রোববার, ০৪ জুন ২০২৩, ২০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

যাত্রীদের মানসিক সুস্থতা নষ্ট করছে গণপরিবহন

আপডেট : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৬:১০

গণ-পরিবহন জনগণের সুবিধার্থে স্বল্পখরচের পরিবহন। স্বল্পদূর এবং বহুদূর চলাচলের বাহন। গণ-পরিবহন যাত্রী-সাধারণের গন্তব্যে পৌঁছানোর নাম। পৃথিবীর দেশে দেশে এই ব্যবস্থা বিদ্যমান। ব্যক্তিগত গাড়িওলারাও দূরের যাত্রায় এই বাহন ব্যবহার করেন। জনগণের সেবামূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এর পরিচিতি হওয়ার কথা। সেবামূলক মানে তো বিনে পয়সার সেবা নয়। টাকা-পয়সা ছাড়া তো কেউই পরিবহনের যাত্রী হয় না বা হতেও পারে না। এটা নিয়মও নয়। সেবামূলক বলা হয় এই কারণে যে, মনের স্বস্তির সঙ্গে তার যাত্রা এবং ভাড়া যেন মেনে নেওয়ার মতো হয়। গাড়ির মালিক-কর্মচারীদের সেবার মনোবৃত্তি এবং আচার-আচরণ যেন স্বস্তিদায়ক হয়। জনসম্পৃক্ততা নিয়ে তো এর চলাচল। কাজেই সুন্দর আবহের জনকল্যাণ যেন এতে নিহিত থাকে। এটাই তার ধর্ম হওয়া বাঞ্ছনীয়।

জনগণ রাষ্ট্রের মালিক। এই মালিক-জনগণের অস্বস্তিদায়ক কোনো কিছু রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে না। এতে কল্যাণ রাষ্ট্রের পরিচিতি হয় না। রাষ্ট্রযন্ত্রই দেশ পরিচালনার কাজে নিয়োজিত। সহানুভূতিহীন যান্ত্রিকতা যেন তার না থাকে। শুভ-সুন্দর অনুভূতি তার থাকা চাই। সুচিন্তিতভাবে জনগণের সেবা এবং দেখভাল করা তার কর্তব্য। সুশাসনই জনগণের মঙ্গল বয়ে আনে। এবং এটাই কাম্য। 

অধিকারহারা পরাধীন জাতির মতো জনগণ যেন শোষিত-নিপীড়িত-নিগৃহীত না হয়। স্বাধীন জাতিসত্তার বৈশিষ্ট্য কী হওয়া উচিত, তা ভেবে দেখা দরকার। সামষ্টিকভাবে ভালো হওয়ার আদর্শ স্বাধীন-সার্বভৌম দেশে থাকা চাই। তার চর্চা হওয়া জরুরি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের স্বস্তিদায়ক বৈষম্যহীন মুক্তির কথা বলেছেন। জনগণই তো দেশ। জনগণের মনের আকাশ যত স্বচ্ছ সুন্দর থাকবে, দেশ তত ভালো হবে। গণ-পরিবহনের সীমাহীন নৈরাজ্যকর বেপরোয়া যান্ত্রিকতায় স্বাধীনতার সুফল জনগণ পাচ্ছে না। এদের কাছে মানুষ জিম্মি। মনুষ্যত্বহীন নষ্ট আবহের বিষবাষ্পে মানুষ  অতিষ্ঠ। 

উল্লেখ্য, রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, যারা অনৈতিক-অন্যায় অনেক কাজ করে থাকে, যা সমাজের জন্য হিতকর নয়। তারা নিয়ন্ত্রণহীন বেপরোয়া স্বাধীন, তারা অন্যের অধিকার হরণ করে স্বাধীন দেশের মর্যাদা নষ্ট করে। এই যে শত শত অনিবন্ধিত হাসপাতাল-ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার ভুল চিকিৎসা দিয়ে কত জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে, কত জনকে নিঃস্ব করে ছেড়েছে। নিজেরা তো বেশ কলাগাছ বনে গেছে। যাদের অন্যায় জালে কত কত মানুষ সর্বস্বান্ত হয়েছে, তাদের কী হবে? এত অসভ্যতা কী এই দেশের কালচারে রূপ নিল? এখানে একটু অন্য প্রসঙ্গে গেলাম এই কারণে যে, সর্বক্ষেত্রেই তো দেখি আমাদের অসভ্যতার অজ¯্র উদাহরণ বিদ্যমান। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের দুঃখ ছিল বঙ্গজননীর ওপর। তিনি এদেশের মানুষ সম্পর্কে তাকে বলেছিলেন, ‘রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করোনি।’ 

প্রশ্ন হলো, একজন পরিবহন মালিকের কত টাকা প্রয়োজন? অসম সঞ্চয়ের উদগ্র নেশা তো তার মাথায় জেকে বসে আছে। গাড়ির সংখ্যা তো তার বছর বছর বাড়তেই থাকে, কমে তো না। প্রতিদিনের গাড়িভাড়া থেকে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা সে পেয়ে থাকে। এর পরে যা ভাড়া ওঠে, তা কর্মচারীদের। কর্মচারীরা বেতনভুক্ত নয়। মালিকের তৈরি নিয়মে ওরা চলে। মালিকের টাকার পরে ওরা টাকা বাড়াতে মরিয়া হয়ে ওঠে। নানা অজুহাতে বেশি ভাড়া আদায়ের কৌশল গ্রহণ করে। বিশেষ করে নারী ও সাধারণ যাত্রীরা ওদের শিকারে পরিণত হয়। এদের কাছে যা ভাড়া চায়, তা-ই ওরা পেয়ে থাকে। যেসব যাত্রী ভাড়া সম্পর্কে একটু সচেতন তাদের সঙ্গে তুমুল ঝগড়া লেগে যায়। পরিবহনের যাত্রাকালে প্রতিদিন মারামারি-ধরাধরি-গালাগালি তো লেগেই থাকে। ‘আরো পাঁচ টাকা আরো দশ টাকা’ করে আরো বেশি টাকা নিয়ে নেয় ওরা। অনেকে দিয়েও দেয় এবং এ-ও বলে দেয় ‘হরিলুটের রাজত্ব তোমাদের, কেউ দেখার নাই।’ 

ঝগড়া-বিবাদের জেরে কোনো কোনো যাত্রীকে ওরা গাড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। মেরে ফেলে। এরকম দৃষ্টান্তও আছে। এর পরে আছে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো। আছে মস্তিষ্কের সূক্ষ্ম স্নায়ুকোষ ও শ্রবণশক্তি ধ্বংসের হাইড্রলিক হর্ন। আছে গাদাগাদি যাত্রী। আছে পাল্লাপাল্লি, কার আগে কে যাবে। সামনের যাত্রী ধরার প্রতিযোগিতা। অশিক্ষিত কা­জ্ঞানহীন মাদকাসক্ত বেপরোয়া এমন অনেক ড্রাইভার গাড়ি চালায়। দুর্ঘটনা ঘটায়। যে কারণে প্রতিদিন দুর্ঘটনা, প্রতিদিন মৃত্যু। পরিবহনের নিরাপদ স্বস্তিদায়ক যাত্রা-ই মানুষের নিরন্তর চাওয়া। স্বস্তিহীন শঙ্কার মধ্যে মানুষ চলাচল করতে চায় না।

এত সব কারণের মূলে আছে, ভালো বোধসম্পন্ন মানুষের এখানে অভাব। ইলিয়াস কাঞ্চনের ‘একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না’ কতটা আবেগাপ্লুত তা বোঝা যায়। 
আমাদের পরিবহন সেক্টরে জনকল্যাণের কোনো ভালো দৃষ্টান্ত কি আছে? আমি বলব, নাই। আছে উলটোটা। ঈদে ঘরে ফেরা মানুষের কী ভোগান্তি, তা সবাই অবগত। পৃথিবীর অনেক দেশে উৎসব-পালা-পার্বণে  জনসম্পৃক্ত বস্তুনিচয়ের দাম কমে যায়। আর আমাদের এখানে বেড়ে যায়। সত্যি কী বিবেচনাহীন এই দেশ। করোনাকালে পশ্চিমবঙ্গে পরিবহনের ভাড়া কমে গেল আর আমাদের গেল বেড়ে। ভালোমন্দের পার্থক্যটা এখানে জ্বাজল্যমান।

এর আগে সরকার সিটিং সার্ভিস বন্ধ করে দিয়ে ঠিক কাজটিই করেছিল। পরিণামে কী হলো, পরিবহন মালিকদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। তারা গাড়ি বন্ধ করে দিল। যাত্রী-সাধারণের পক্ষে সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তা আর থাকল না। মালিকরা তাদের আধিপত্যে বগল বাজাল। তাদের চিটিংবাজি বহাল-তবিয়তে রয়ে গেল। বেশ কটি সংস্থার বাস ‘সিটিং সার্ভিস’ নামে চালু হয়েছিল। ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছিল। তা শুধু নামেই ছিল। গাদাগাদি করে যাত্রী তোলা এবং বেশি ভাড়া আদায় শুরু থেকে এখনো চালু আছে। তাদের লুটপাটের আরো একটি অপকৌশল সড়কে চেক পোস্ট বসানো। এতে ওদের টাকার থলিটা আরো ভারি হচ্ছে।  

কিছু উদগ্র ভোগবাদী মালিকদের ইচ্ছায় যদি জনসম্পৃক্ত পরিবহনগুলো এভাবে চলতে থাকে, মানুষের শারীরিক-মানসিক সুস্থতা বিনষ্ট করতে থাকে, আচার-ব্যবহারে যদি প্রতিদিন মনকষাকষি-ঝগড়া-সংস্কৃতির চর্চা বহাল থাকে, তাহলে সুস্থ-সুসভ্য জাতি হিসেবে আমরা কবে পরিচিতি পাব?

লেখক: কবি ও সাংবাদিক

ইত্তেফাক/জেডএইচডি

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন