আন্তর্জাতিক সম্পর্কের হাত ধরিয়া ‘ব্যালেন্স অব পাওয়ার’, ‘রেসপনসিবিলিটি টু প্রটেক্ট’, ‘পিসফুল সেটেলমেন্ট অব ডিসপুটস’-এর মতো যেই সকল থিওরি বিশ্বব্যবস্থায় আলো ছড়াইয়াছিল, তাহা আজ বিবর্ণ, অকার্যকর হইয়া উঠিয়াছে। যুদ্ধের দামামায় কাঁপিতেছে পুরা বিশ্ব। পাওয়ার পলিটিকসের দৌরাত্ম্যে নড়বড়ে হইয়া উঠিয়াছে বিশ্বশান্তি। বৈশ্বিক অস্থিরতার জাঁতাকলে পড়িয়া নিরুপায় মানবসমাজ পড়িয়াছে একপ্রকার ‘জিম্মি দশায়’। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সূত্র ধরিয়া হিসাব কষিলে দেখিতে পাওয়া যায়, ‘শক্তির ভারসাম্য’ বিঘ্নিত হইয়া পড়িলে বিশ্বব্যবস্থায় অস্থিরতা তৈরি হইতে বাধ্য। বাস্তবিক অর্থেই এই তত্ত্বের চরম অভিঘাত পরিলক্ষিত হইতেছে আজিকার বিশ্বে। বিশ্বে যুদ্ধ চলিতেছে; শাখা-প্রশাখা মেলিতেছে নূতন নূতন সহিংসতা। ভূরাজনৈতিক হিসাবনিকাশ কড়ায় গন্ডায় চুকাইয়া লইতে ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছে বিবদমান শক্তিগুলি। বসিয়া নাই বিভিন্ন ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাক্টর’—আড়াল হইতে কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে সম্মুখে বসিয়াই রসদ জোগাইতেছে।
এই বছরের শুরুর দিকে ইউক্রেনের মাটিতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যখন বোমা ফেলিয়াছিলেন, তখনই বুঝা গিয়াছিল বিশ্বের জন্য অপেক্ষা করিতেছে ‘চরম অশনিসংকেত’। অর্ধবার্ষিক পার হইলেও এই সংঘাতের যবনিকা পতন ঘটানো যায় নাই। বরং ইউক্রেনে সৈন্য বাড়াইতে মরিয়া পুতিন নূতন নূতন কৌশল খাটাইতেছেন—অধিকৃত অঞ্চলে গণভোটের আয়োজন করিতে উদ্যত হইয়াছেন। প্রকৃত অর্থেই পুতিনের এই আয়োজন ইউক্রেনে সংঘাত বন্ধ করিবার পরিবর্তে ইহাকে প্রলম্বিত করিবে। যুদ্ধকে প্রকট হইতে প্রকটতর করিয়া তুলিবে—বারুদের উত্কট গন্ধের নিচে চাপা পড়িয়া ধুঁকিতে থাকা বিপর্যস্ত মানুষকে নিক্ষেপ করিবে আগুনভর্তি উত্তপ্ত কড়াইয়ের মধ্যে। ‘ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্য দিয়া বিশ্ব তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ-যুগে প্রবেশ করিল’ বলিয়া সতর্ক করিয়াছিলেন বিশেষজ্ঞরা। প্রকৃতপক্ষেই বিশ্ব যেন রণভূমিতে পরিণত হইয়া উঠিয়াছে! সংঘর্ষে জড়াইয়া পড়িয়াছে আজারবাইজান-আর্মেনিয়া। সহিংসতা ছড়াইয়াছে কিরগিজস্তান-তাজিকিস্তানে। উত্তেজনার তাপ বহিতেছে আরো অনেক অঞ্চলেই। বৈরী ভাবাপন্ন দেশগুলি পরস্পরের সীমান্তের দিকে তাক করিয়া রাখিয়াছে মারণাস্ত্র। বলিতেই হয়, এই সকল অবস্থার মধ্যে পড়িয়া কাহিল হইয়া পড়িয়াছে বিশ্ব অর্থনীতি। উৎপাদন বাণিজ্য শ্লথ হইয়া যাইবার কারণে মন্দার ঝুঁকিতে পড়িয়াছে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশ। দুঃখজনক বিষয় হইল, বৃহৎ শক্তিগুলির শক্তি প্রদর্শনের দ্বন্দ্বের মধ্যভাগে পড়িয়া নাকাল হইতেছে ছোট দেশগুলি। মেরুকেন্দ্রিক রাজনীতি এবং দ্বিপক্ষীয়-বহুপক্ষীয় নানা সমীকরণের কঠিন ধাঁধায় পড়িয়া ঘরে-বাহিরে অস্থিরতার মুখে পড়িতে হইতেছে উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলিকে। সকল কিছু মিলিয়া বৃহৎ শক্তিগুলির ‘মাইট ইজ রাইট’ মনোভাবের কারণে বিশ্বের অবস্থা এখন—‘যুদ্ধই জীবন, যুদ্ধই সর্বজনীন’।
ইউক্রেন-সংকট ও বৈশ্বিক সংঘাত প্রতিনিয়ত যেই দিকে বাঁক লইতেছে, তাহাতে ইহার চূড়ান্ত পরিণতি লইয়া ভাবিতে গেলেও শিহরিত হইতে হয়! কেননা, এই যুদ্ধে ‘পারমাণবিক’ যুক্ত হইতে পারে বলিয়া আশঙ্কা করা হইতেছে! কৌশল না খাটিলে কিংবা চরমভাবে ধরাশায়ী হইলে পারমাণবিক অস্ত্রের পথে পা বাড়াইতে পারেন পুতিন। সেই অবস্থায় স্বভাবতই হাত গুটাইয়া বসিয়া থাকিবে না অন্য শক্তিগুলি। পারমাণবিক হামলার পথে হাঁটিলে পুতিনের বিরুদ্ধে যেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে, তাহাতে পুরা যুদ্ধের চেহারাই পরিবর্তন হইয়া যাইবে বলিয়া হুংকার দিয়াছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। অর্থাৎ, ‘বাড়াবাড়ি’ যে কীরূপ ভয়াবহতা ডাকিয়া আনিতে পারে, তাহা বিশ্ব ভালো করিয়াই জানে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রেশ ধরিয়া ‘ফ্যাট ম্যান’ ও ‘লিটল বয়’ যেই ধ্বংসযজ্ঞ ডাকিয়া আনিয়াছিল, সেই স্মৃতি পৃথিবী ভোলে নাই। কাজেই আরেকটি পারমাণবিক আঘাত কিংবা পালটা আঘাত এই বিশ্বকে কোথায় লইয়া যাইবে, তাহা চিন্তারও বাহিরে! সত্যিকার অর্থে, পারমাণবিক অস্ত্র যতটা ব্যবহারের জন্য, তাহার চাইতে উহা মূলত একটি দেশের আত্মশক্তি বৃদ্ধির জন্য। অর্থাৎ, আগুন লইয়া খেলিলে হাত পুড়িবেই। স্মরণে রাখিতে হইবে, পৃথিবী চলে সত্যর উপরে, স্বাভাবিক নিয়মে; ইহার ব্যত্যয় ঘটাইবার চেষ্টা করিলেই ‘মহাসর্বনাশ’ অনিবার্য। করোনা মহমারির পর যেইখানে পৃথিবীকে সুন্দর করিয়া গড়িতে আত্মনিয়োগ করিবার কথা, সেইখানে ক্ষমতা-আধিপত্য বিস্তারের রঙিন খেলায় মাতিয়া উঠিয়াছে বিশ্বনেতৃত্ব। এই অবস্থায়, যেহেতু সংঘাত তো শেষ হইতেই হইবে, বিশ্বনেতৃত্বকে ভাবিতে হইবে কোন পথে হাঁটিবেন—ধ্বংসযজ্ঞের, নাকি বিশ্বশান্তির?