শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

স্বাস্থ্য খাতে স্বচ্ছতা আনয়ন জরুরি

আপডেট : ০৬ অক্টোবর ২০২২, ০৪:০৪

করোনা মহামারিতে দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতের যে নাজুক অবস্থা তা প্রতিয়মান হয়েছে। পরবর্তী সময়ে যে এর তেমন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন বা উন্নয়ন সাধিত হয়েছে, সেটা জোর দিয়ে বলা যায় না। নানা ধরনের অনিয়ম, দুর্নীতি ও সমস্যায় জর্জরিত দেশের স্বাস্থ্য খাত। বিশেষ করে সরকারি হাসপাতালগুলোতে এর প্রবণতা অতিমাত্রায় উপস্থিত।

মূলত প্রত্যন্ত অঞ্চলের ও সাধারণ পেশাজীবীর মানুষেরা একটু উন্নত চিকিত্সা সেবার জন্য জেলা সদর ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে যেয়ে থাকে। চিকিত্সাসেবা জনগণের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অধিকার হওয়া সত্ত্বেও সঠিকভাবে এই সেবা জনগণ পায় না। হাসপাতালের বিভিন্ন দালাল, স্টাফ, ওয়ার্ডবয়, নার্সসহ বিভিন্ন চক্রের কাছে প্রতারণা ও হেনস্তার শিকার হয়ে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয় সেবাপ্রত্যাশীদের। একশ্রেণির দালাল ও হাসপাতালের স্টাফরা রোগীদের থেকে অতিরিক্ত অর্থ নিয়ে থাকে। অথচ সরকারি হাসপাতালের চিকিত্সাসেবা প্রায় বিনা মূল্যে প্রদান করার বিধান রয়েছে। কিন্তু  অসাধু দালাল চক্র উন্নত সেবা দেওয়ার নামে রোগীদের থেকে অর্থ নিয়ে তাদের সর্বস্বান্ত করছে। সম্প্রতি রংপুর সরকারি হাসপাতালের এক চিকিত্সক নিজ কর্মস্থলে হয়রানির শিকার হন। অর্থোসার্জারি বিভাগের জুনিয়র কনসালট্যান্ট মো. রাশেদুল আমীর হূদেরাগে আক্রান্ত মাকে হাসাপাতালে ভর্তি করালে ওয়ার্ডবয় এসে বকশিশ দাবি করে। এই ঘটনায় সরকারি হাসপাতালের সেবা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা দেখা দেয়। নিজ কর্মস্থলে চিকিত্সকরাই যদি এরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হন, তাহলে সাধারণ জনগণকে কেমন ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে যেতে হয়, তা বুঝতে আর দেরি হওয়ার কথা নয়।

এছাড়া, জেলা শহরের হাসপাতালগুলোতে প্রয়োজনীয় চিকিত্সক ও জনবল নেই। উপজেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ক্লিনিকগুলোর অবস্থা আরো করুণ। এসব হাসপাতালগুলোতে নেই প্রয়োজনের তুলনায় পর্যাপ্ত এমবিবিএস চিকিত্সক।  আবার অনেক সরকারি ডাক্তাররা হাসপাতালের চাইতে প্রাইভেট প্র্যাকটিসে বেশি সময় দেন; যার কারণে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকে অনেক ডাক্তার। এর ফলে সেবাগ্রহীতাদের পড়তে হয় নানা বিড়ম্বনায় । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর মতানুযায়ী , যে কোনো দেশে প্রতি ১ হাজার মানুষের জন্য এক জন ডাক্তার থাকা উচিত। বাংলাদেশে বর্তমানে ২  হাজার ৫০০ মানুষের জন্য এক জন ডাক্তার রয়েছেন, যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। দেশের মোট জনসংখ্যার অনুপাতে এই মুহূর্তে আমাদের কমপক্ষে দেড় লাখ ডাক্তার থাকা দরকার ছিল। শুধু ডাক্তারই নয়, সিনিয়র স্টাফ নার্স, প্যারামেডিকস ও ল্যাব-টেকনিশিয়ানসহ অন্যান্য বিভাগের লোকবলের চরম সংকট রয়েছে। লোকবলের অভাব ও সেই সঙ্গে অবহেলার কারণে জেলা সদর ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে এক্সরে, প্যাথলজি পরীক্ষার যন্ত্রপাতি, আলট্রাসনোগ্রাফি, ল্যাপারোস্কপি, স্টেরিলাইজার, অটোক্লেভ, ডায়াথামিসহ অত্যাধুনিক বিভিন্ন যন্ত্রপাতিসহ বহু মূল্যবান চিকিত্সাসামগ্রী ব্যবহারের অভাবে অকেজো হয়ে পড়ে থাকে। এসব যন্ত্রপাতি বাক্সবন্দি হয়ে পড়ে থাকে বছরের পর বছর ধরে।

সরকারি হাসপাতালের চিকিত্সকদের চেম্বারের আশপাশে ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিদের উপস্থিতি একটি লক্ষণীয় বিষয়। চিকিত্সকরা দামি উপহার বা বড় ধরনের সুবিধা পাওয়ার জন্য তাদের সুবিধা অনুযায়ী ওষুধ লিখে দেন। চিকিত্সক রোগীকে কোন ওষুধ দিয়েছেন তা দেখার জন্য রোগীর ব্যবস্থাপত্র নিয়ে টানাহেঁচড়া শুরু করেন এই ওষুধ বিক্রয়কারী প্রতিনিধিরা। দেশে যত্রতত্র অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে মানহীন বিভিন্ন ল্যাব, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিক। অথচ সরকারি কোনো   নিবন্ধন নেই এসব প্রতিষ্ঠানের। এসব জায়গায় চিকিত্সার নামে সাধারণ রোগীদের অনেক অর্থ খরচ করতে হয়। অথচ তারা এখান থেকে সঠিক চিকিত্সাও পায় না।

স্বাস্থ্য খাতে স্বল্প বরাদ্দ, সরকারের সুদৃষ্টি ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব, প্রয়োজনীয় চিকিত্সাসামগ্রীর অপ্রতুল সরবরাহ, চাহিদার তুলনায় চিকিত্সক ও দক্ষ জনবলের অভাবের মতো বিষয়গুলো স্বাস্থ্য খাতের দীনতার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সঠিক  ব্যবস্থাপনা গ্রহণের মাধ্যমে চিকিত্সাসেবায় বিঘ্ন সৃষ্টির কারণগুলো চিহ্নিত করে তা সমাধানে কার্যকর ব্যবস্থা অবলম্বন করা এখন সময়ের দাবি। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর তথ্যমতে, সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩৫ শতাংশ দুর্নীতি হয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে, ২৪.৯ শতাংশ জেনারেল হাসপাতালে এবং মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এর অনুপাত ২০.৭ শতাংশ। হাসপাতালসমূহে সামগ্রিক দুর্নীতি বন্ধের জন্য বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। এক্ষেত্রে  হাসপাতালে দালালদের উত্খাত ও ডাক্তারদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে বিশেষ মনিটরিং সেল জোরদার করা প্রয়োজন। তাছাড়া, দেশের যত্রতত্র প্রতিষ্ঠিত অনিবন্ধিত ও মানহীন ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক ল্যাবসমূহে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা অতীব প্রয়োজন।

লেখক: শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

ইত্তেফাক/এএইচপি

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন