শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

উদ্যোক্তা তৈরির পথ এখনো কেন এত কণ্টকাকীর্ণ?

আপডেট : ০৪ অক্টোবর ২০২২, ০৭:০১

সময়টা ভালো নহে। চারিদিকে প্রতিকূলতার বাতাবরণ। একদিকে বৈশ্বিক যুদ্ধাবস্থা, অন্যদিকে মহামারির কারণে বিগত আড়াই বত্সরে বাংলাদেশে বিপুলসংখ্যক মানুষ কর্মহীন হইয়াছে। যুগপত্ কমিতেছে প্রবাসী ও রপ্তানি আয়। মুদ্রাস্ফীতি, মূল্যস্ফীতি, বৈশ্বিক মন্দার পদধ্বনি তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল ছোট দেশগুলির জন্য মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা নামাইয়া আনিতেছে। বিগত এক-দুই বত্সর ধরিয়া আর্থিক সংকটে ধুঁকিতেছে কিংবা বন্ধ হইয়া গিয়াছে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান। সবচাইতে অধিক সংকটের মধ্যে পড়িয়াছে ক্ষুদ্র ও মাঝারিশিল্প। এইদিকে গত সোমবার ইত্তেফাকে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হইয়াছে—সামান্য কাজেও সরকারি কর্মকর্তারা যেই পরিমাণ হয়রানি করেন, তাহাতে ছোট উদ্যোক্তারা তো মনোবল হারানই, বড় শিল্প উদ্যোক্তারাও বিপাকে পড়েন। অথচ বলা হইয়া থাকে, উদ্যোক্তারা হইলেন একটি জাতির অর্থনৈতিক জগতের নায়ক। জাতি তাহাদের জন্যই অপেক্ষা করে, তাহাদেরই হাত ধরিয়া পা বাড়ায় অগ্রগতির পথে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও প্রায়শই বলিয়া থাকেন যে, শুধু চাকুরির পিছনে না ছুটিয়া সরকারি সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগাইয়া নিজেদের স্বাবলম্বী করিয়া তুলিতে হইবে। তিনি ইতিপূর্বে বলিয়াছেন যে, যুবসমাজের জন্য সরকার কর্মসংস্থান ব্যাংক করিয়া দিয়াছে। সেইখান হইতে কোনো জামানত ছাড়াও ঋণ নেওয়া যাইতে পারে। সেই ঋণ লইয়া যে-কেহ নিজের পায়ে দাঁড়াইতে পারিবে।

বাংলাদেশ এখনো তারুণ্যময়। তারুণ্যের এই টগবগে সময়টাকে ইতিবাচক কর্মে ব্যাপৃত না করিলে বাংলাদেশের তরুণদের একটি অংশ বিপথগামী হইয়া পড়িবে। ইহা সমাজের জন্য অত্যন্ত অহিতকর। সুতরাং উদ্যোক্তা তৈরির যাবতীয় পরিবেশ অনুকূলে রাখাটা সকলের জন্যই উইন-উইন হইবে; কিন্তু ঋণ লইয়া উদ্যোক্তা হওয়া তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির জন্য কখনো সখনো দুঃস্বপ্নের মতো। কয়েক বত্সর পূর্বে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে দেখা গিয়াছে, বাংলাদেশে ৯০ শতাংশ ব্যবসা শুরু করিবার পাঁচ বত্সরের মধ্যেই বন্ধ হইয়া যায়। যদিও ইতিপূর্বে বলা হইয়াছে যে, বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য ৯টি খাত বিপুল সম্ভাবনাময়। এইগুলি হইতেছে—বিদ্যুত্ ও জ্বালানি, কৃষি যন্ত্রপাতি, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি), অবকাঠামো উন্নয়ন ও প্রকৌশলসেবা, বস্ত্র ও পোশাক প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা সরঞ্জামাদি ও সেবা, শিক্ষা, ই-কমার্স, স্বাস্থ্যসেবা ও ঔষধ। বাংলাদেশের নিম্নমজুরি হার ইতিপূর্বে তৈরি পোশাক খাতকে সম্প্রসারণে সহায়তা করিয়াছে। তবে গত জুলাই মাসে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের গবেষণাকৃত একটি প্রতিবেদনে বলা হইয়াছে, বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সবচাইতে বড় বাধা দুর্নীতি। ঘুষ, আত্মসাত্সহ বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতি প্রতিরোধে সরকার নানা আইন প্রণয়ন করিয়াছে; কিন্তু আইনের বাস্তবায়নে ঘাটতি রহিয়াছে। প্রতিবেদনে আরো বলা হইয়াছে যে, দেশি বিনিয়োগ তো বটেই, বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হইবার অন্যান্য কারণ হইল—শ্রম আইনের শিথিল প্রয়োগ, আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো ও সীমিত অর্থায়নের সুযোগ। যদিও সাম্প্রতিক বত্সরগুলিতে ব্যবসায় পরিবেশের উন্নতিতে সরকারের প্রচেষ্টা দেখা গিয়াছে; কিন্তু বহু ক্ষেত্রে সমস্যা যেই তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রহিয়াছে এবং বৈশ্বিক পরিস্থিতি আরো নূতন নূতন সমস্যাকে যুক্ত করিয়াছে। ইতিপূর্বে লিডারশিপ ইন ইন্টারন্যাশনাল ম্যানেজমেন্ট (এলআইএম) নামের একটি আমেরিকান পরামর্শক সংস্থার গবেষণাকৃত একটি প্রতিবেদনে বলা হইয়াছে, বাংলাদেশে নবীন উদ্যোক্তাগণের ভবিষ্যত্ পরিকল্পনা সম্পর্কে ঔদাসীন্য, দক্ষতার অভাব, প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় ত্রুটি দেখা যায়। স্বাভাবিকভাবেই এই দেশে উদ্যোক্তা ইহবার পথে এখনো অনেক কাঁটা বিছানো। ক্ষুদ্র ও বৃহত্—সকল ধরনের উদ্যোক্তাই খুব অধিক বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ পান না।

সুতরাং বিপুল সম্ভাবনার খাতগুলিতে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরির জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করিতে হইবে। সরকারপ্রধান আন্তরিক বটে; কিন্তু রাষ্ট্রের অন্তস্থ সিস্টেমগুলি যেই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা তাহা দূর করিতে হইবে। এই জন্য এই সংকটের সময়ে সরকারের প্রয়োজন সংকটকালীন বিশেষ ম্যানেজমেন্ট। মনে রাখিতে হইবে, একজন উদ্যোক্তা কেবল নিজেকেই রক্ষা করেন না, আরো ১০ জনের রুটিরুজিরও ব্যবস্থা করিয়া থাকেন।

ইত্তেফাক/জেডএইচডি