রোববার, ২৮ মে ২০২৩, ১৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

আবেগমাখা ঝলমলে একটি শিশু

আপডেট : ১৮ অক্টোবর ২০২২, ০০:৩০

আবেগমাখা, ভালোবাসার অনবদ্য একটি নাম শেখ রাসেল। ১৯৬৪ সালে ১৮ অক্টোবর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে ইতিহাসের মহানায়ক আমাদের জাতির পিতা শেখ মুজিব ও বেগম মুজিবের কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলের জন্ম হয়। শেখ মুজিব তখনো বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেননি। কিন্তু তদানীন্তন পাকিস্তানের রাজনীতির অঙ্গনে কিংবদন্তি হয়ে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছিলেন। বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হিসেবে তিনি পথ দেখিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। ১৯৬৪ সালটি ছিল ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ। আইয়ুব শাহির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর শেখ মুজিব ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে কাজ করছিলেন। সর্বদলীয়ভাবে ফাতেমা জিন্নাহকে প্রার্থী করা হয়েছিল আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে। 

শেখ রাসেল যেদিন জন্ম নেয়, সেদিন শেখ মুজিব নির্বাচনি প্রচারণার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। শিশু পুত্রের জন্মসংবাদ শুনে তিনি নাম রাখেন শেখ রাসেল। এই নামটি রাখার পেছনে একটি কারণ ছিল। তা হচ্ছে বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ দার্শনিক, যুক্তিবিদ, গণিতবিদ, ইতিহাসবেত্তা, সমাজকর্মী, সমাজ-সমালোচক এবং অহিংসবাদী মহান পুরুষ বার্ট্রান্ড আর্থার উইলিয়াম রাসেলের অনুরাগী ভক্ত ছিলেন শেখ মুজিব। তার স্বপ্ন ছিল, কনিষ্ঠ পুত্র যেন বার্ট্রান্ড রাসেলের মতো হয়ে ওঠেন। তাই বার্ট্রান্ড রাসেলের নামানুসারেই কনিষ্ঠ পুত্রের নাম রাখেন। বার্ট্রান্ড রাসেল ১৯০০ সালের শুরুতে ব্রিটিশদের আদর্শবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ নেতৃত্ব দেন। তাকে বিশ্লেষণী দর্শনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বিবেচনা করা হয়; এর অন্যান্য প্রতিষ্ঠাতারা ছিলেন তার শিষ্য ডিটগেনস্টেইন এবং পূর্বসূরি ফ্রেগে। বার্ট্রান্ড রাসেল ছিলেন একজন প্রখ্যাত যুদ্ধবিরোধী মানবতাবাদী ব্যক্তিত্ব। তিনি সাম্রাজ্যবাদনীতিকে ঘৃণা করতেন। রাসেল তার অহিংসবাদ মতবাদ প্রচারের জন্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জেলবন্দি হন। তিনি হিটলারের বিরুদ্ধেও প্রচারণা চালান। ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকান ভূমিকারও সমালোচনা করেন। বার্ট্রান্ড রাসেলের জীবনাদর্শ অনুশীলন করে আমাদের মহান নেতা শেখ মুজিব তার পুত্রের নাম শেখ রাসেল রেখেছিলেন। শেখ রাসেল যেন হয়ে ওঠে বাংলার বার্ট্রান্ড রাসেল। শেখ রাসেল কী হতে পারত, তা আমাদের কারো জানা না থাকলেও একটা প্রত্যাশার অপমৃত্যু ঘটেছে, সেটা বলা যেতেই পারে। 

শেখ পরিবারের সবচেয়ে আদরের ফুটফুটে হাসিমাখা শিশুটি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পরিবারের অন্যান্য সদস্যের সঙ্গে নিহত হয় ঘাতকের বুলেটে। একটি সুন্দর গোলাপ যেন বিকশিত হওয়ার আগেই বিনষ্ট হয়ে যায়। কী অপরাধ ছিল নিষ্পাপ শিশুটির? এ প্রশ্ন যখন জাগে, তখন হূদয়মন্দিরে করুণ বেদনার সুর বেজে ওঠে। কত স্বপ্ন তাকে ঘিরে। রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম গ্রহণ করায় পিতার প্রত্যক্ষ স্নেহ থেকে ছিল বঞ্চিত আমাদের শেখ রাসেল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রামে ছিলেন ব্যস্ত। জেলখানা ছিল তার নিত্যসঙ্গী। বিভিন্ন সূত্রে তথা আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনার লেখা থেকে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু যখন জেলে থাকতেন, তখন বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব জেলখানায় নিয়ে যেতেন শেখ রাসেলকে পিতার সঙ্গে দেখা করাতে। পিতাকে জড়িয়ে ধরতে উদ্যত হতো, রাসেল জেলখানা থেকে পিতাকে বাড়িতে যাওয়ার বায়না ধরত। অবুঝ ঐ শিশুকে বোঝানো হতো জেলখানা তার পিতার আরেকটি বাড়ি। এমনিভাবে এক নিষ্ঠুর রাজনৈতিক পরিবেশে বেড়ে উঠছিল শেখ রাসেল। তারপর উত্তাল গণ-আন্দোলন। ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ’৭১-এ স্বাধীনতা অর্জন। নানা ইতিহাস ঘিরে শেখ রাসেল বড় হতে থাকে। এখানে একটি কথা উল্লেখ্য, ১৯৬৪ সালের মধ্য জানুয়ারিতে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান আজকের বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংগঠিত হয়েছিল। পুরান ঢাকার অসংখ্য হিন্দু পরিবার জীবন বাঁচাতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে আশ্রয় নিয়েছিল। শেখ মুজিব দাঙ্গা থামাতে কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন। অসাম্প্রদায়িক দর্শনে বিশ্বাসী শেখ মুজিব সবার প্রিয় নেতা হয়ে উঠেছিলেন। রাসেল যেদিন জন্ম নেয়, সেদিনও শেখ মুজিবের ধানমন্ডির বাড়িতে হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকে ছিল। শেখ রাসেলের জন্মসংবাদে আনন্দোচ্ছ্বাসে মেতে উঠেছিল সবাই। শুভাকাঙ্ক্ষী অনেকেই ফুলেল শুভেচ্ছা জানাতে ৩২ নম্বরে এসেছিল। সে এক বিস্ময়কর আনন্দমাখা দৃশ্য। 

দেশ স্বাধীন হলো। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দেশের হাল ধরেছেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশকে পুনর্গঠনে অক্লান্ত পরিশ্রম করে বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন দেশে সফরের আমন্ত্রণ পাচ্ছেন। বেশির ভাগ সময়ই সফরসঙ্গী হিসেবে আদুরে কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলকে নিয়ে যেতেন বিদেশে। প্রাণচাঞ্চল্য ভরপুর শিশু রাসেল সফর উপভোগ করত আয়ত মনে। তার চাহনিতে বীরত্বের ছাপ। জন্মের পর বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শেখ রাসেল দেখেছে তার পিতার বাগ্মিতা। ভালোবাসার অনন্তবাস হিসেবে ৩২ নম্বর হয়ে উঠেছিল তীর্থভূমি। অসংখ্য নেতাকর্মীর সংস্পর্শে শেখ রাসেল শিশু বয়সেই মানবিক পথের যাত্রী হিসেবে বেড়ে উঠছিল। রাজনীতির কিছু না বুঝলেও অনন্য উদ্দীপনা ছিল শিশু চরিত্রের লক্ষণীয় বিষয়। বাসায় খেলা করত আনন্দচিত্তে। কে জানত অমানিশার অন্ধকার নেমে আসবে শিশু বয়সে! ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মাত্র ১১ বছরের মায়াবী মুখখানি হারিয়ে যায় জগৎ থেকে। নির্দয় ঘাতক দলের এতটুকু করুণা হয়নি। শিশু রাসেল বাঁচতে চেয়েছিল! ঘাতকরা ৩২ নম্বরে অবস্থানরত পরিবারের সকল সদস্যকে হত্যার পর শেখ রাসেলকে সর্বশেষ শিকারে পরিণত করে। 

প্রত্যক্ষদর্শী বঙ্গবন্ধুর এপিএস মোহিতুল ইসলামের বর্ণনানুযায়ী শেখ রাসেল বলেছিল, ভাইয়া আমাকে মারবে না তো? মুহিতুল কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলেছিলেন না, ‘তোমাকে মারবে না ভাইয়া’; রাসেল মায়ের কাছে যেতে চেয়েছিল; তাকে মায়ের মৃতদেহের পাশেই ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে খুনিরা। কী নির্মম বীভত্সতা! ৩২ নম্বরে হত্যাযজ্ঞের ভয়াবহ দৃশ্য দেখে রাসেল ভীত হলেও বাঁচার আকুতি ছিল প্রচণ্ড। ওরা বাঁচতে দেয়নি শেখ রাসেলকে। সেদিনের রাসেলের সে কথাগুলো আজও কল্পনার জগতে করুণ সুরের বিউগিলে হৃদয়মন্দিরে হানা দেয় বারবার, কী অপরাধ ছিল রাসেলের? পরিবারে সব সদস্যকে হত্যার দৃশ্য শিশু বয়সে সে প্রত্যক্ষ করেছে। তার পরও সে কি ভাবতে পেরেছিল, তাকেও চলে যেতে হবে পৃথিবী থেকে? মনুষ্যত্ব বিবেক কোথায় নেমেছিল সেদিন? বিশ্ববিবেক নাড়া দিলেও ঘাতক ও তাদের অনুসারীদের নাড়া দেয়নি কখনো। আর তাই একজন নেত্রীর ভুয়া জন্মদিন পালন করা হয়, উল্লাসে মেতে ওঠে একশ্রেণি। ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েও তাদের লজ্জা হয় না। শেখ রাসেল আমাদের মধ্যে নেই সশরীরে। কিন্তু তার আত্মা অপ্রকট। আত্মার স্পর্শ কী অনুভব করা যায়? এটা অচিন্তক চিন্তার সাহায্যে ধরা যায় না। আত্মাকে বাক্য দিয়ে ধরে রাখতে না পারলেও ঘুরেফিরে আসে তার অনন্ত মহিমা। আমরা শেখ রাসেলকে বাঁচাতে পারিনি, এ অপরাধবোধেই শেখ রাসেল চিরজীবী হয়ে থাকবে বাঙালির অন্তরে। প্রতিটি শিশুর অবয়বে শেখ রাসেল জীবন্ত প্রতীক।  

লেখক : খাদ্যমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার

ইত্তেফাক/ইআ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন