্ষমতাকেই বড় করে দেখিয়েছে বিশ্ববাসীর সামনে।

আগামী দিনগুলোতে ঠিক কী ঘটতে চলেছে, তা অনেকাংশে নির্ভর করবে ইউক্রেনে অস্ত্র সরবরাহের ওপর। রাশিয়াকে ইউক্রেন থেকে চিরতরে বিতাড়িত করতে ট্যাংক ও ফাইটার জেটের পাশাপাশি অধিক পরিমাণে আর্টিলারি, গোলাবারুদ ও সাঁজোয়া যান দরকার ইউক্রেনীয় যোদ্ধাদের। অস্ত্র সরবরাহ বাড়তে থাকবে বলেই মনে হচ্ছে এখন পর্যন্ত। অস্ত্রের ধরন ও পরিমাণ উভয়ই বাড়ছে। রাশিয়ার সামরিক পরাশক্তির মর্যাদা ছিন্নভিন্ন করতে এবং সর্বোপরি একটি নিষ্পত্তিমূলক বিজয়ের জন্য গণতান্ত্রিক বিশ্বের উচিত ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহ করা। এতে করে ইউরোপে শান্তি সুপ্রতিষ্ঠিত হবে। রক্ষা পাবে বিশ্ব। ধূলিসাৎ হবে পুতিনের সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষা।

লেখক : সেন্টার ফর ডিফেন্স স্ট্র্যাটেজিসের চেয়ারম্যান ও ইউক্রেনের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী
আটলান্টিক কাউন্সিল থেকে ভাষান্তর : সুমৃৎ খান সুজন

ইত্তেফাক/ইআ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন