‘বাংলাদেশের নদী মাঠ বেথুই বনের ধারে, পাঠিও বিধি আমায় বারে বারে’
সুপ্রাচীনকাল থেকে মানুষ বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে আসছে। পৃথিবী দেখার এই দুর্নিবার নেশায় মানুষের সাতসমুদ্র তের নদী পাড়ি দিয়ে অচিন ও অজানা দেশে পৌঁছেছে। মানুষের এই ভ্রমণাকাঙ্ক্ষা থেকেই পর্যটনের উৎপত্তি। সভ্যতা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে পর্যটনের কাজের ধরন ও সেবার মানে এসেছে অনেক পরিবর্তন। পর্যটন এখন শুধু কোনো ব্যক্তি বা ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর দেশভ্রমণ নয় বরং সমগ্র মানবগোষ্ঠীর জন্য একটি বিশ্বজনীন শখ ও নেশা। পর্যটন এখন একটি শিল্পে পরিণত হয়েছে, যা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতির মুখ্য উপাদান।
সারা বিশ্বে ২৭ সেপ্টেম্বর বিশ্ব পর্যটন দিবস পালিত হয়। জাতিসংঘের অধীনস্থ বিশ্ব পর্যটন সংস্থার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ১৯৮০ সাল থেকে সব সদস্য দেশে এটি পালিত হয়ে আসছে। দিবসটির প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও পর্যটনকেন্দ্রের সঙ্গে সেতুবন্ধ গড়ে তোলা। এছাড়াও, পর্যটনের ভূমিকা সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধিসহ সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উপযোগিতাকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া এই দিবসের অন্যতম লক্ষ্য। গত দুই দশকে আন্তর্জাতিক উন্নয়নবিষয়ক আলোচনায় দরিদ্রবান্ধব প্রবৃদ্ধির পরিবর্তে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির ধারণাটি বেশি উচ্চারিত হচ্ছে। কারণ, এটি ছাড়া কোনো দেশই তাৎপর্য আয় প্রবৃদ্ধি এবং দারিদ্র্য হ্রাস করতে সক্ষম হয়নি। বৈষম্য দূর করে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করাই হলো অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির মূলকথা।
২০১৯ সালে বিশ্ব পর্যটন দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে পর্যটন’, ২০২০ সালে বিশ্বপর্যটন দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘পর্যটন ও গ্রামীণ উন্নয়ন’, ২০২১ সালে বিশ্বপর্যটন দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধিতে পর্যটন’ এবং ২০২২ সালে বিশ্ব পর্যটন দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘জবঃযরহশরহম ঞড়ঁত্রংস’।
এ বছর ২০২২ সালের বিশ্ব পর্যটন দিবস উদযাপনের জন্য বিশ্ব পর্যটন সংস্থা ইন্দোনেশিয়াকে অফিশিয়াল আয়োজনের জন্য দায়িত্ব প্রদান করেছেন এবং ইন্দোনেশিয়ার বালিতে অনুষ্ঠিত হবে। এ বছর বিশ্ব পর্যটন দিবসের মূল ফোকাস হলো—কীভাবে অধিকতর টেকসই, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও পর্যটনশিল্পে করোনা ভাইরাস সংকট পরবর্তী সংকট থেকে দ্রুত উত্তরণের জন্য সঠিক কর্মপন্থা নির্ধারণ, কর্মসম্পাদনের গাইড লাইন প্রস্তুতকরণ। পর্যটনশিল্পে সংকট উত্তরণে বিকল্প কর্মপন্থা নির্ধারণের মধ্যে দিয়ে পর্যটনসংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের মনে আস্থা তৈরি করে, তাদের উদ্দীপিত করে নিউ নরমাল আবহে খাপ খাওয়ানোর মধ্য দিয়ে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব। এখানে উল্লেখ্য যে, ‘Rethinking Tourism’ পর্যটনশিল্পে সৃজনশীলতাকে অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। অন্যদিকে করোনা মহামারি পর্যটনশিল্পে সংকট মোকাবিলা ও সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে সম্মিলিত উন্নয়ন নিশ্চিতকরণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। সম্মিলিত উন্নয়ন মূলত প্রাইভেট-পাবলিক স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত ও সমন্বয় করে উন্নয়ন।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-২০৩০ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে উন্নত দেশের ন্যায় বাংলাদেশও পর্যটনশিল্পের ওপর অধিক গুরুত্বারোপ করা এখন সময়ের দাবি। কারণ টেইসই উন্নয়নের ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে তিনটি প্রত্যক্ষভাবে পর্যটনশিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা-২০৩০ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ২০৪১ সালে পৌঁছে যাবে মধ্যম আয়ের দেশে।
২০১৯ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে পর্যটনের ভূমিকা ছিল ৮ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে ২০২১ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারে। ২০১৯ সালে বিশ্ব জিডিপিতে অবদান ছিল ১০ দশমিক ৩ শতাংশ। তবে মহামারির কারণে ২০২১ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ১ শতাংশে। ২০১৯ সালে এই সেক্টরে কর্মরত ছিল ৩৩০ মিলিয়ন মানুষ। তবে ২০২০ সালে ৬২ মিলিয়ন লোক চাকরি হারিয়েছিল এই সেক্টরে, যা মোট চাকরির ১৮ দশমিক ৬ শতাংশ। তবে ২০২১ সালে পর্যটনকেন্দ্রগুলো পুনরায় চালু হওয়ায় ১৮ দশমিক ২ মিলিয়ন মানুষ পুনরায় চাকরি ফিরে পায় বিধায় এখন ২৮৯ মিলিয়ন মানুষ এই সেক্টরে কর্মরত আছে। ২০২০ সালে অভ্যন্তরীণ পর্যটক ৪৭ দশমিক ৪ শতাংশ পুনরায় বৃদ্ধি পেয়েছে।
কোভিড-১৯-এ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পর্যটনশিল্পে। কোভিড-১৯ মহামারির সংকট কাটিয়ে অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য যে পাঁচটি সেক্টরকে গুরুত্বারোপ করছেন তার মধ্যে পর্যটন উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-২০৩০ বাস্তবায়নে অন্যতম ভূমিকা রাখবে পর্যটনশিল্প। টেকসই উন্নয়ন বাস্তবায়নের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক পর্যটন, সমবায় পর্যটন, গ্রামীণ পর্যটন, সুনীল পর্যটন, কমিউনিটি বেইজড ট্যুরিজম ও ভার্চুয়াল ট্যুরিজম উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে।
‘অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধিতে পর্যটন’। একটি অর্থনৈতিক উন্নয়ন ধারণা, যেখানে সমাজের সবাই তার নিজ নিজ জায়গা থেকে উন্নয়নের ন্যায্য সুযোগ পাওয়ার মাধ্যমে স্থানীয় ও সামগ্রিক পর্যায়ের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখবে। উদাহরণস্বরূপ একটি দেশের মোট উন্নয়ন অন্য দেশের চেয়ে বেশি; কিন্তু এক্ষেত্রে নিম্নবিত্তের অবস্থার উন্নয়ন ঘটছে না, তাই এখানে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলেও সমন্বিত অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটেনি। সমন্বিত অর্থনৈতিক উন্নয়ন একটি সমাজকে টেকসই উন্নয়নের দিকে ধাবিত করে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-২০৩০ বাস্তবায়নের জন্য উন্নত বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও পর্যটনশিল্পের ওপর অধিক গুরুত্বারোপ করা প্রয়োজন। কারণ টেকসই উন্নয়নের ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে তিনটি সরাসরি পর্যটনশিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
পর্যটকরা এখন গ্রামমুখী। গ্রামের নান্দনিক সৌন্দর্য দেশি ও বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করে গ্রামীণ সমাজব্যবস্থা, চাষাবাদ, লোকসংগীত, গ্রামীণ জীবনধারা, সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলার গ্রামবাংলার, জীববৈচিত্র্য ও সবুজের সমারোহ। সমবায়ভিত্তিক পর্যটন উন্নয়নের মাধ্যমে সমাজের আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর আর্থিক সচ্ছলতার পাশাপাশি স্থায়ী উপার্জনের পথ সুগম হবে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-২০৩০ অর্জনের জন্য বিশ্বের উন্নত দেশসমূহ গ্রামীণ পর্যটন উন্নয়ন, সমবায় পর্যটন উন্নয়ন ধারণার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
পর্যটন একটি শ্রমঘনশিল্প। তাই অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধিতে এই শিল্প অনন্য ভূমিকা পালন করছে। পর্যটনকে বিশ্বমানে উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে। যার মধ্যে পর্যটন নগরী কক্সবাজার অন্যতম। যা করে পর্যটকদের জন্য আন্তর্জাতিকমানের সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি হবে এবং বাড়বে কর্মসংস্থান। সরকারি উদ্যোগে মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে বদলে যাবে বাংলাদেশের অবকাঠামো ও যোগাযোগব্যবস্থা। পর্যটন নগরী কক্সবাজারে তিনটি আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন পার্ক তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। এই তিনটি ট্যুরিজম পার্ক হলো—সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক, নাফ ট্যুরিজম পার্ক এবং সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক। এই ট্যুরিজম পার্কগুলোতে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে প্রতি বছরে বাড়তি আয় হবে প্রায় ২০০ কোটি মার্কিন ডলার।
বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে দারিদ্র্যদূরীকরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য গ্রামীণ পর্যটনশিল্পের উন্নয়ন একান্ত প্রয়োজন। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি-২০৩০) অর্জন ত্বরান্বিত করতে সমবায়ভিত্তিক পর্যটন, গ্রামীণ পর্যটন, কমিউনিটি বেইজড ট্যুরিজম, জেলাভিত্তিক পর্যটন, সাংস্কৃতিক পর্যটন ও হাওর পর্যটন উন্নয়নের মধ্য দিয়ে একতা-সাম্য ও সহযোগিতার প্রত্যয় বৃদ্ধি করে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে পর্যটনশিল্প বাংলাদেশে জাতীয় উন্নয়নে বড় অবদান রাখতে পারে। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে উল্লেখযোগ্য পর্যটন প্রসার প্রয়োজন। অল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করলে সমবায় পর্যটন, কমিউনিটি বেইজড পর্যটন আরো সম্প্রসারিত হবে। গ্রামের মানুষের মধ্যে মমত্ববোধ, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, সহযোগিতা, একতা, সাম্য বৃদ্ধি পাবে, যা বর্তমানে চলমান উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকে ত্বরান্বিত করে উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে সহযোগিতা করবে এবং বাস্তবায়িত হবে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা। পর্যটনশিল্পের করোনা মহামারি সংকট উত্তরণে, টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পর্যটন বির্নিমাণে নিম্নলিখিত উল্লেখযোগ্য কার্যক্রমের ওপর অধিক গুরুত্বারোপ করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলো চিহ্নিতকরণ, প্রচার ও প্রসারের কাজ ও গবেষণার পরিধি বৃদ্ধি করে পর্যটক প্রত্যাশা সম্পর্কে ধারণা সমৃদ্ধ করা দরকার। সেই সঙ্গে ডিজিটাল সেবা ও ডিজিটাল মার্কেটিং কৌশলসমূহ ব্যবহারের মাধ্যমে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যটক আকর্ষণ ও সন্তুষ্টির বিধান আরো সহজ হবে। ছোট ছোট প্রমো তৈরি করে পর্যটনকেন্দ্রগুলোর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্রান্ডিংয়ের মধ্য দিয়ে প্রজ্বলিত শিখার ন্যায় আলোকিত হবে অমিত সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প।
লেখক : চেয়ারম্যান, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসিপটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়