টেলিযোগাযোগ খাতে ‘কোয়ালিটি অব সার্ভিস’ নীতিমালার অনুমোদন হইয়াছিল আরো চার বৎসর পূর্বেই। সেইখানে বলা হইয়াছিল, গ্রাহকসেবার অসন্তুষ্টি দূর করিতে মানসম্মত সেবা তথা কোয়ালিটি অব সার্ভিস (কিউওএস) নীতিমালা ভূমিকা রাখিবে। কিন্তু দিনকে দিন অভিযোগের পাহাড় জমিয়াছে মোবাইল অপারেটরদের বিরুদ্ধে। কলড্রপ হইতেছে অহরহ। ভয়েজ কল ও ইন্টারনেটের উচ্চমূল্য, দুর্বল নেটওয়ার্ক কাভারেজ, নেটওয়ার্ক সমস্যা, ভয়েজ কলের নিম্নমান, ইন্টারনেটের ধীরগতির সমস্যা তো রহিয়াছেই। সম্প্রতি বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) জানাইয়াছে, একই অপারেটরের দুইটি মোবাইল ফোন নম্বরের মধ্যে প্রতিটি কলড্রপের জন্য ক্ষতিপূরণ পাইবেন গ্রাহকরা। অন্যদিকে কলড্রপের পরিমাণ জানিতে পাইবেন এসএমএসে। মোবাইল অপারেটরদের গত সোমবার এই নির্দেশনা দিয়াছে বিটিআরসি এবং আগামী ১ অক্টোবর হইতে এই নির্দেশনা কার্যকর হইবে। খবরটি অনেকের নিকট স্বস্তির মনে হইলেও অনেকে আবার মনে করিতেছেন, কলড্রপের ক্ষতিপূরণের চাইতেও জরুরি হইল কলড্রপ যাহাতে না হয়, সেই ব্যবস্থা করা। বিটিআরসির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সবচাইতে অধিক কলড্রপ গ্রামীণফোনের, তাহাদের গ্রাহকও সবচাইতে বেশি।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে কলড্রপের জন্য হয়তো অপারেটর দায়ী থাকে না। যেমন লিফটের ভিতরে, উঁচু দালানে, যাতায়াতের সময়, নেটওয়ার্ক পকেট পেরিয়ে যাওয়ার সময়, অথবা আবহাওয়া খারাপ থাকিলে। ইহা গ্রাহকরা জানেন। কিন্তু অন্য সময় নেটওয়ার্ক লইয়া সমস্যায় পড়াটা গ্রাহকসেবার অন্তরায়। প্রশ্ন জাগিতে পারে, ‘কলড্রপ’-এর ক্ষেত্রে মোবাইল অপারেটররা কখন দায়ী হয়? মূল দায়টা নেটওয়ার্কের ওভারলোড হওয়া। বিশেষজ্ঞরা বিষয়টি এইভাবে ব্যাখ্যা করিয়াছেন যে, একটা ছোট ছিদ্র দিয়া একসঙ্গে যদি ১০টা তির পার করিবার ব্যবস্থা থাকে এবং তাহা দিয়া কেহ যদি একসঙ্গে ২০-৩০টা তির পার করিবার চেষ্টা করেন—তখন অনেকগুলি তিরই ছিদ্র পার করিতে পারিবে না। অর্থাৎ তির তথা গ্রাহক অনুযায়ী ছিদ্র বড় করা তথা স্পেকট্রাম বৃদ্ধি করিতে হইবে। মোবাইল ফোন অপারেটরগুলির সেবার মান নিরীক্ষা করিতে বিটিআরসি ‘কোয়ালিটি অব সার্ভিস’ চালু করিবার জন্য দেশের চারটি বিভাগ ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও সিলেটে অপারেটরগুলির ড্রাইভ টেস্ট করা হইয়াছিল।
বিটিআরসি বলিতেছে, মোবাইল অপারেটরদের টাওয়ারগুলিকে অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবলের সঙ্গে সংযুক্ত করিতে না পারিবার ব্যর্থতাই কলড্রপ বৃদ্ধির মূল কারণ। প্রশ্ন হইল, কারণ যাহাই হউক, মোবাইল অপারেটররা তো অল্প কিছুদিন ধরিয়া ব্যবসায় করিতেছেন না, তাহারা এই ব্যাবসায়িক সার্ভিস দিতেছে দেড়-দুই যুগ ধরিয়া। সুতরাং এত বত্সরেও কেন গ্রাহকের ভোগান্তি না কমিবার পরিবর্তে বৃদ্ধি পাইবে। বিটিআরসির নির্ধারণ করা কলের গুণগত মানদণ্ড অনুযায়ী ওয়্যারলেস নেটওয়ার্কে সর্বোচ্চ ২ শতাংশ কলড্রপ হইতে পারে, কিন্তু ইহার বেশি হইলে গ্রাহককে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নিয়ম। কিন্তু এত দিন কোনো অপারেটরকে প্রথম কলড্রপের জন্য কোনো ক্ষতিপূরণ দিত না। গ্রাহকের যত কলড্রপ হইত, তাহার প্রায় ৬৫ শতাংশই হয় প্রথম কলড্রপ। সুতরাং কলড্রপের ক্ষতিপূরণ বিষয়ে নূতন সিদ্ধান্তকে আপাতত সাধুবাদ জানানো যাইতে পারে। তবুও তো একটি নিয়ম হইল। যদিও দেশে অনেক নিয়মকানুন রহিয়াছে, তাহার কতগুলিই-বা যথাযথভাবে মান্য করা হয়? নিঃসন্দেহে কলড্রপ একধরনের মানসিক যন্ত্রণা। কারণ গুরুত্বপূর্ণ সময়ে কথা শেষ করিতে না পারিবার বিষয় এইখানে রহিয়াছে। সেবা পাইবার যেই অধিকার গ্রাহকের রহিয়াছে, তাহা রক্ষায় নূতন নিয়ম হইল। যদিও কলড্রপের ক্ষতিপূরণ পাইবার হিসাবটি সাধারণ মানুষের নিকট অত্যন্ত জটিল। যত জটিলতা থাকে তত শুভংকরের ফাঁকি থাকে। মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলির গ্রাহকসংখ্যা অনেক বাড়িয়াছে। গ্রাহক অনুযায়ী অপারেটরগুলোর যেই পরিমাণ স্পেকট্রাম তথা বেতার তরঙ্গ নেওয়া দরকার, সেই পরিমাণ তরঙ্গ নেওয়া হয় নাই। সুতরাং অপারেটরগুলিকে পর্যাপ্ত তরঙ্গ লইতে হইবে। কলড্রপের আসল সমস্যার সমাধান করিতে হইবে। একই সঙ্গে আমরা আশা করিব, মোবাইল অপারেটররা প্রতিযোগিতায় টিকিয়া থাকিবার স্বার্থেই তাহাদের সেবার মান উন্নত করিবে।