‘শ্রেণিহীন’ কথাটির মধ্যে দারুণ একটা স্পিরিট রহিয়াছে। কোথাও কোনো ভেদাভেদ থাকিবে না, উঁচুনিচু থাকিবে না, ছোটবড় থাকিবে না। কবিতা-গল্প-প্রবন্ধ-দর্শনে এই ‘শ্রেণিহীন’ বিষয়টি দারুণভাবে হাততালি জোগায়। ‘সাম্যবাদী’ কবিতায় কাজী নজরুল ইসলাম তাহার স্বভাবসুলভ বিদ্রোহী মনস্তত্ত্বে লিখিয়াছেন—‘গাহি সাম্যের গান—/ যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান।’ মনে করা হয়, ‘শ্রেণিহীন’ মানেই হইল ‘বৈষম্যহীন’। কীসের বৈষম্য—ইহা মূলত অধিকারের বৈষম্য। এই ক্ষেত্রে বলা হয় যে, মানবসমাজের ক্রমবিকাশের গতিপথটি শুরু হইয়াছিল আদিম ‘সাম্যতন্ত্র’ হইতে। এই আদিম সাম্যতন্ত্র হইতে দাসতন্ত্রে, দাসতন্ত্র হইতে সামন্ততন্ত্রে, সামন্ততন্ত্র হইতে ধনতন্ত্রে। এই হিসাবে পূর্ববর্তী সমাজব্যবস্থার ভিতরেই পরবর্তী উন্নততর সমাজব্যবস্থার বিভিন্ন উপাদান পরিপুষ্টি লাভ করিয়াছে।
মাঝখানে কিছুদিন আলোচনা হইল সমাজতন্ত্র। ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে আবির্ভাব ঘটিয়াছিল হেনরি ডি সেইন্ট সাইমন, রবার্ট ওয়েন এবং চার্লস ফুরিয়ার নামের দার্শনিকদের। তাহারা এমন একটি শ্রেণিহীন সমাজের স্বপ্ন দেখাইলেন, যেইখানে পুঁজিবাদের অভ্যন্তরে লুকাইয়া থাকা প্রতিযোগিতা নহে, বরং প্রাধান্য পাইবে সমাজের সকল মানুষের মধ্যকার সহযোগিতা ও ঐক্যবদ্ধতা। সেই সমাজে মুক্তবাজারই নিয়ন্ত্রণ করিবে সকল পণ্যের চাহিদা ও জোগান। ইহার পর আসিলেন কার্ল মার্কস। ফ্রেডরিক অ্যাঙ্গেলসকে সঙ্গে লইয়া ঊনবিংশ শতকের প্রায় মাঝামাঝি সময়ে প্রকাশ করিলেন ‘দ্য কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’। অতঃপর এই একবিংশ শতাব্দীতে আসিয়া বিশ্বের সিংহভাগ বিশ্লেষক উপসংহারে পৌঁছাইলেন যে, পুরোপুরি অবাস্তবসম্মত ও ইউটোপিয়ান ভাবনা দিয়া হাততালি পাওয়া যায়, মানুষকে স্বপ্ন দেখানো যায়, কিন্তু ব্যাবহারিক ক্ষেত্রে উহা ব্যর্থ হইতে বাধ্য।
আমরা প্রকৃতির পাণে তাকাইয়া কী দেখি সেইখানে? ‘শ্রেণিহীন’ শব্দের রঙিন চশমা আমাদের একরকম অন্ধত্ব দান করে। আমরা সেই চশমা খুলিয়া দেখিলে বুঝিতে পারিব—এই বিশ্বপ্রকৃতি যদি শ্রেণিহীন, সাম্যময়, সমতাপূর্ণ হইত—তাহা হইলে প্রকৃতিতে একরকম স্থবিরতা চলিয়া আসিত। সাম্য-সমতা-ভেদাভেদহীন প্রকৃতি কেমন হইবে? যদি পৃথিবীর কোথাও খাদ না থাকিত, উঁচুনিচু ব্যাপার না থাকিত—তাহা হইলে কোথাও থাকিত না পাহাড়-পর্বত এবং নদী-সমুদ্র। সারা পৃথিবী সমান তথা ‘শ্রেণিহীন’ থাকিলে পৃথিবীর তিন ভাগের এক ভাগ যে স্থলভূমি আছে—তাহাও থাকিত না। সারা পৃথিবীই কয়েক মিটার জলের নিচে নিমজ্জিত থাকিত। মহাবিশ্বের দিকে তাকাইলে দেখা যায়, আমাদের সূর্য অত্যন্ত সাধারণ মানের নিম্নশ্রেণির বামন তারকা। পৃথিবীও সৌরজগতে ছাগলের তৃতীয় বাচ্চার ন্যায় তিন নম্বর নিম্নমধ্যম শ্রেণির গ্রহ। দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা যায়, এই প্রকৃতি ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যদি ‘শ্রেণিহীন’ হইত—তাহা হইলে ইহা এখনো সৃষ্টির আদি অবস্থা তথা ‘বিগ ব্যাং’-এর মধ্যেই একাকার হইয়া আটকাইয়া থাকিত। সুতরাং ‘শ্রেণি’ই সৃষ্টি করিয়াছে বৈচিত্র্য এবং নূতন পথ। বিদ্যুত্প্রবাহের মধ্যেও রহিয়াছে ইলেকট্রনের স্রোত—যাহা সৃষ্টি হয় সংকট হইতে। স্রোত বহিবার সংকট না থাকিলে উহা স্তব্ধ হইয়া যায়। এই জন্য বলা হয়—‘যে নদী হারায়ে স্রোত চলিতে না পারে/ সহস্র শৈবালদাম বাঁধে আসি তারে।’ সুতরাং বিজ্ঞান ও প্রকৃতির দৃষ্টিতে—শ্রেণিহীন মানে স্তব্ধতা।
আমাদের কাহারো উচ্চতা সমান নহে, শরীরের রং ও চেহারা সমতাপূর্ণ নহে, হাতের আঙ্গুলের ছাপও কাহারো এক নহে। আমাদের সকলের প্রতিভা এক নহে, যোগ্যতাও আলাদা আলাদা। আমরা সকলেই মানুষ বটে, তবে সকলেই আইনস্টাইন-নিউটনের সমান বিশ্লেষণবুদ্ধি রাখি না, বোল্টের ন্যায় দৌড়াইবার ক্ষমতা রাখি না, মেসির ন্যায় ক্রীড়াদক্ষতা রাখি না। আমরা কখনো ভাবিয়া দেখিয়াছি—কেন রাখি না? কেন এই অসাম্য?
মজার ব্যাপার হইল, যাহারা শ্রেণিহীন সমাজের কথা বলেন, সমতার কথা বলেন, তাহারা যখন দায়িত্বশীল পদে বসেন, দেখা যায় তাহাদের চেয়ার অন্যদের চাইতে আলাদা। তাহাদের বাসভবনটিও আলাদা। ইহকালের ন্যায় পরকালেও আমরা ভাগ দেখিতে পাই। বেহেশত-দোজখেও ভাগ রহিয়াছে। সুতরাং শ্রেণিহীন নহে, আসল কথা হইল—ইক্যুয়াল অপরচুনিটি। অর্থাৎ সকলের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা। এই সূত্রটিই বর্তমান সময়ে সবচাইতে গ্রহণযোগ্য সূত্র। আর ইহা বুঝিতে হইলে সর্বাগ্রে জানিতে হইবে নিজেকে।