বৃহস্পতিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

যেই পথ যাহার নহে

আপডেট : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০০:৫০

কবির সুমনের একটি জনপ্রিয় গান রহিয়াছে—‘কতটা পথ পেরোলে তবে পথিক বলা যায়?’ ইহার সহিত সুর মিলাইয়া বলা যাইতে পারে :কতটা কাঁটাবিছানো রক্তাক্ত পথ পাড়ি দেওয়ার পর, হামলা-মামলা-জেল-জুলুম এবং অত্যাচার সহ্য করিবার পর তবে একজনকে ‘রাজনীতিবিদ’ বলা যায়। রাজনীতিবিদরা হইলেন অ্যান্টিক পদার্থের মতো—যত বেশি পোড় খাওয়া ও পুরাতন হইবেন, তত বেশি অভিজ্ঞতাঋদ্ধ ও মূল্যবান হইবেন। এই জন্য রাজনীতিবিদদের অভিধানে ‘অবসর’ বলিয়া কোনো শব্দ নাই। কিন্তু উন্নয়নশীল বিশ্বের রাজনীতিবিদ হওয়াটা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। নির্বাচনে দাঁড়াইতে হইলে যেমন ‘পরাজিত হইতেও পারি’ মানসিকতা লইয়াই মাঠে নামিতে হয়, তেমনি রাজনীতিতেও রহিয়াছে সীমাহীন অনিশ্চয়তার এক মরুভূমিতুল্য ঊষর পথ—যাহার শেষে মরুস্বর্গ থাকিতেও পারে, আবার নাও থাকিতে পারে। সেই ভয়াবহ ঝুঁকি মাথায় লইয়াই উন্নয়নশীল বিশ্বে রাজনীতির খাতায় নাম লেখাইতে হয়। 

সকল আমলেই রাজনীতিতে বিভিন্ন ধরনের বহির্দ্বন্দ্ব ও অন্তর্দ্বন্দ্ব থাকে। এই সকল দ্বন্দ্ব-কোন্দল-হানাহানি পোড় খাওয়া অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদরাই সবচাইতে ভালোমতো সামলাইয়া থাকেন। কিন্তু ইহার মধ্যে এখন যেন ময়ূরের পেখম লাগাইয়া কোনো কোনো আমলা ঢুকিয়া পড়িতে চাহেন। উন্নয়নশীল বিশ্বে কিছু কিছু উচ্চাভিলাষী আমলার এই ধরনের মানসিকতা অত্যন্ত দুঃখজনক। কারণ, আমলাদের কাজই হইল নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করা। কেন তাহারা জাতীয় এমনকি স্থানীয় পর্যায়ের দলীয় রাজনীতিতে জড়াইয়া পড়িবেন? সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে কর্মের মাধ্যমে সেতুবন্ধ সৃষ্টি করিয়া থাকে প্রজাতন্ত্রের বেতনভুক কর্মচারী আমলারা—যাহাদের বেতনভাতা গাড়ি-বাড়ির খরচ আসে জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ হইতে। রাষ্ট্র পরিচালনা করিয়া থাকে সরকার। কিন্তু রাষ্ট্রীয় বেতনভুক কর্মচারী আমলাদের বেতনভাতা তো কখনোই কোনো দল বহন করে না। সুতরাং দলীয় রাজনীতিমুক্ত থাকাটাই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। গভর্নমেন্ট সার্ভেন্ট কন্ট্রাক্ট রুলস রহিয়াছে, পাবলিক সার্ভিস কন্ট্রাক্ট রুলস রহিয়াছে, চাকরিবিধি রহিয়াছে, সেই নিয়মে আমলাদের গোপন বৈঠক, রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে যোগদান চলে না। কিন্তু কথায় আছে—‘কাজির গরু কিতাবে আছে গোয়ালে নাই।’ সেই জন্য উন্নয়নশীল বিশ্বের ইহার ব্যত্যয় দেখা যায়।

এমনিতেই উন্নয়নশীল বিশ্বের রাজনীতির মাঠ বেশির ভাগ সময় উত্তপ্ত থাকে। এই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে আমলাদের নাক গলানোটা আগুনে ঘি ঢালিবার মতো। তাহারা সার্বিক পরিস্থিতিকে আরো জটিল করিয়া তোলেন। ইতিপূর্বে আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এক অনুষ্ঠানে আক্ষেপ করিয়া বলিয়াছেন, ‘রাজনীতি করার জন্য যে আমার পাছায় বাড়ি মেরেছে, সে এখন আমার সাথে রাজনীতি করতে চায়।’ তিনি আরেক জায়গায় বলিয়াছেন, “আমি যদি হাসপাতালে গিয়ে বলি, আমাকে ডাক্তারি করার সুযোগ দেন, অথবা ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে গিয়ে যদি বলি কমপক্ষে সুপারিনটেনডেন্ট ইঞ্জিনিয়ারের পদটি আমাকে দেন, তাহলে কী অবস্থা হবে?...অথচ ডাক্তার বলেন কিংবা ইঞ্জিনিয়ার, এমনকি ভিসি সাহেব অবসর গ্রহণ করে সহজেই বলতে পারবেন, ‘আমি রাজনীতি করিব’। যারা সরকারি চাকরি করেন, জজ সাহেব যারা আছেন ৬৭ বছর পর্যন্ত চাকরি করে গিয়ে বলবেন, ‘আমিও রাজনীতি করিব’।...সরকারি সচিব, প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি, ক্যাবিনেট সেক্রেটারি অবসরে গিয়াই বলেন, ‘আমিও রাজনীতি করিব’। মনে হয় রাজনীতি করতে হলে কোনো নিয়মকানুন নাই, যোগ্যতা লাগে না। যার যখন ইচ্ছা এটি করতে পারেন।” 

এই যে আমলারা জাতীয় রাজনীতির পাশাপাশি স্থানীয় রাজনীতিতেও নাক গলাইতে চাহেন, ইহার অভিঘাত কি ভালো হইবে? উন্নয়নশীল বিশ্বের রাজনীতিবিদদের পথ যেহেতু কাঁটাবিছানো এবং এইখানে মারামারি হানাহানি খুব স্বাভাবিক ব্যাপার, সুতরাং আমাদের ভয় হয় যে, আমলা-রাজনীতিবিদদের মধ্যে দুর্ভাগ্যজনক সংঘাত দেখা দিতে পারে। যেই ক্ষেত্র বা মাঠ যাহাদের জন্য নহে, তাহারা কি সেই মাঠে ভুঁইফোড়ের মতো হঠাৎ উদয় হইয়া রাজনীতিতে বিদ্যমান জটিলতা-হানাহানি-সংঘাত হজম করিতে পারিবেন? নিবিড় চিত্তে ইহা ভাবিয়া দেখা দরকার।

ইত্তেফাক/ইআ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন