শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ফুটবলে সফলতার আকাঙ্ক্ষা এবং বাস্তবতা

আপডেট : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০০:৪৫

বাঙালি জাতির আনন্দের উপলক্ষ্য খুব কমই আসে। এবার বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের ঐতিহাসিক সাফ টুর্নামেন্ট জেতার পর অনেক দিন পর আমরা আনন্দের একটি উপলক্ষ্য পেলাম। ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সারা দেশের মানুষ যেভাবে এই দলটিকে সংবর্ধিত করেছে, তাতে একটি কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়—এই প্রেরণা থেকেই দেশের ফুটবল এগিয়ে যাবে। এই প্রথম একটি সাফল্যে খেলোয়াড়, সংগঠক, দর্শকসহ সারা জাতি একসঙ্গে আনন্দ করেছে। ফুটবল যে বাংলাদেশের প্রাণের খেলা, তা এই ঘটনায় প্রতীয়মান হয়েছে। এ ধরনের ফলাফল কোনো দিনও রাতারাতি আসে না। এর পেছনে রয়েছে কিছু মানুষের ঐকান্তিক ইচ্ছা, অক্লান্ত শ্রম এবং খেলোয়াড়দের মনোনিবেশ। এ সাফল্য কারোর একারও নয়। একটা কথা আমাদের স্বীকার করতেই হবে যে, একটি দল যদি সাফল্যের ধারায় চলতে থাকে, তাহলে সেই দলকে ঘিরে মানুষের আকাঙ্ক্ষা আরো বেড়ে যায়। 

সাফল্যের ধারা ধরে রাখা কিংবা নতুন নতুন টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ান হওয়ার কাজটা কিন্তু একেবারে সহজ নয়। বিশেষ করে আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর পক্ষে এই ধারা ধরে রাখা কষ্টকর বইকি। আমাদের বাজেট স্বল্প, অবকাঠামো নড়বড়ে এবং খাদ্যাভ্যাস ও অন্যান্য কারণে খেলোয়াড়দের শারীরিক ফিটনেসের অভাব বিদ্যমান। ফুটবল এমন একটি খেলা, যেটি পুরোপুরি নির্ভর করে প্রশিক্ষণ, কোচিং, শারীরিক ফিটনেস ইত্যাদি বিষয়ের ওপর। আমাদের এখানে টেকনিক্যাল নো-হাউ নেই। আমরা যদি খেলোয়াড়দের ১০ বছর বয়স থেকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে একটি জায়গায় নিয়ে যেতে পারি, তাহলে দেখা যাবে ১৯ থেকে ২০ বছরের মধ্যে সে একজন পরিপূর্ণ খেলোয়াড়। কিন্তু আমাদের শুরুটাই হয় দেরিতে। নারী ফুটবল দল ভালো রেজাল্ট করার একমাত্র কারণ হচ্ছে তাদের ১৫ বছর বয়সের নিচ থেকে ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে। কঠোর নিয়মকানুন এবং অনুশীলনের মধ্যে ছিল তারা। আমরা আশা করেছিলাম ২০২৪ সালের মধ্যে আমরা এ ফলাফল পাব। কিন্তু দুই বছর আগেই রেজাল্ট পাওয়া গেছে। 

বাংলাদেশের ফুটবলের র‍্যাংকিং নিয়েও অনেকে কথা বলেন। এক্ষেত্রে একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ কয়টা আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলছে? অন্য দেশের তুলনায় আমাদের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার হার অনেক কম। র‍্যাংকিং বাড়াতে হলে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা ছাড়া কোনো উপায় নেই। আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলতে হলে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। ফিফা আমাদের যে অর্থ দেয়, সেটি একেবারেই সামান্য। আবার এ অর্থ খরচ করতে হলে অনেক কমপ্লায়েন্সের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এক খাতের অর্থ অন্য খাতে খরচের সুযোগ নেই। এর বাইরে ফেডারেশন স্পনসর খাত থেকে কিছু অর্থ পায়। তার পরিমাণও খুব বেশি নয়। একটি বিষয় সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে যে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে খেলোয়াড় তৈরি হয় ক্লাবগুলো দিয়ে। কোনো দেশের ফুটবল ফেডারেশন একাডেমি তৈরি করে না। এসব দায়িত্ব হলো ক্লাবগুলোর। বাংলাদেশের দুই-একটি ক্লাব ছাড়া অন্যদের তেমন সুযোগ-সুবিধা নেই। এর মধ্যে আবার কিছুকাল আগের ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের সময় কিছু ক্লাবের দরজায় তালা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা মনে করি, যারা দোষী, তাদের শাস্তি দেওয়া হোক। কিন্তু ক্লাবের তালাগুলো খুলে দিয়ে তাদের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে ফিরিয়ে নিতে হবে। 
আরেকটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। তা হচ্ছে—বিদেশি কিছু খেলোয়াড়কে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া। বিশ্বের অনেক দেশ এটি করে থাকে। শুধু খেলোয়াড় নয়, কিছু কোচিং স্টাফকেও এখানে নাগরিকত্ব দিতে হবে। বিদেশি খেলোয়াড় এবং কোচিং স্টাফের সমন্বয়ে দেশীয় ফুটবলাররা নানা কিছু শিখবে। 

বিদেশি কোচিং স্টাফ এবং খেলোয়াড়দের সমন্বয়ে দল গঠন করার পাঁচ বছর পর অদূর ভবিষ্যতে সফলতা অবশ্যই আসবে। এক্ষেত্রে ফ্রান্সের বিশ্বকাপ জয়ী ফুটবলার ক্রিশ্চিয়ান ক্যারেমব্যুর উক্তি এখানে প্রণিধানযোগ্য। কয়েক মাস আগে বাংলাদেশে ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপ ট্রফির সঙ্গে তিনিও এসেছিলেন। অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেছিলেন, আমি যখন ফ্রান্স টিমে যোগ দিই, তখন দেখলাম পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। সেখানে এমন কিছু শেখানো হয়, যা আগে কোনোদিন শুনিনি বা দেখিনি। 

এসবের মধ্য দিয়ে একেবারেই যে কাজের কাজ কিছু হয়নি—সে কথাও বলা যাবে না। যেমন ফুটবল খেলোয়াড়দের প্রশিক্ষণের জন্য যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজন—তা এতদিন ছিল না। এজন্য বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) এলিট একাডেমি তৈরি করেছে। রাজধানীর কমলাপুর স্টেডিয়ামে এ একাডেমিতে ৪২ জন ফুটবলারকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এদের সবার বয়স ১৭ বছরের নিচে। সম্পূর্ণ আবাসিক সুবিধাসংবলিত এ একাডেমিতে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে। সারা দেশের ৬৪ জেলা থেকে খেলোয়াড় নির্বাচন করেন কোচরা। এখানে এলে তাদের খাওয়াদাওয়াসহ সবকিছু একাডেমি বহন করে। ইতিমধ্যে আমরা ফল পেতে শুরু করেছি। ফুটবলারদের দক্ষতা বাড়ছে। একাডেমির খেলোয়াড়রা শুধু জাতীয় দল নয়, বিভিন্ন লীগের খেলায়ও অংশ নেবেন। ঘরোয়া ফুটবলের নামকরা দলগুলো তাদের অর্থের বিনিময়ে নেবে। এর আগেও দেশের নামকরা দলগুলো অর্থের বিনিময়ে বাফুফে একাডেমি থেকে ফুটবলার নিয়েছে। এবারও ক্লাবগুলো তাদের চাহিদাপত্র দিয়েছে। এই একাডেমি সূচারুভাবে চললে আশা করা যায়, একসময় এখান থেকে বিশ্বমানের ফুটবলার তৈরি হবে এবং তারা দেশের ফুটবলের মানোন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। 

সরকার ফুটবলের উন্নয়নের জন্য আন্তরিক। কিন্তু বিষয়টিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য অতীতে সরকারের কাছে প্রস্তাব দেওয়া হয়নি। এবার বাফুফে থেকে প্রস্তাব যাওয়ার পর সেটিই গ্রহণ করেছে সরকার। এবার প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। প্রকল্পের নাম দেওয়া হয়েছে ‘বাংলাদেশ ফুটবলের পুনর্জাগরণসহ শক্তিশালী জাতীয় ফুটবল দল গঠনের লক্ষ্যে বছরব্যাপী ফুটবল প্রতিযোগিতাসমূহ আয়োজন, প্রশিক্ষণ প্রদান এবং বাফুফে শক্তিশালীকরণ।’ পাঁচ বছর মেয়াদি এ প্রকল্পের পুরো অর্থই ব্যয় করবে সরকার। এটি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের ফুটবল অনন্য উচ্চতায় যাবে। এ প্রকল্পের আওতায় বাফুফে প্রতি বছর ১১টি পেশাদার ফুটবল লিগ আয়োজন করবে। বাংলাদেশ ফুটবল দলের জন্য প্রশিক্ষণ ক্যাম্পসহ ১৫টি বিদেশি প্র্যাকটিস ম্যাচ আয়োজন করা হবে। প্রকল্পের অর্থ দিয়ে দেশের তিনটি জনপ্রিয় স্থানে তিনটি ফুটবল একাডেমি নির্মাণ করা হবে। নতুন প্রকল্পে নারী ফুটবলের উন্নয়নের জন্যও পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবলের প্রশিক্ষণে একটি ক্যাম্প স্থাপন করা হবে। বিদেশে প্রতি বছর নারী ফুটবলারদের জন্য পাঁচটি প্র্যাকটিস ম্যাচ আয়োজন করা ছাড়াও প্রতিভাবান খেলোয়াড় তৈরির উদ্দেশ্যে তিনটি নারী ফুটবল লিগের আয়োজনের ব্যবস্থা আছে প্রকল্পে। এছাড়া এ প্রকল্পে আটটি বিভাগে ৬৪টি জেলা ভিত্তিক ফুটবল প্রতিযোগিতার আয়োজন এবং বিভাগ ও জেলাভিত্তিক প্রতিভা অন্বেষণ ও তিনটি বয়সভিত্তিক প্রশিক্ষণ ক্যাম্প আয়োজন করা হবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে ফিফা র‍্যাংকিংয়ে বাংলাদেশ উন্নতি করবে। 

শুধু বাংলাদেশ সরকার নয়, ফুটবলের আন্তর্জাতিক সংস্থা ফিফাও বাংলাদেশের ফুটবলের উন্নতির জন্য কাজ করছে। ফিফার টেকনিক্যাল সেন্টার (সেন্টার অব এক্সিলেন্স) তৈরির জন্য ২০ একর জমি ইতিমধ্যে হস্তান্তর করা হয়েছে। অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা থাকবে কক্সবাজারের এই টেকনিক্যাল সেন্টারে। এটা সেন্টার অব এক্সিলেন্স, এখানে জিমনেসিয়াম, আবাসিক হল, দুইটি আর্টিফিশিয়াল টার্ফ এবং একাধিক ঘাসের মাঠ থাকবে। বাংলাদেশ সরকার এত অল্প সময়ে সরকারি জমি দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছা, উনি অত্যন্ত ক্রীড়ামোদী। সব সময় প্রধানমন্ত্রী ফুটবলের পাশে থেকেছেন। স্থায়ীভাবে বিনা মূল্যে জমি দিয়েছেন। ফুটবলের উন্নয়নে এটি অনেক বড় পদক্ষেপ। 


সর্বোপরি বলা যায়, সাফ নারী ফুটবলের শিরোপা জেতার পর তা গণমাধ্যমে যেভাবে প্রচার করা হয়েছে, তাতে আমরা আশাবাদী। গণমাধ্যমের প্রচারের কারণেই নারী দলটিকে সংবর্ধনা দিতে রাস্তায় মানুষের ঢল নেমেছিল। গণমাধ্যম যদি ইতিবাচক থাকে, তাহলে বাংলাদেশের ফুটবল এগিয়ে যাওয়ার পথ আরো সহজ হবে। 
লেখক : সহসভাপতি, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)

ইত্তেফাক/ইআ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন