রোববার, ১১ জুন ২০২৩, ২৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

কল্যাণ ট্রাস্ট: ৬ নম্বর ধারাটা একটু দেখতে হবে

আপডেট : ২২ অক্টোবর ২০২২, ০৩:৩১

কিছুটা ভুরু কোঁচকানো ব্যাপার, তবে কথাটা মিথ্যেও নয়। দেশে সাংবাদিকদের কল্যাণের কথা ভেবেই সরকার একটা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করার উদ্যোগ নিয়েছিল। সেই উদ্দেশ্যেই সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট আইন, ২০১৪ প্রণয়ন করা হয়েছে এবং সেমূলেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট’। সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট আইনের ৬ নম্বর ধারাটা একটু দেখতে হবে, কেননা সেখানেই বলা রয়েছে এই ট্রাস্টের গঠনকাঠামো। আইনের এই ৬ নম্বর ধারাতেই নির্ধারণ করা হয়েছে কারা হবেন এই কল্যাণ ট্রাস্টের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য। ধারা ৬ অনুযায়ী মোট ১৩ জন সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত হবে ট্রাস্টি বোর্ড। এই ১৩ জনের মধ্যে মাত্র পাঁচ জন সাংবাদিক, আর সাত জন আমলা, আর আছেন তথ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মহোদয়, যিনি এই ট্রাস্টের চেয়ারম্যান, তার পদাধিকার বলে। মজার বিষয় হলো ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যদের মধ্যে যে পাঁচ জন সাংবাদিক, তাদের মধ্যে ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন মনোনীত সাংবাদিক রয়েছেন মাত্র দুই জন, আর বাকি তিন জন? তারা, আইনবলে, সরকারমনোনীত সাংবাদিক!

অনেকে হয়তো ভাবতে পারেন, পাঁচ-পাঁচ জন সাংবাদিক তো সাংবাদিকদের কল্যাণ দেখার জন্য যথেষ্টই! সেক্ষেত্রে আমার অনুরোধ, এই আইনে দেওয়া সাংবাদিকের সংজ্ঞাটিতে একবার নজর বোলান। ২০১৪ সালের এই কল্যাণ ট্রাস্ট আইনে সাংবাদিকের সংজ্ঞা দিয়ে বলা হয়েছে, সাংবাদিক হচ্ছেন এমন ব্যক্তি, যিনি ‘একজন সার্বক্ষণিক সাংবাদিক এবং যিনি প্রিন্ট অথবা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কাজে নিয়োজিত আছেন এবং কোন সম্পাদক, সম্পাদকীয় লেখক, সংবাদ সম্পাদক, উপ-সম্পাদক, ফিচার লেখক, রিপোর্টার, সংবাদদাতা, কপি টেস্টার, কার্টুনিস্ট, সংবাদ চিত্রগ্রাহক, ক্যালিওগ্রাফিস্ট এবং প্রুফ রিডারও ইহার অন্তর্ভুক্ত হইবে’। এরপরেও যদি মনে হয় আমি হাবিজাবি বকছি, কারণ সংজ্ঞায় তো একজন ‘সার্বক্ষণিক’ সাংবাদিকের কথা বলা রয়েছেই; সেক্ষেত্রে আমাদের দেশের বাস্তবতাটা একটু আমলে নিলে দৃশ্যপট কিছুটা পরিবর্তন হবে আশা করি।

এই আইনে সাংবাদিকের এমন ‘সরল’ সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এবং সেখান থেকে সাংবাদিক মনোনয়ন করে ট্রাস্টি বোর্ডে অন্তর্ভুক্ত করার যে ব্যবস্থা তা এতটাই বিস্তৃত আঙ্গিকে করা হয়েছে, তাতে এই আইন দিয়ে সাংবাদিকদের কল্যাণ আদৌ হবে কি না বা হলেও তা কতটুকু হবে সেই বিষয়টা ভাববার বিষয় হয়েই দাঁড়ায়। ১৩ সদস্যের বোর্ডে সাংবাদিকদের নির্বাচিত প্রতিনিধি মাত্র দুজন রাখলে, সাংবাদিকদের উন্নয়ন কেমন প্রয়োজন, কী প্রয়োজন তার সঠিক বিচার-বিশ্লেষণ আর হিসাব মেলানো যাবে না, যাওয়ার কথাও নয়। সরকার হয়তো বর্তমান বোর্ডে সঠিক ব্যক্তিদেরই রেখেছেন, তবে পাঁচ আর দুইয়ের এই অনুপাত না বদল করলে ভবিষ্যতে যে এই আইনের অপব্যহার হবে না, তা কোনোভাবেই বলা যায় না।

শুধু সাংবাদিক নন, কল্যাণ ট্রাস্ট আরো রয়েছে। ইমান ও মুয়াজ্জিন কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ শিল্পী কল্যাণ ট্রাস্ট, বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষক কল্যাণ ট্রাস্ট ইত্যাদি গঠন করেছে সরকার, আইন করেই। আইন আছে, ট্রাস্টও আছে। এসব পেশাজীবীর কল্যাণ ট্রাস্ট ছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর কল্যাণ ট্রাস্ট, যেমন হিন্দুধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট, বৌদ্ধধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট, খ্রিষ্টধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট। পেশাজীবী আর ধর্মীয় ট্রাস্ট ছাড়াও অনেক ট্রাস্ট আছে—মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট তার মধ্যে অন্যতম। এসব ট্রাস্টের মধ্যে স্পষ্টভাবেই শ্রেণীকরণ করা যায় এবং পেশাজীবী আর ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের ভিত্তিতে ভাগ করলে প্রত্যেক বিভাগে কমপক্ষে তিনটি করে ট্রাস্ট রয়েছে। এসব ট্রাস্টের গঠনপ্রণালি লক্ষ করলে পেশাজীবীদের ট্রাস্ট আর ধর্মীয় ট্রাস্টের ট্রাস্টি বোর্ডের গঠনপ্রণালির যে বিস্তর ফারাক তা স্পষ্টই বোঝা যায়। ধর্মীয় ট্রাস্টগুলোর সবগুলোতেই যেই ধর্মের কল্যাণে ট্রাস্ট, ট্রাস্টি বোর্ডে সেই ধর্মের বিশিষ্ট নাগরিকের সংখ্যা কমপক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ। অর্থাত্ ১২ জন সদস্য হলে এসব ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টে ট্রাস্টি বোর্ডে সদস্য হিসেবে সেই ধর্মের মানুষ থাকবেন আট জন। কিন্তু পেশাজীবীদের কল্যাণ ট্রাস্টগুলোতে সেটা দেখা যায় না। শুধু বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষক কল্যাণ ট্রাস্ট ছাড়া অন্য পেশাজীবীদের কল্যাণে গঠিত ট্রাস্টগুলোর ট্রাস্টি বোর্ডে সংশ্লিষ্ট পেশার ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্তি মোট ট্রাস্টি সংখ্যার অর্ধেকেরও কম।

বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষক কল্যাণ ট্রাস্ট নামে যে ট্রাস্ট রয়েছে সেখানে ট্রাস্টি বোর্ডের মোট সদস্য ১৫ জন এবং এর মধ্যে শিক্ষক রয়েছেন ৯ জন। সেই আইনে কমপক্ষে দুই জন নারী শিক্ষক রাখারও বিধান রয়েছে। এই কল্যাণ ট্রাস্ট সঠিকভাবে কাজ করছে কি করছে না, সেটা দেখার অন্য লোক নিশ্চয়ই আছেন, তবে আমরা বলতে পারি, এমন আইনে শিক্ষকদের উপকার না হলেও অপকারের আশঙ্কা অনেকাংশেই কম।

অন্যান্য পেশাজীবীর কল্যাণে গঠিত ট্রাস্ট আর সাংবাদিকদের কল্যাণে গঠিত ট্রাস্টের প্রভাব সামাজিক বা রাজনৈতিক, কোনো পাল্লাতেই এক হবে না। যুক্তি আসতে পারে, কল্যাণ ট্রাস্ট দিয়ে নিশ্চয়ই কোনো পেশাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, তবে এ কথাও মিথ্যা নয়, কল্যাণ ট্রাস্ট দিয়ে পেশা নিয়ন্ত্রণ না করা গেলেও এতে করে সেই পেশাকে প্রভাবিত করার সুযোগ তৈরি হয়। আর সংবাদিকতা পেশাকে প্রভাবিত করার ফলাফল কোনো বিচারেই ভালো হয় না।

অনেক বিশিষ্টজনই বলেছেন, আমরা শুধু বর্তমান নিয়েই চিন্তা করি, ভবিষ্যৎ না ভেবেই। এমন চিন্তা আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে একটা বড় ঝমেলার ক্ষেত্র তৈরি করে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকার বা সরকারের পলিসি বদল হবে, এটাই স্বাভাবিক, সুতরাং শুধু বর্তমানের লাভের আশায় বা বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে কোনো আইন করা হলে তাতে শেষ পর্যন্ত লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

ইত্তেফাক/জেডএইচডি

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন