ড. খুরশিদ আলম একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সমাজবিজ্ঞানী, যার সমাজ ও উন্নয়ন সম্পর্কে একাধিক তত্ত্ব রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় যে কয়েক জন সমাজবিজ্ঞানীর গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক অবদান রয়েছে, তিনি তাদের এক জন। ১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে এমএসএস এবং ১৯৮৫ সালে ভারতের পুনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রেকর্ড সময়ের মধ্যে পিএইচডি লাভ করেন। স্বল্প সময়ের জন্য তিনি মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ৩৫ বছরের বেশি সময় বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন। এছাড়া তিনি তিনটি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি থিসিস পরীক্ষক। নিউ ইয়র্কের নোভা পাবলিশার্সসহ পৃথিবীর বিখ্যাত কয়েকটি পাবলিশার্স থেকে তার বই এবং বইয়ের অধ্যায় প্রকাশিত হয়। তার কয়েকটি প্রবন্ধ বিখ্যাত আন্তর্জাতিক জার্নালে বিভিন্নভাবে সেরা প্রবন্ধের মর্যাদা পায়। সাক্ষাত্কারটি নিয়েছেন পিএইচডি গবেষক খান শরীফুজ্জামান
ইত্তেফাক : সামাজিক গবেষণা বলতে আমরা কী বুঝব?
ড. খুরশিদ আলম :সামাজিক গবেষণা মূলত সমাজকে নিয়ে গবেষণা করা বোঝায়। এখানে এক্সপেরিমেন্ট করার সুযোগ কম থাকে। মূলত সামাজিক সমস্যা ও সম্ভাবনা—এ দুটি বিষয়ে বেশি গবেষণা করা হয়। তবে কখনো কখনো কিছু অ্যাকশন রিসার্স বা নিরীক্ষাধর্মী গবেষণা করা হয়, যেখানে সমাজের লোকদের কোনো আচরণগত পরিবর্তন জানার জন্য কিছু ইনপুট দিয়ে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। এছাড়া কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে তার সুফল ও নেতিবাচক প্রভাব কী হয়, সেটিও সমাজ গবেষণায় বিবেচনা করা হয়। সমাজ গবেষণায় সাধারণত চারটি বিষয়কে খুব গুরুত্বসহকারে দেখা হয়। যেমন—মানুষের চাহিদা (নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ, প্রতিবন্ধী) কী, তাদের অগ্রাধিকার কী, তারা কোনটিকে বেশি গুরুত্ব বা মূল্য দেয় এবং কোনো একটি বিষয়ে ফলাফল কী পাওয়া গেল—এগুলো জানার জন্য সমাজ গবেষণার দরকার হয়।
ইত্তেফাক : বাংলাদেশে সামাজিক গবেষণার প্রয়োজনীয়তা কী?
ড. খুরশিদ আলম :বাংলাদেশ যেহেতু এখনো একটি পিছিয়ে পড়া দেশ, তাতে এখানে অনেক বেশি সমাজ গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। যারা পিছিয়ে আছে, তারা কারা; তাদের জীবিকার প্রতিবন্ধকতা ও সুযোগ-সুবিধাগুলো কী কী রয়েছে; কী করলে তাদের আরো অগ্রগতি সম্ভব; সবাইকে কীভাবে উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যায়; তাদের সম্ভাবনাকে আরো বেশি কীভাবে কাজে লাগানো যায়; শহর ও গ্রাম এলাকার দূরত্ব কীভাবে কমানো যায়; নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধীদের কীভাবে আরো বেশি উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যায়; শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানকে কীভাবে আরো বেশি কার্যকর করা যায়; প্রশাসনকে আরো বেশি কীভাবে গণমুখী করা যায় ইত্যাদি বিষয়ে গবেষণা দরকার। অনেকে মনে করেন, বাংলাদেশে সামাজিক গবেষণার দরকার নেই। তারা মনে করেন, বিদেশিরা বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করছেন, তাহলে আমাদের আর গবেষণা করার দরকার নেই। কিন্তু এটি সম্পূর্ণ একটি ভুল ধারণা। বিদেশিরা যেসব গবেষণা করছেন, তা বাংলাদেশকেন্দ্রিক নয়। তাই বাংলাদেশের সমস্যাগুলো তাদের গবেষণার আলোকে সমাধান করা যাবে না। আমাদের দেশের বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের গবেষণা করতে হবে, যেমন কোনো একটি এলাকায় কৃষকেরা কেন উন্নত জাতের ফসল ফলান না, নারীরা কেন ডেলিভারির জন্য হাসপাতালে যান না, শিশুমৃত্যু রোধে কী করা দরকার, সেগুলো আমাদেরই গবেষণা করতে হবে। এভাবে যেসব সামাজিক বা উন্নয়ন সমস্যা রয়েছে, তার গবেষণা আমাদেরই করতে হবে। বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় দেখা যায়, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে গবেষণা ও উন্নয়নে ব্যয় করলে সাধারণত তার প্রায় ৫০ শতাংশ রিটার্ন পাওয়া যায়।
ইত্তেফাক : বাংলাদেশে সামাজিক গবেষণা জনপ্রিয়তা পায়নি কেন?
ড. খুরশিদ আলম :প্রথমত, বাংলাদেশে যথেষ্ট পরিমাণ সামাজিক গবেষণা হয়নি, যা মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে। দ্বিতীয়ত, এখানে দক্ষ সমাজ গবেষকের অনেক অভাব, যাদের সমাজ গবেষণা দেশে-বিদেশে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়। সর্বোপরি, অবকাঠামোগত উন্নয়নের ডামাডোলে সমাজ গবেষণার বিষয়টি উপেক্ষিত বিষয় হিসেবে থেকে গেছে। দেশটাকে পরিবর্তন করতে গেলে গবেষণা লাগবে, কিন্তু সে অনুযায়ী গবেষণা হয়নি।
ইত্তেফাক : বাংলাদেশে সামাজিক গবেষণার প্রধান সমস্যা ও সীমাবদ্ধতাগুলো কী কী?
ড. খুরশিদ আলম :প্রথমত, বাংলাদেশে সামাজিক গবেষণা এখনো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। দ্বিতীয়ত, সমাজ গবেষকদের কোনো শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। তৃতীয়ত, সমাজ গবেষক তৈরির জন্য তেমন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রচেষ্টা নেই। চতুর্থত, সমাজ গবেষণার জন্য নিয়মিত কোনো বরাদ্দ নেই। এছাড়া সরকারের দিক থেকে সমাজ গবেষণার কোনো অগ্রাধিকার সেক্টর ঠিক করা হয়নি এবং এসংক্রান্ত কর্মসূচিও সরকারের নেই। ফলে সমাজ গবেষণা যেভাবে দেশকে এগিয়ে নিতে পারত, সেটি সম্ভব হচ্ছে না।
ইত্তেফাক : গবেষণায় সাফল্যের জন্য একজন তরুণ গবেষকের কী কী বিষয়ে লক্ষ রাখতে হয় ও শিখতে হয়?
ড. খুরশিদ আলম :নিজেদের গবেষক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হলে তরুণ গবেষকদের প্রথমত নিজের লক্ষ্য স্থির করতে হবে। দ্বিতীয়ত, এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে হবে। তৃতীয়ত, গবেষণায় রাতারাতি কোনো অর্জন সম্ভব নয়—এ কথা মাথায় রেখে ধৈর্য রাখতে হবে, সাধনা করতে হবে। চতুর্থত, লক্ষ রাখতে হবে আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছানোর এবং সম্ভব হলে বিশ্বমানে পৌঁছানোর।
ইত্তেফাক : গবেষণাকে যদি পেশা হিসেবে কেউ নিতে চায়, বাংলাদেশে তার সম্ভাবনা কতটুকু?
ড. খুরশিদ আলম :শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর সব দেশেই তার চাহিদা আছে। আর বাংলাদেশে সুবিধা আরো বেশি। কারণ, এখানে একটা ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার সুযোগ আছে। এখানে যে গবেষণা করবে, সেটিই প্রথম হবে এবং সবার নজরে আসবে। গবেষকদের সম্মানী বাংলাদেশের মানে মোটেই কম নয়।
ইত্তেফাক : গবেষণায় সাফল্যের জন্য বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশন সফটওয়্যার শেখার গুরুত্ব কতটুকু?
ড. খুরশিদ আলম :সর্বপ্রথম একজন গবেষককে কোনটা শেখা উচিত? সর্বপ্রথম একজন গবেষককে তার বিষয়বস্তু ভালভাবে জানতে হবে। তার পরই তাকে সফটওয়্যার শেখার দিকে আগ্রহী হতে হবে। আগেই সফটওয়্যার শেখার কুফল হলো এই যে, সে সফটওয়্যারের মধ্যেই ঘুরপাক খেতে থাকে, কিন্তু বিষয়বস্তুর ভেতরে যেতে পারে না। তাই আগে তাকে বিষয়বস্তু ভালোভাবে শিখতে হবে।
ইত্তেফাক : কোভিড-১৯ শুরু হওয়ার পর থেকে অনলাইনে যোগাযোগ বৃদ্ধি পাওয়ায় তরুণদের মধ্যে গবেষণা সম্পর্কে বেশ আগ্রহ দেখা যাচ্ছে, এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?
ড. খুরশিদ আলম :কোভিড-১৯ সব পেশা ও আয়ের লোককে মোটামুটি এক কাতারে দাঁড় করাতে পেরেছে। সবাই অনুভব করেছে যে, দেশে গবেষণার সামর্থ্য অনেক বাড়াতে হবে। বিশেষ করে যে কোনো দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য গবেষণার দক্ষতা বাড়াতে হবে। একটি দেশে যত বেশি গবেষক থাকবে, সে দেশে গবেষকদের ওপর মানুষের আস্থাও তত বাড়বে। এ ক্ষেত্রে গবেষণার কোনো বিকল্প নেই।
ইত্তেফাক : একজন সফল গবেষক হিসেবে তরুণদের প্রতি আপনার কী উপদেশ থাকবে?
ড. খুরশিদ আলম :সফল কি না, জানি না। গবেষণার ফলাফলের জন্য আশা না করে গবেষণায় মনোনিবেশ করতে হবে বেশি। কারণ, গবেষণায় কখনো রাতারাতি ফলাফল আসে না। গবেষণায় সাফল্য অর্জন করতে গেলে নিয়মনিষ্ঠ হতে হয়, ধৈর্য্য ধরে লেগে থাকতে হয় এবং কাঙ্ক্ষিত ফলাফল না পাওয়া পর্যন্ত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হয়। গবেষণায় কোনো শর্টকাট পদ্ধতি নেই।
ইত্তেফাক : স্বাধীনতা-পরবর্তী সরকারগুলো কেন পিএইচডি গবেষকদের জন্য পর্যাপ্ত বা প্রত্যেক গবেষককে অর্থ সহযোগিতার ব্যবস্থা করেনি?
ড. খুরশিদ আলম :স্বাধীনতা-পরবর্তী সরকারগুলো দেশের জরুরি চাহিদা মেটানোর মতো অর্থই জোগাড় করতে পারেনি। তখন দেশে দারিদ্র্য ছিল শতকরা ৮০ ভাগ পর্যন্ত, কোনো কোনো জেলায় ছিল তার চেয়েও বেশি। সুতরাং, এটি তখন সরকারের অগ্রাধিকারে ছিল না। এমনকি সামাজিক বিজ্ঞানের গবেষণা এখনো সরকারের পূর্ণ অগ্রাধিকার পায়নি, যদিও প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, বিশেষ করে কৃষি যথেষ্ট অগ্রাধিকার পেয়েছে।
ইত্তেফাক : একজন সফল গবেষক হিসেবে কেমন বাংলাদেশ দেখতে চান?
ড. খুরশিদ আলম :বাংলাদেশকে একটি উন্নত জ্ঞানভিত্তিক সমাজ হিসেবে দেখতে চাই। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর কাতারে দেখতে চাই। বিশ্বের সম্মানিত একটি জাতি হিসেবে দেখতে চাই। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এটি অর্জন সম্ভব।
ইত্তেফাক :আপনাকে ধন্যবাদ।
ড. খুরশিদ আলম :ধন্যবাদ।