বৃহস্পতিবার, ০৮ জুন ২০২৩, ২৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

খরা-দাবদাহে রাজশাহী বরেন্দ্র অঞ্চলে পানিসংকট তীব্রতর

আপডেট : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৬:৩২

খরা, দাবদাহ ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে রাজশাহী বরেন্দ্র অঞ্চলে পানিসংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। অন্যদিকে পানিকে কেন্দ্র করে বরেন্দ্র অঞ্চলের সমাজ ব্যবস্থায় সহিংসতা আগের তুলনায় বেড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন এই অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী রেশম শিল্পের ওপরেও প্রভাব ফেলেছে। অতিরিক্ত তাপমাত্রা, তাপমাত্রার অস্বাভাবিক ওঠা নামায় রেশম শিল্পের কাঁচামাল পলু পোকা পালনেও সমস্যায় পড়ছেন চাষিরা। এতে বেড়েছে চাষিদের উৎপাদন খরচও। বরেন্দ্র অঞ্চলের অন্যতম ফসল লাক্ষা চাষেও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। 

গতকাল সোমবার ‘জলবায়ু পরিবর্তন ও বরেন্দ্র ভূমির নয়া সংকট বিষয়ক গবেষণা উপস্থাপন ও নীতি সংলাপ’ শীর্ষক সুধী সমাবেশে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। এদিন বেলা ১১টায় রাজশাহীর কাজলাস্থ হেরিটেজ আর্কাইভস বাংলাদেশ মিলনায়তনে উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক এবং বরেন্দ্র অঞ্চল জনসংগঠন সমন্বয় কমিটি এই সমাবেশের আয়োজন করে। সমাবেশে তাদের গবেষণার প্রাথমিক সারসংক্ষেপ ও সার্বিক বিবেচনায় বরেন্দ্র অঞ্চলের নানা সংকটের তথ্য উঠে এসেছে।

সম্প্রতি বারসিক স্থানীয় গবেষক, সাংবাদিক এবং সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বরেন্দ্র এলাকায় জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মাঠপর্যায়ে অনুসন্ধানমূলক সমীক্ষা করে। গতকালের সমাবেশে গবেষণার ফলাফলগুলো তুলে ধরা হয়। সমাবেশে স্থানীয় গবেষক, কৃষক, উন্নয়নকর্মী, শিক্ষক, তরুণ ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরাও অংশ নেন। 

গবেষকরা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব এবং সেই সঙ্গে মানুষ সৃষ্ট দুর্যোগগুলোও বরেন্দ্রের জনগণ এবং প্রাণবৈচিত্র্যের ক্ষতি ডেকে আনছে। অস্বাভাবিক এবং অনিয়ন্ত্রিত রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহারে জনস্বাস্থ্য হুমকিতে পড়েছে। কীটনাশকের ব্যবহারে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তারা  ন্যায্য ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে না। খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করতে সরকার প্রধান বারবার সকল ধরনের জমির ব্যবহার বৃদ্ধি করার কথা জানিয়েছে। গবেষণায় উঠে এসেছে, এই অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তন এবং স্থানীয়ভাবে আবহাওয়া ও খরার কারণে কিছু এলাকায় অনাবাদি জমির পরিমাণ বাড়ছে। আবার পানির অভাবে কৃষকের উৎপাদন খরচ বেড়েছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, খরাপ্রবণ এলাকাগুলোতে ৩০ শতাংশ জমি কোনো না কোনোভাবে অনাবাদি থেকে যাচ্ছে। এমনকি কোনো এলাকায় তারও বেশি পরিত্যক্ত জমি থেকে যাচ্ছে। একই সঙ্গে প্রান্তিক কৃষক জমি হারাচ্ছেন। সমীক্ষা এলাকায় ১০টি কেস স্টাডির মাধ্যমে দেখা যায়, ১৯৭১ সাল থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত গড়ে অন্তত ১০টি পরিবার তার ৭০ শতাংশ জমি হারিয়েছে।

গবেষকদের মতে, বরেন্দ্র অঞ্চলে যে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে তা অন্য অঞ্চলের তুলনায় অনেক বেশি। আবহাওয়া অফিসের তথ্যানুযায়ী, এই অঞ্চলে প্রতি বছর গড়ে ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বাড়ছে। তীব্র তাপদাহ এবং অনাবৃষ্টি বেড়ে যাচ্ছে। এর ফলে মানুষ নানামুখী ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। প্রান্তিক এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ তাদের জীবন জীবিকা হারাচ্ছেন। জীবন জীবিকার তাগিদে স্থানান্তরিত হচ্ছে মানুষ।

সমাবেশে মূলপ্রবন্ধে বলা হয়েছে, বরেন্দ্র অঞ্চলটি প্রাণবৈচিত্র্য ও বহুসংস্কৃতির বৈভবে একটি অনন্য ঐতিহ্যবাহী আদিভূমি। এখানে রয়েছে নানা জাতিগোষ্ঠীর বসবাস এবং প্রাণ ও প্রকৃতির সহাবস্থান। কিন্তু দিনে দিনে বৈশ্বিক জলবায়ুর আঞ্চলিক অভিঘাত এবং মনুষ্যসৃষ্টসহ নানা কারণে প্রাণবৈচিত্র্য ও সংস্কৃতির বৈচিত্র্য কমে যাচ্ছে। বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য, উঁচু-নিচু ভূমি, মাঠ, খাল-খাড়ি, বিল, নদ-নদী, পুকুর, প্রাকৃতিক জলাধার, বন আজ অনেকটাই হুমকির মুখে। এ বিষয়গুলোর ওপর নির্ভরশীল মানুষসহ বিভিন্ন প্রাণ ও সংস্কৃতিও হুমকির মুখে। প্রাণ ও প্রকৃতির পরস্পর নির্ভরশীলতা কমে যাওয়ায় দিনে দিনে সহিংসতা বাড়ছে।

ইত্তেফাক/ইআ