থামানো যায়নি ইউক্রেন যুদ্ধ। বিপুল ক্ষয়ক্ষতি-প্রাণহানি ঘটিয়ে এগিয়ে চলেছে রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত। উত্তর-পূর্ব খারকিভ অঞ্চলে বেশ খানকিটা সামরিক অগ্রগতি লাভ করেছে ইউক্রেনের যোদ্ধারা। এই সাফল্যকে ‘টার্নিং পয়েন্ট’ হিসেবে দেখছে ইউক্রেন। উপরন্তু, এই অঞ্চল থেকে রুশ সেনাদের পিছু হটাকে ‘যুদ্ধে জয়লাভের লক্ষণ’ হিসেবে বিবেচনা করছে কিয়েভ। রাশিয়া অধিকৃত বেশ কিছু অঞ্চল ‘দখলমুক্ত’ হওয়ার ফলে ভলোদিমির জেলনস্কির ইউক্রেন মুচকি হাসছে বটে; কিন্তু এই ‘আপাত সাফল্য’ চিন্তার ভাঁজ ফেলছে পশ্চিমা শক্তির কপালে। যুদ্ধে ইউক্রেনের সাফল্যে স্বভাবতই পশ্চিম ও তার মিত্রদের হাস্যোজ্বল হওয়ার কথা, কিন্তু এক্ষেত্রে রয়েছে একটি ‘গভীর চিন্তার কারণ’। ইউক্রেনের এই ক্ষণিকের আংশিক সাফল্য পশ্চিমা গণতন্ত্রগুলোর মনে স্বস্তি এনে দিতে পারছে না এ কারণে যে, চলমান যুদ্ধ এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে, যখন ‘কঠিন বিপদ’ চোখ রাঙাচ্ছে!
ইউরোপসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ধারণা করছে, কোণঠাসা হওয়ার ফলে মরিয়া ভ্লাদিমির পুতিন পারমাণবিক, রাসায়নিক বা জৈবিক অস্ত্রের পথে হাঁটতে পারেন। পুতিন যদি সত্যি সত্যিই পারমাণবিক অস্ত্র হাতে তুলে নেন, তবে তা হবে বেশ উদ্বেগজনক। একই ধরনের শঙ্কার কথা বলছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁও। ইতিমধ্যে ম্যাক্রোঁ যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন, ইউক্রেনে আক্রমণ করে প্রেসিডেন্ট পুতিন যে ভয়ানক অপরাধ করেছেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই; কিন্তু তাকে ‘অবজ্ঞা-অপমান-তিরস্কার’ করাটা সময়োচিত হবে না কোনোমতেই। ম্যাক্রোঁর মতে, পুতিনকে অপদস্ত করে খেপিয়ে তুললে বেঁকে বসতে পারেন তিনি। এর ফলে তিনি হাত দিতে পারেন বিধ্বংসী অস্ত্রের ভান্ডারে!
যুদ্ধে ধরাশায়ী কিংবা তীব্র অবজ্ঞার শিকার হলে তা ‘নিরুপায় পুতিন’কে যে বৃহৎ ধ্বংসযজ্ঞের পথে চালিত করতে পারে—এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দিতে রাজি নন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও। এমন আশঙ্কাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন তিনি। এমন অবস্থায় আগেভাগেই পুতিনের উদ্দেশে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন বাইডেন। সম্প্রতি তিনি বলেছেন, ‘গণবিধ্বংসী অস্ত্রের (উইপনস অব মাস ডেস্ট্রাকশন—ডব্লিউএমডি) মাধ্যমে ইউক্রেনে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটানোর চেষ্টা করলে পুতিনকে গুনতে হবে বড় মাশুল। পারমাণবিক শক্তি প্রয়োগ করার চেষ্টা করলে পুতিনের বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে, তাতে করে পুরো যুদ্ধের চেহারাই বদলে যাবে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে যে শাস্তি আরোপ করা হবে, তা দেশটিকে বিশ্বে আরো বেশি একঘরে করে তুলবে।’
মনে রাখতে হবে, পুতিনকে বাইডেন হুঁশিয়ার করেছেন মাত্র, কিন্তু খোলাসা করে কিছুই বলেননি। এমনকি পুতিনের পারমাণবিক ক্রিয়ার বিপরীতে মার্কিন প্রতিক্রিয়া কী হবে, কিংবা সামরিক পদক্ষেপের প্রশ্নে ন্যাটোর ভূমিকা কী হবে—এসব বিষয় আড়ালেই রেখেছেন তিনি। আপাতত ‘অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া’ হবে বলেই ইঙ্গিত দিলেও বাস্তবে কী ঘটতে পারে তা কারো অজানা নয়। বস্তুত, এই মন্তব্যের দ্বারা তিনি ব্যক্তিগতভাবে রাশিয়ার নেতাকে ‘পারমাণবিক রাস্তা’ পরিহারের পরামর্শ দিয়েছেন। পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করলে পুতিন ও রাশিয়ার পরিণতি কী কঠিন-ভয়াবহ হতে পারে, তার রূপরেখা বর্ণনা করেছেন মাত্র।
বাস্তবিক অর্থে, ডব্লিউএমডি নিয়ে পুতিনের ওপর বাইডেনের নতুন করে ক্ষোভ প্রকাশের কারণ অজানা নয় কারো। ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোর মধ্য দিয়ে পুতিন পশ্চিমের জন্য যে ফাঁদ তৈরি করেছিলেন, তাতে বেশ ভালোমতোই ক্ষিপ্ত যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। লক্ষণীয় বিষয় হলো, রাশিয়ার পারমাণবিক বাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্কতায় রেখে এবং ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর নাকের ডগায় পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র তাক করার মাধ্যমে চতুর রাশিয়া ‘ফাঁদ’ পেতেছিল পশ্চিম ও তার মিত্রদের জন্য। ইউক্রেনে সামরিক আগ্রাসনের পর এবং পরে চোরনোবিল ও জাপোরিঝিয়া পারমাণবিক কেন্দ্রকে কবজা করে একগুঁয়ে চাপরাশি পুতিন ও দিমিত্রি মেদভেদেভ একটি খেলা খেলার চেষ্টা করছেন পশ্চিমের সঙ্গে! তারা আশা করেছিলেন, পারমাণবিক ঝুঁকি তৈরির মাধ্যমে কিয়েভের প্রতি পশ্চিমা সমর্থন বন্ধ কিংবা দুর্বল করা যাবে। ন্যাটোর সরাসরি হস্তক্ষেপকে রুখে দেওয়া যাবে। সর্বোপরি, ইউক্রেনে যুদ্ধ জয়ের সূচনার মাধ্যমে ‘লম্বা স্বপ্ন’ (রাশিয়ান সাম্রাজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা) বাস্তবায়নের পথ সুগম করা যাবে।
পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে বলতে হয়, রাশিয়ার কৌশল কিছুটা হলেও কাজ করেছে এখন পর্যন্ত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো শুরুর দিকে পুতিনের পাতা ফাঁদে পা দিয়েছিল যদিও, কিন্তু বুঝতে পেরে সেখান থেকে সরে এসে পালটা কৌশলের পথে হেঁটেছে। ইউক্রেনকে ক্রমাগত হারে কিংবা ক্রমবর্ধমান শক্তিসম্পন্ন অস্ত্র ও উপকরণ সরবরাহ করা থেকে পিছিয়ে এসেছে পশ্চিমারা। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা অস্ত্রের শক্তি, পরিসীমা এবং গুণমানকে সীমিত করে চলেছে, যাতে করে পুতিনের অবস্থান এতটা দুর্বল না হয় যে তিনি চরম পদক্ষেপের পথ ধরতে বাধ্য হন।
ন্যাটো এখন পর্যন্ত পর্যাপ্ত ট্যাংক, ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ও এয়ার কভার সরবরাহ করছে না ইউক্রেনীয় বাহিনীকে। মুক্ত এলাকাগুলো সুরক্ষিত করতে কিংবা রুশ অধিকৃত অঞ্চলগুলো মুক্ত করতে যে পরিমাণ এবং যে ক্ষমতাসম্পন্ন অস্ত্র-সরঞ্জাম দরকার, তা এখনো দেওয়া হয়নি জেলনস্কির হাতে। শুধু যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো নয়, জার্মানিসহ প্রায় প্রতিটি ইউরোপীয় দেশই অনুসরণ করছে ওয়াশিংটনের বাতলে দেওয়া পলিসি। এর বাস্তব প্রতিফলন হিসেবে দেখা গেছে, রাশিয়ান বাহিনীকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিতে কিয়েভ জার্মানির কাছে ‘লেপার্ড ট্যাংক’-এর আবেদন জানিয়ে এলেও তাতে সাড়া না দিয়ে বরং জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ সোলত্জ ইউক্রেনীয় ভূখণ্ড থেকে পুতিনকে সেনা প্রত্যাহারের পরামর্শ দিয়েছেন।
ভুলে গেলে চলবে না, পুতিনের ফাঁদে পা দিলে ইউরোপের সমূহ ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষত ইউরোপের অর্থনীতিতে নাভিশ্বাস তুলবে ক্রেমলিনের ‘পালটা ব্যবস্থা’। ব্যক্তিগত বাড়ি, দোকান কিংবা কারখানা থেকে শুরু করে জীবনযাত্রার প্রতিটি ক্ষেত্রে ইউরোপবাসী পড়বে চরম বিপাকে। পশ্চিমের নিষেধাজ্ঞার বিপরীতে রাশিয়ার পালটা ব্যবস্থার কারণে ইতিমধ্যে ইউরোপে বিস্ফোরণ ঘটেছে জ্বালানি খাতে—গ্যাস ও তেল ‘অনেকটা দুষ্প্রাপ্য’ হয়ে উঠেছে। ইইউ (ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন) রাজনীতিবিদদের মধ্যে যারা ভেবেছিলেন ‘পুতিনকে কোণঠাসা করতে পারলেই সমস্যা মিটে যাবে’, সেই চিন্তা থেকে সরে আসছেন তারা। নড়েচড়ে বসেছেন অনেকেই।
সম্প্রতি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে পুতিনের বৈঠক হয়েছে। যুদ্ধের ক্ষতিকর প্রভাবের বিষয়ে বিশ্বব্যাপী যা বলা হচ্ছে, তার সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন শিও। যদিও রাশিয়া-চীনের ‘সীমানাহীন বন্ধুত্ব’ অটুট রাখার বিষয়েও একমত পুতিন-শি। ১৯৪৫-পরবর্তী পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন নিয়মভিত্তিক আদেশকে হটিয়ে ইউক্রেন ও তাইওয়ান প্রস্তাবের প্রশ্নে সম্পূর্ণরূপে বদ্ধপরিকর শি-পুতিনের চীন-রাশিয়া।
এমতাবস্থায় বলতে হয়, ইউক্রেন যুদ্ধে জেলনস্কির আপাতত সাফল্যকে ‘টার্নিং পয়েন্ট’ হিসেবে ধরে নেওয়ার কোনোই অবকাশ নেই। কেননা, সেটি করলে তা হবে বড় বোকামি। তবে এটাও সত্য, পুতিন কী করতে পারেন, সেই ভয়ে রাশিয়ার ওপর চাপ প্রয়োগ শিথিল করার সময় এখন নয়। বরং আরো বেশি চাপ প্রয়োগের সময় এটি। কারণ, বাস্তবিক অর্থেই পুতিন এখন আটকা পড়েছেন গভীর খাঁদে। এখানে আটকে রেখেই তাকে শাস্তি দিতে হবে। তার কৃতকর্মের শাস্তি দিতে কঠিন পরিণতি থেকে রেহাই দেওয়া উচিত নয় কোনোমতেই। তবে এক্ষেত্রে পা ফেলতে হবে বুঝেশুনে। কেননা, এখনো ভয়ংকর চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। রাশিয়ার কাছে বহু ট্যাংক ও আর্টিলারি রয়েছে। এখনো ইউক্রেনের এক-পঞ্চমাংশ অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করছে রাশিয়ান বাহিনী। উপরন্তু ইউক্রেনে ১ লাখ ৩৭ হাজার অতিরিক্ত সৈন্য বাড়াচ্ছেন পুতিন।
কিন্তু এসব সত্ত্বেও বিশেষজ্ঞদের যুক্তি হলো—পুতিনকে ইউক্রেনের এক ইঞ্চি মাটিও দেওয়া ঠিক হবে না। তাকে দৌড়ের ওপর রাখতে হবে। তাকে বোঝাতে হবে যে, ফিরে আসা ছাড়া তার সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই। এবং এর ফলে আতঙ্কিত ও প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে পুতিন যদি ইউক্রেনে কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করার পথে হাঁটেন, তবে তার প্রতিক্রিয়া হবে ভয়াবহ কঠিন।
বাইডেনের উচিত হবে অবশ্যই ‘আনুষ্ঠানিকভাবে’ এ বিষয়ে পুতিনকে সতর্ক করে দেওয়া। পুতিনকে আগেই জানিয়ে দিতে হবে যে, পারমাণবিক আগ্রাসনের ওপর যে বৈশ্বিক নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, তার প্রতি তাকে সম্মান জানাতে হবে। তা না করে তিনি যদি তা ভঙ্গ করেন, তবে তার জন্য ব্যক্তিগতভাবে তাকে এবং রাশিয়াকে সমুচিত জবাব দেওয়া হবে। আন্তর্জাতিক নিরাপত্তাকে ক্ষুণ্ণ করে এমন যে কোনো আক্রমণকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো যুদ্ধের কারণ হিসেবে দেখে থাকে—এটি মাথায় রেখে চলতে হবে পুতিন ও রাশিয়াকে। অন্যথায়, পুতিনের ‘সামনের পথ’ হয়ে উঠবে ভয়ংকর। পুতিন জমানার শাসন পড়বে পতনের মুখে। এর চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে পুতিনের ‘নতুন করে রাশিয়ান সাম্রাজ্য সাজানোর কর্মপরিকল্পনা’ মুখ থুবড়ে পড়বে। সম্ভবত পশ্চিমা বিশ্ব ও তার মিত্ররা এসব বিষয় মাথায় রেখেই এগোচ্ছে। দিন শেষে যুদ্ধ-সংঘাত এড়িয়ে চলার নীতি গ্রহণ করাটাই কাম্য হবে সব পক্ষের জন্য। বৈশ্বিক শান্তি ও নিরাপত্তার স্বার্থে বিশ্বশক্তিগুলোর সুচিন্তিত পদক্ষেপই আজকের বিশ্বে বেশি করে জরুরি।
লেখক : সাংবাদিক
দ্য গার্ডিয়ান থেকে ভাষান্তর : সুমৃৎ খান সুজন