আইনি জটিলতা বা জন্মভূমি নিতে না চাওয়ায় মৃত্যুর পর এক দশক ধরে মর্গের হিমঘরেই পড়ে আছে তাদের লাশ। জটিলতায় আটকে গেছে অন্তিম শয়ান। তাই তাদের ঠাঁই হয়েছে হাসপাতালের লাশকাটা ঘরে। বছরের পর বছর হিমঘরে কাটিয়ে দিচ্ছেন তারা। অনুসন্ধানে এমন ছয় বিদেশির সন্ধান মিলেছে, যাদের মধ্যে দুই জন সর্বোচ্চ এক দশক আর এক জনের লাশ সর্বনিম্ন দেড় বছর হিমঘরের ফ্রিজে বন্দি আছে।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গের ফ্রিজে আছে চারটি লাশ, যারা সবাই মিয়ানমারের নাগরিক। এদের এক জন বৌদ্ধধর্মাবলম্বী এবং তিন জন মুসলমান। আর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গের ফ্রিজে আছে দুটি লাশ। এর একটি দক্ষিণ আফ্রিকার মেয়ে থিইসিয়া সিকেওয়েস্টের, অপরটি পাকিস্তানি নাগরিক মোহাম্মদ আলীর।
দীর্ঘ সময় ধরে মর্গে কীভাবে লাশগুলো পড়ে আছে, তা জানতে একাধিক আইনজীবী, ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ, আইনের শিক্ষক, অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক, কারা কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেও কোনো সদুত্তর মেলেনি। অনেকে অভিজ্ঞতা আর ধারণা থেকে সমাধানের পথ বাতলে দিয়েছেন।
২০১২ সালের ১৭ জুন মো. তৈয়ব (২০) নামে মিয়ানমারের এক নাগরিকের লাশ চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানার কনস্টেবল রফিকুল আলম চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ মর্গে নিয়ে আসেন। পাঁচলাইশ থানার একটি জিডির (৯৭০, ১৭/০৬/২০১২) ভিত্তিতে লাশের ময়নাতদন্তও হয়। কিন্তু সেই লাশ আর কেউ নিতে আসেননি। তখন থেকে হিমঘরের ফ্রিজে তৈয়বের লাশ। এর আগে একই বছরের ১২ জুন কালা হোসেন (৫০) নামে মিয়ানমারের আরেক নাগরিকের লাশ মর্গে আনেন পাঁচলাইশ থানার কনস্টেবল বিদ্যালাল চাকমা। এই লাশটাও একটা জিডির (৬৫৫, ১২/০৬/২০১২) ভিত্তিতে আনা হয়। কালা হোসেনের লাশের ময়নাতদন্তও সম্পন্ন হয়। কিন্তু লাশটি আর কেউ নিতে আসেননি। একইভাবে ২০১৪ সালের ২৩ জুন সহিমঁ থো (৫০) নামে মিয়ানমারের এক বুড্ডিস্ট নাগরিকের লাশ মর্গে আনেন পাঁচলাইশ থানার কনস্টেবল শুভাশীষ বড়ুয়া। এই লাশও একই থানার একটি জিডির (১২৩৯, ২৩/০৫/২০১৪) ভিত্তিতে আনা হয়। ২০১৭ সালের ১৫ মে হাফেজ সিরাজ (৫০) নামে মিয়ানমারের আরেক নাগরিকের লাশ মর্গে আনেন কনস্টেবল হাবিব উল্লাহ। একটি জিডির (১০৫০, ১৪/০৫/২০১৭) ভিত্তিতে সিরাজের লাশ মর্গে ময়নাতদন্ত করা হয়। সেই থেকে এই চারটি লাশ চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ মর্গের হিমঘরে পড়ে আছে।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ মর্গে ডোমের দায়িত্ব পালনকারী মো. কদম আলী বলেন, ‘আমি প্রায় ২৫ বছর ধরে ডোমের কাজ করছি। এর মধ্যে অনেক লাশ এসেছে, চলে গেছে। কিন্তু এই চারটি লাশ কেউ নেয় না, কেউ খোঁজও নেয় না। স্যারদের কাছ থেকে যত দূর শুনেছি, মিয়ানমার দূতাবাসে জানানো হয়েছে, তারা কোনো উত্তর দেয় না।’
লাশগুলোর ব্যাপারে থানা বা আদালতকে অবহিত করা হয়েছে কি না, জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সহকারী অধ্যাপক ডা. সুমন মুত্সুদ্দী বলেন, এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। পুলিশও যেন এই লাশগুলোর কথা ভুলে গেছে।’ পাঁচলাইশ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) নাজিম উদ্দিন মজুমদার বলেন, ‘আমি ছয় মাস হলো এই থানায় এসেছি, তাই এ ব্যাপারে কিছুই জানি না। তবে আমি এ বিষয়ে খোঁজখবর নেব।’
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থানার দেবীপুর গ্রামের বাসিন্দা দক্ষিণ আফ্রিকাপ্রবাসী এক ব্যক্তিকে বিয়ে করেছিলেন ঐ দেশের নাগরিক থিইসিয়া সিকেওয়েস্টকে। মোহাম্মদ হাসানুজ্জামান নামে ঐ ব্যক্তি স্ত্রীকে নিয়ে ২০১৫ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশে আসেন। কিন্তু কয়েক মাস পর ২০১৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মৃত্যু হয় থিইসিয়ার। থিইসিয়ার স্বামীকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করা হয় তখন। কুমিল্লা সদর হাসপাতালে তার ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছিল, তাতে থিইসিয়ার শরীরে কীটনাশকের উপস্থিতি পেয়েছিলেন চিকিত্সকেরা।
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) শুভ রঞ্জন চাকমা বলেন, ‘ঐ মামলায় পুলিশ মোহাম্মদ হাসানুজ্জামানের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছিল। কিন্তু গত জুলাই মাসে হাসানুজ্জামান মারা যান। এখন বিষয়টি আদালতের এখতিয়ারাধীন। আমাদের পক্ষে এখন আর কিছু করা সম্ভব না। কীভাবে লাশের সুরাহা হবে, তাও আমরা জানি না।’
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গের ইনচার্জ মোহাম্মদ সেকান্দার আলী বলেন, ২০১৬ সাল থেকে মরদেহটি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গের হিমাগারে পড়ে আছে। কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজে ঐ সময় মর্গের ব্যবস্থা ছিল না, সেজন্য দক্ষিণ আফ্রিকার নাগরিক এই নারীর মরদেহ এখানে পাঠানো হয়। তখন থেকেই থিইসিয়ার লাশ নিতে কেউ আসেনি, তার বাংলাদেশি স্বামী কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকা স্বজন—কেউই আসেনি লাশ নিতে। বাংলাদেশে দক্ষিণ আফ্রিকার কোনো দূতাবাস নেই। থিইসিয়ার নিজের দেশ থেকেও কোনো সন্ধানপ্রত্যাশী আসেনি তার খোঁজে। ফলে লাশটি হিমঘরের ফ্রিজেই পড়ে আছে।
গত বছরের ১৯ জুন কারাবন্দি পাকিস্তানি নাগরিক মোহাম্মদ আলী (৪৫) ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় মারা যান। ঐ দিনই লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। সেই থেকে লাশটি মর্গের হিমঘরের ফ্রিজে রয়েছে। মর্গের ইনচার্জ মোহাম্মদ সেকান্দার আলী বলেন, ‘কোন মামলায় তিনি বন্দি ছিলেন, সেই তথ্য আমাদের কাছে নেই।’
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক রবার্ট মাইরন বার্কারের মৃতদেহ চার বছর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে থাকার পর গত ২৪ জুন গাজীপুরের একটি চার্চে সমাহিত করা হয়। পেশায় এক জন বিদেশি উন্নয়নকর্মী বার্কারের সঙ্গে বাংলাদেশি মাজেদা খাতুনের বিয়ে হয় ২০১৪ সালের ১ এপ্রিল। ২০১৮ সালের ২৫ মে চিকিত্সাধীন অবস্থায় ঢাকার দক্ষিণখানের একটি হাসপাতালে তিনি মারা যান। ময়নাতদন্তের পর তাকে কোথায় সমাহিত করা হবে, তা নিয়ে জটিলতা শুরু হয়। বিদেশি নাগরিক হওয়ায় দূতাবাসের ছাড়পত্র ছাড়া তার লাশ এ দেশে সত্কার করা যাচ্ছিল না। গত বছর বার্কারের বাংলাদেশি স্ত্রী মাজেদা খাতুন বলেছিলেন, বার্কারের অসুস্থতা ও মৃত্যুর সংবাদ যুক্তরাষ্ট্রে তার পরিবারকে জানানো হলেও কেউ ফিরতি কোনো যোগাযোগ করেনি। ফরেনসিক বিভাগের রিপোর্ট অনুযায়ী এই ব্যক্তির নাম রবার্ট মাইরন বার্কার। প্রায় চার বছর অমীমাংসিত থাকার পর গত জুনে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস ও পুলিশের মাধ্যমে গাজীপুরের মাওনায় একটি চার্চে তাকে সমাহিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন দক্ষিণখান থানার ওসি তদন্ত আজিজুল হক মিয়া।
বছরের পর বছর বিদেশিদের লাশ মেডিক্যালের মর্গে পড়ে আছে। কীভাবে এর সুরাহা হতে পারে জানতে চাইলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে দীর্ঘদিন ফরেনসিক বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব পালনকারী, বর্তমানে মিটফোর্ড মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সোহেল মাহমুদ বলেন, ‘মর্গে কোনো লাশ থাকলে যে কর্তৃপক্ষ এনেছে, সেই কর্তৃপক্ষকে তাগাদা দেওয়া ছাড়া ফরেনসিক বিভাগের আর কিছুই করার নেই। সেই কর্তৃপক্ষ যদি সাড়া না দেয়, তার পরও লাশ হস্তান্তরের কোনো সুযোগ ফরেনসিক বিভাগ নিতে পারে না। যত কষ্টই হোক বা যত দিন লাগুক, লাশ রাখতেই হবে। যারা এনেছে, অর্থাত্ পুলিশ বা জেল কর্তৃপক্ষ তাদের আমরা বলতে পারি, লিখতে পারি। এর বাইরে আমাদের হাতে আর কোনো ক্ষমতা নেই।’