পৃথিবীতে সবকিছুই ঘুরছে। পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরছে। বিজ্ঞানের ইতিহাসে নির্মম দিন ছিল ১৬০০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি। ফাঁসির মঞ্চ সাজানো হয়েছে রোমের রাজপথে। সারা রোমের মানুষ উত্সুক হয়ে ফাঁসির জন্য অপেক্ষা করছে। আসামি জিওর্দানো ব্রুনো। প্রচলিত ধারণার বিপক্ষে কথা বলার অপরাধে তিনি অপরাধী। ফাঁসিটা ঠিক ফাঁসির মতো নয়, বরং জনসমক্ষে আগুনে পুড়িয়ে মারার আদেশ জারি হয়েছিল। খুব অদ্ভুত বিচারকের আদেশ, আগুনে পুড়িয়ে মারলে তার রক্ত পৃথিবীর মাটিতে মিশতে পারবে না। মৃত্যুর আগে ব্রুনোকে বলা হয়েছিল, যা বলছেন তা যদি তিনি ভুল বলে স্বীকার করে নেন, তাহলে তাকে বেঁচে থাকার সুযোগ দেওয়া হবে। ব্রুনো মাথা নত করে বাঁচতে চাননি, বরং মাথা উঁচু করে মরতে চেয়েছেন। এরপর তার শরীরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হলো। আস্তে আস্তে পুড়ে ছাই হয়ে গেল সোনার শরীর, কিন্তু সত্য তখনো আলোর মতোই উদ্ভাসিত। তার অপরাধ ছিল, তিনি তার মতো করে সত্যকে বলেছেন। আর সেই কঠিন সত্যকে অন্তরে ধারণ করে তিনি বলেছিলেন, পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘুরছে। পৃথিবী সৌরজগতের তুচ্ছ গ্রহ ছাড়া এর আলাদা কোনো গুরুত্ব নেই। পৃথিবী ও বিশ্বজগত্ চিরস্থায়ী নয়, একদিন এসব ধ্বংস হয়ে যাবে।
সত্যের জন্য মরতে পারলে মানুষ সত্য হয়ে বেঁচে থাকে চিরকাল। মিথ্যার জন্য মানুষ মরে না। তবে সত্যটা অনেক সময় মিথ্যা হয়ে যায়, যখন সত্য মিথ্যার সঙ্গে ঘুরতে থাকে। কাঠের লাটিম পেরেককে নিজের ভেতর ঢুকিয়ে রক্তাক্ত হয়ে ঘুরছে। গাড়ির চাকা নিজেকে ক্ষয়ে ক্ষয়ে পিচঢালা কংক্রিটের বাঁধাই করা শক্ত রাস্তার সঙ্গে লড়তে লড়তে ঘুরছে। চাকা জানে সে খুব দুর্বল, তার পরও সবল রাস্তার সঙ্গে লড়ছে। বিজ্ঞানীরাও কম যান না, চাকার নতুন নতুন আবিষ্কার করে লড়াইয়ের সময়টা বাড়িয়ে দিচ্ছেন; কিন্তু সেটাই বা কতটা, যেখানে হার মানতেই হবে একদিন! ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে সময় ঘুরছে। এভাবে ক্রমাগত দেখা-অদেখা অনেক কিছুই ঘুরছে। জীবনের টানাপোড়েনে আটকে থাকা মানুষটার মাথা ঘুরছে, অথচ মাথাটা থেকেও না থাকার মতো। দুশ্চিন্তায় মাথাটা আর কাজ করছে না।
সংসারে দুই মুঠো খাদ্যের জোগান দেবে বলে কুয়োর ভেতরে জীবন বাজি রেখে মোটরসাইকেলের সঙ্গে মানুষ ঘুরছে। ক্রমাগত ঘাত-প্রতিঘাতে জর্জরিত হচ্ছে জীবন। মৃত্যু যে কোনো সময় হতে পারে জেনেও না জানার ভান করে ঘুরছে তো ঘুরছে। সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছে মৃত্যুও; কিন্তু মৃত্যুর চেয়ে বড় যে সংসার। খুব অদ্ভুত একটা বিষয়, মানুষটা বুঝতেও পারছে না তার এমন করে ঘুরতে ঘুরতে মৃত্যু হলে সংসারটা ভেঙে ছারখার হয়ে যাবে। হয়তো মানুষটা সব জানে, অথচ অভিনয়চক্রে পাকা অভিনেতা হয়ে কাঁচা মানুষের মতো ঘুরতে থাকে।
গ্রামোফোন আধুনিক রেকর্ড প্লেয়ার, স্টেরিও ও সিডির পূর্বরূপ। ১৮৮৭ সালে এমিল বার্লিনার গ্রামোফোন আবিষ্কার করেন। টমাস আলভা এডিসন এটার উন্নতি করে নাম দেন ফোনোগ্রাম। গ্রামোফোনের গোল চাকতির মতো রেকর্ডটা একসময় ঘুরতে ঘুরতে মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করে সংগীত শুনিয়েছিল। কোথায় হারিয়ে গেল গ্রামোফোন, কোথায় হারিয়ে গেল সেই কালজয়ী সংগীত। এখন মানুষ গান শুনছে; কিন্তু সেভাবে মানুষ মনের ক্ষুধা আর মেটাতে পারছে না। পুরোনো কখনো কখনো খুব মূল্যবান হয়। গান একসময় মানুষের আনন্দের উপাদান ছিল, এখন গান পণ্য হয়েছে। মানুষেরই বা দোষ কী? পেটে ক্ষুধা থাকলে মায়া, মমতা, ভালোবাসা সবকিছু বাণিজ্যিক হয়ে যায়। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য্যের কবিতার একটা লাইনের মতো, ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।’ আরো অনেক কিছু ঘুরছে। টাকাপয়সা, লোভ-লালসা, ভোগবিলাস, ক্ষমতার লড়াই—সব ঘুরছে। অর্থনীতির অদৃশ্য চাকা ঘুরছে।
আন্তর্জাতিক রাজনীতির দাবার ঘুঁটি ঘুরছে। যে যেমন পারছে তার মতো ঘুরছে। অথচ নীরব, নিস্তব্ধ পৃথিবী ঘুরছে না। সেই পৃথিবীর থমকে যাওয়া সময় ঘুরছে না। ঘড়ির কাঁটায় বন্দি হয়ে উত্সবে মেতে ওঠা, এই পৃথিবীর সময় ঘুরছে। সেই নিস্তব্ধ পৃথিবীর সাধারণ মানুষগুলো...চেনা চেনা, খুব অচেনা? যে সাধারণ মানুষগুলোর খোঁজ নেওয়া দরকার, তাদের জীবন থেমে গেছে নাকি ঘুরছে, তার খোঁজ নেওয়ার মতো অসাধারণ বলে দাবি করা মানুষগুলো নিজেদের স্বার্থে ঘুরছে; কিন্তু মানুষের স্বার্থে ঘুরছে না।
একটা সাদা কাগজ। কী এর মূল্য, যদি সেখানে লেখার পর লেখা জমতে জমতে বই হয়ে না ওঠে? বই হলেই বা মূল্য কী, যদি না বই লিখতে লিখতে লেখকের জন্ম না হয়? লেখকের কী মূল্য আছে, যদি তার লেখা মানুষের জীবনকে বদলে না দেয়? জীবনের কী মূল্য আছে, যদি তা মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে না উঠতে পারে?
একটা সাদা কাগজ। কতটা মূল্য তার, যদি তা মানুষের হাতের সঙ্গে মনের সংযোগ ঘটিয়ে চিঠি না হয়ে উঠতে পারে? কতটাই বা মূল্য চিঠির, যদি তার লেখা কালো অক্ষরগুলো প্রাপকের মনের তৃষ্ণা মেটাতে না পারে? একজনের তৃষ্ণা মেটানোর মূল্যই বা কতটুকু, যদি তৃষ্ণাটা ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল হয়ে উঠতে না পারে? কতটুকুই বা মূল্য ইতিহাসের, যদি তা মানুষের জীবনকে বদলে দিতে না পারে? একটা সাদা কাগজ। কতখানি মূল্য তার, যদি সেটা বিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের ‘গবেষণা করতে কাগজ-কলম, চিন্তাশক্তি হলেই চলে’-এর সেই কাগজ হয়ে উঠতে না পারে? সেই কাগজেরই বা মূল্য কতটুকু, যদি সেটা বিজ্ঞানের গবেষণাকে কাগজের মধ্যে লিখে রাখতে না পারে? গবেষণারই-বা মূল্য কতখানি, যদি তা কাগজের গণ্ডি পেরিয়ে বিস্ময়কর সৃষ্টিতে পরিণত হতে না পারে? সৃষ্টিরই বা মূল্য কতটুকু, যদি তা মানুষের জীবনকে বদলে দিতে না পারে? জীবনেরই বা মূল্য কতটুকু, যদি তা সৃষ্টিকে চিন্তায় পরিণত করতে না পারে? চিন্তারই বা মূল্য কতখানি, যদি তা সভ্যতার সংকটকে উতরে যেতে না পারে?
কতটাই বা মূল্যবান একটা কাগজে লেখা কাবিননামা, যদি সেটা সম্পর্কের বন্ধন গড়তে না পারে? কতটুকুই বা মূল্য সম্পর্কের, যদি সেখানে বিশ্বাসের জন্ম না হয়? কতটুকুই বা মূল্য বিশ্বাসের, যদি সেই বিশ্বাসে ভালোবাসা না থাকে?
জীবন। যার কোনো গন্তব্য নেই। একটা মানুষ বাড়ি থেকে বের হয়, অথচ কখনো আর জীবন নিয়ে বাড়ি ফেরা হবে কি না, তা জানে না। আপনজনের ফেলে আসা মায়াবী মুখগুলো আর কখনো দেখা হবে কি না, জানে না। যে বিদায় দেয়, সেও জানে না প্রিয় স্বজনদের মুখগুলো আর দেখা হবে কি না। থেঁতলে যাওয়া শরীরটার দিকে আর তাকানোর মতো অবস্থা থাকবে কি না। খুব অদ্ভুত শঙ্খনীল কারাগার যেন এটা। যেখানে খাঁচায় বন্দি মানুষ মৃত্যুর মধ্যে জীবনকে হাতড়ে বেড়ায়।
এভাবেই কত স্বপ্ন, আশা, সুখ, দুঃখ ও আনন্দ নিমেষে জ্বলতে জ্বলতে নিভে যায়। একটা মায়াবী মুখ বুকটাতে মোচড় দিয়ে হারিয়ে যায়, ফেলে যায় ছোপ ছোপ স্মৃতির অসম বোঝা। মৃত্যুটা এখন খুব অনিরাপদ হয়ে পড়ছে। স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টির ধারণাটা এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
কে এর দায়িত্ব নেবে? কেউ না। দায় নেওয়াার সংস্কৃতি তো আমাদের নেই, বরং একজনের দায় অন্যজনের ওপর চাপিয়ে কীভাবে দায়মুক্তি পাওয়া যায়, তার চোর-পুলিশ খেলা চলে। এরপর লাল ফিতার দৌরাত্ম্য তো আছে। সেই ফিতার ক্ষমতা অনেক, যা সত্যকে মিথ্যা বানায়, মিথ্যাকে সত্য বানায়। কিংবা নিরপেক্ষ হয়ে যায়। সব যেন অদৃশ্যের হাতে বন্দি। সব যেন অদৃষ্টের হাতে বন্দি।
আজ সবার কষ্ট হচ্ছে। বুকটা বোবা কান্নায় চেপে আসছে। আবেগ উথলে উঠছে। হয়তো সেটা এক, দুই, তিন দিন পর্যন্ত থাকবে। ফেসবুকে এটা নিয়ে অনেক মাতামাতি হবে। চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ হবে। তারপর যে যার মতো সবকিছু ভুলে যাবে। আমাদের মধ্যে ভুলে যাওয়ার রোগটা অনেক দিনের, যেটার কোনো ওষুধ নেই। পৃথিবীর সবচেয়ে নির্মম কথা হলো, ‘যার চলে যায় সেই বুঝে হায় বিচ্ছেদে কী যন্ত্রণা, আমরা আমজনতা কতটুকুই বা এর মনে রাখি।’
একটা আয়নায় মুখগুলো দেখেছিলাম, এখন মুখগুলো আর নেই। সব ছবি হয়ে গেছে। জানি না কে কখন এভাবে ছবি হয়ে যাবে। এখন ছবির তো আর অ্যালবাম নেই। মানুষ এখন তাই মনে রাখে না, সবকিছুই এখন মানুষের কাছে খেলা।
রাজধানীর উত্তরায় বাস রেপিড ট্রানজিট স্থাপনা প্রকল্পের একটি গার্ডার চাপায় নিহত প্রাইভেট কারের নববিবাহিত হূদয়ের বাবা রুবেল, হূদয়ের শাশুড়ি ফাহিমা, কনে রিয়া মনির খালা ঝর্ণা, ঝর্ণার দুই সন্তান জান্নাত ও জাকারিয়া সবার জন্য প্রার্থনা করছি। আপনারা আমাদের ক্ষমা করে দিয়েন, যদিও নিষ্পাপ শিশু।
লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর