শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

যেভাবে মাত্র দেড় মাসেই পর্দা নামে ট্রাস ফ্যান্টাসির

আপডেট : ২২ অক্টোবর ২০২২, ০৪:০০

মাত্র ৪৫ দিনের মাথায় থেমে যেতে হলো যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসকে। বহু জল্পনাকল্পনা ও নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে সিংহাসনে বসা ট্রাস ঘুণাক্ষরেও আন্দাজ করতে পারেননি যে, মাত্র দেড় মাসের জন্য তিনি অফিসে বসার সুযোগ পাবেন! ‘১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রেট থেকে আমি প্রস্থান করার জন্য তৈরি’—এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে লিজ ট্রাস এক বিরল ইতিহাসের নজির গড়েন। ব্রিটিশ ইতিহাসে সবচেয়ে কম সময়ের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করার রেকর্ডের ঘরে উঠে যায় লিজ ট্রাসের নাম।

বলতেই হয়, বহু নাটকীয় ঘটনার মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা লিজ ট্রাসের মাত্র ছয় সপ্তাহের শাসনকালে কী না ঘটতে দেখা গেছে! মাত্র কয়েক দিনেই একের পর এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন ব্রিটেনের জনগণ। রাজার মৃত্যু, মসনদে নতুন রাজা, দেশের বাজারে অস্থিরতা, বিপর্যয়ের মুখে স্থবির হয়ে পড়া অর্থনীতি, খেয়ালি অর্থনৈতিক পরিকল্পনা, ব্রিটিশ মুদ্রা তথা পাউন্ডের স্মরণকালের দরপতন, চাপের মুখে গৃহীত নীতি-কর্মসূচি পরিত্যাগে বাধ্য হওয়া, নিজের চ্যান্সেলরকে তিরস্কার-বরখাস্ত করা, পদ থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ইস্তফা ও কার্যত সব এমপির আস্থা হারানো, সংসদে নজিরবিহীন বিশৃঙ্খলা ও হিংসাত্মক উত্পীড়নের রিপোর্ট এবং পরবর্তী নির্বাচনে জনমত জরিপের নিদারুণ কষাঘাতে নিজ দলের অবস্থানকে অস্তিত্বের সংকটে উপনীত করে প্রধানমন্ত্রীর মস্তকাবনত বিদায়—এসব একেকটি ইতিহাস হয়ে রইল ব্রিটিশ রাজনীতির ডায়ারিতে।

বরিস জনসনের বিদায়ের পর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ‘দৌড় প্রতিযোগিতায়’ বিজয়ী হওয়ার পর লিজ ট্রাসের জন্য অত্যন্ত জরুরি হয়ে ওঠে নিজ দল টোরি পার্টিকে ঐক্যের কাতারে নিয়ে আসা। কিন্তু এই কাজটি যে ট্রাসকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করাবে, এটা অজানা ছিল না কারো; এমনকি এ বিষয়ে অন্ধকারে ছিলেন না ট্রাস নিজেও। সত্যিকার অর্থেই ব্যাপক সমস্যাগ্রস্ত টোরি পার্টিকে একত্র করে দলে ঐক্য ফেরানো ট্রাসের জন্য আদৌ সহজ কাজ ছিল না। বস্তুত, ট্রাসের কপাল পোড়ার সূত্রপাত ঘটে এখান থেকেই।

ট্রাসের ক্ষমতায় আসার মধ্য দিয়ে কনজারভেটিভ ইতিহাসেও ঘটে একটি বিরল ঘটনা। নিজের সংসদীয় দলের আশানুরূপ সমর্থন পাননি ট্রাস, কিন্তু তা সত্ত্বেও নেতা নির্বাচিত হন তিনি। টোরি পার্টির জটিল ভোটিং সিস্টেম তাকে ক্ষমতায় বসার সুযোগ এনে দেয়। উপরন্তু আরো কিছু হিসাবনিকাশের যোগফল ট্রাসকে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসাতে দারুণভাবে কাজে দেয়। তবে ক্ষমতায় আসার পর নিজ দলকে একত্রিত করা এবং সরকারে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর কার্যকারিতাকে গুরুত্ব দিয়ে মতৈক্যের সেতু নির্মাণের পথে না হেঁটে ভুলভাল সব সিদ্ধান্তের রাস্তা ধরেন ট্রাস। তাত্ক্ষণিক নানা বিদ্বেষের সূত্রপাত ঘটিয়ে ঘরেবাইরে বিরক্তি ছড়াতে শুরু করেন তিনি। মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নিজের পছন্দের লোকজনকে বসিয়ে নিজের বিরুদ্ধে বিরোধীদের অভিযোগের তির ছোড়ার কাজটি সহজ করে দেন ট্রাস। সমালোচনা শুরু হয়—ট্রাস এবং তার দল অনভিজ্ঞ, বিকলাঙ্গ এবং অযোগ্য।

ট্রাসের যোগ্যতা-দক্ষতার প্রতি ব্যাপকভাবে আঙুল উঠতে থাকে, যখন তিনি ও তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু কোয়াসি কোয়ার্তাংয়ের, যাকে তিনি অর্থমন্ত্রীর পদে বসিয়ে সমস্যার যবনিকাপতন ঘটাতে চেয়েছিলেন, একাডেমিক অর্থনৈতিক তত্ত্বগুলোর বাস্তব প্রয়োগ বিফল হতে শুরু করে। গত মাসের মাঝামাঝি সময়ে ট্রাস ও কোয়ার্তাং যে ‘ট্রাসোনমিক্স (বিশেষ উন্নয়ন পরিকল্পনা)’ ধারণা নিয়ে হাজির হন, তার ধাক্কায় ব্রিটেনের অর্থনীতিকে ঘিরে ধরে ঘন কালো মেঘ। এই পরিকল্পনায় সর্বোচ্চ কর ছাড়ের পাশাপাশি জাতীয় বিমা পরিকল্পনা এবং স্ট্যাম্প শুল্কের মতো বিষয়গুলোতেও ছাড় দেওয়ার কথা বলা হয়। ব্যাপক সরকারি ঋণের মাধ্যমে অর্থায়ন করা এই পরিকল্পনা স্থবির অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করবে বলে যে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়, বাস্তবে ঘটে তার উলটোটা। পরিকল্পনাটি সরকারের ব্যাপারে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সংকটই শুধু তৈরি করে না, উপরন্তু এর কারণে পাউন্ডের মান এবং সরকারি বন্ডের মূল্য ব্যাপকভাবে কমে যায়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই পদক্ষেপ বিশ্ববাজারকে এমন মাত্রায় ধাক্কা দেয় যে বাজারকে চাঙ্গা করার জন্য ৬৫ বিলিয়ন পাউন্ডের (৭৩ বিলিয়ন ডলার) কর্মসূচি নিয়ে এতে হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হয় খোদ ব্যাংক অব ইংল্যান্ড।

অবস্থা যতই খারাপ হতে থাকে, একের পর এক ভুল পদক্ষেপ নিতে থাকেন ট্রাস। বাস্তবিক অর্থেই, সমস্যা-সংকট মোকাবিলায় জুতসই ব্যবস্থা গ্রহণের পরিবর্তে ট্রাস লাগাতার নির্মম প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করতে শুরু করেন। তিনি তার ‘কমরেড-ইন-আর্মস’ অর্থমন্ত্রী কোয়াসি কোয়ার্তাংয়ের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেন। সংকট সমাধানে ব্যর্থ কোয়ার্তাং পদত্যাগ করলে অনেকটা দিকভ্রান্ত, বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন ট্রাস। টালমাটাল পরিস্থিতিকে শান্ত করার জন্য মরিয়া ট্রাসের পক্ষে মাঠে নামেন নতুন অর্থমন্ত্রী জেরেমি হান্ট। হান্ট কিছু সময়ের জন্য অর্থনীতিতে কিছুটা স্বস্তি ফিরিয়ে আশা জাগাতে পেরেছিলেন বটে; কিন্তু সংকট নিরসন কিংবা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তা যথেষ্ট ছিল না ততটা। বরং কনজারভেটিভদের মধ্যে নতুন করে প্রশ্ন উঠতে থাকে—লিজ ট্রাসের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ব্যর্থ ও পরিত্যক্ত হওয়ার পর তার ক্ষমতায় থাকার নৈতিক ভিত্তি কিংবা যৌক্তিকতা থাকে কী করে?

মূলত, ট্রাসের বিরোধিতাকারীরা তাকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামানোর মোক্ষম সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। ট্রাস চেষ্টার কমতি রাখেননি যদিও, কিন্তু বিভিন্ন ঘটনার বাস্তব অভিঘাতে অবস্থা দিনকে দিন ঘোলাটে হতে থাকে। নানা ঘটনা জট পাকিয়ে পরিস্থিতি ক্রমশ ট্রাসের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে শুরু করে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে অপসারণ করা যদিও সহজ কাজ নয়, তথাপি উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ট্রাসের সামনে মাত্র একটা পথই খোলা থাকে—স্বেচ্ছায় প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে যাওয়া। তবে উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, ট্রাসের পদত্যাগের পর এখন অনেকেই বলছেন—রক্ষণশীল নিয়ম-নীতিকে পুঁজি করে অন্তত বছরখানেকের জন্য হলেও নেতৃত্বের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করাই ট্রাসের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ হতো।

লিজ ট্রাসের পদত্যাগের ঘোষণার পর নাটকীয় ২৪ ঘণ্টার সাক্ষী হয়ে রইল ওয়েস্টমিনস্টার। নানা ঘটনার ঘনঘটায় নুয়ে পড়া প্রধানমন্ত্রী ট্রাসের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুয়েলা ব্র্যাভারম্যানও ভুল করে বসেন, বাধ্য হন পদত্যাগে। বলা বাহুল্য, তিনি শুধু পদত্যাগ করেই ক্ষান্ত হননি, বরং টেবিলে রেখে যান কাঁটায় ভরা পদত্যাগপত্র—বাস্তবিক অর্থে, এটিই ছিল ট্রাসের পতনের কফিনে শেষ পেরেক।

এর পরের ঘটনাগুলো ঘটতে খুব বেশি সময় লাগেনি। ডাউনিং স্ট্রিট ট্রাসের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি বিরাগ মনোভাব গড়ায় অনাস্থা প্রদর্শনের হিসাবনিকাশে। কমন্সের ভোটিং লবিতে দেখা দেয় বিশৃঙ্খলা। এর সঙ্গে বেঁকে বসা সাংসদদের প্রতি হেনস্তার অভিযোগ ওঠে। চিফ হুইপ ওয়েন্ডি মর্টন বিরক্ত হয়ে পদত্যাগ করতে চলেছেন বলে বাতাসে গুঞ্জন ছড়াতে থাকে। এসব ঘটনা যখন পর্যায়ক্রমে ঘটে চলেছে ততক্ষণে কারো বুঝতে বাকি নেই যে, আসল খেলা শেষ হয়ে এসেছে, বাকি নেই কিছুই।

একের পর এক এমপি ট্রাসকে সরকারি-বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রেই পদত্যাগ করার আহ্বান জানাতে থাকেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত পদত্যাগের মধ্য দিয়েই সমস্যার সমাধান টানতে বাধ্য হন ট্রাস। টোরি এমপিদের প্রভাবশালী ১৯২২ কমিটি চেয়ারম্যান স্যার গ্র্রাহাম ব্র্র্যাডলির সঙ্গে সাক্ষাতের পর ১০ নম্বরে দাঁড়িয়ে তিনি ঘোষণা করেন, ‘যে ম্যান্ডেটের ভিত্তিতে কনজারভেটিভ পার্টির পক্ষ থেকে আমি দায়িত্ব নিয়েছি, তার কিছুই দিতে পারিনি। তাই আমি মহামান্য রাজার সঙ্গে কথা বলেছি তাকে অবহিত করার জন্য যে, আমি কনজারভেটিভ পার্টির নেতার পদ থেকে পদত্যাগ করছি।’ ট্রাসের এই ঐতিহাসিক ঘোষণার মধ্য দিয়ে পর্দা নামে তার মাত্র ছয় সপ্তাহের শাসনামলের।

ট্রাসের এভাবে পদত্যাগের পর এখন একটাই প্রশ্ন সামনে আসছে—এরপর কী হতে চলেছে? এর উত্তরে বলতে হয়, আগামী দিনগুলোতে ব্রিটিশ রাজনীতির জন্য অপেক্ষা করছে আরো বেশি জটিলতা। পার্টির নিয়মকে কাটছাঁট না করা হলে নতুন টোরি নেতা এবং প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের প্রতিযোগিতায় আবারও ট্রাসের মতো অজনপ্রিয় নেতা নির্বাচিত হলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। এরূপ অবস্থায় সংসদীয় দলকে ঐক্যের ভিত্তিতে প্রার্থী খোঁজার বিষয়ে একমত হতে হবে সর্বাগ্রে।

সম্ভবত অতি স্বল্পসময়ের মধ্যেই ডাউনিং স্ট্রিটে বসবেন একজন নতুন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু কে সেই ব্যক্তি? ঋষি সুনাক, ব্র্যাভারম্যান পেনি মর্ডান্ট কিংবা কেমি ব্যাডেনোক? নাকি আবারও বরিস জনসন! মজার বিষয় হলো, অনেককেই ফিসফিস করতে শোনা যাচ্ছে, হিমঘর থেকে নতুনরূপে ফিরে আসতে পারেন জনসন। ব্রিটিশ রাজনীতি প্রতিনিয়ত নানা ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে যেভাবে দুলতে শুরু করেছে তাতে করে জনসনের প্রত্যাবর্তন ঘটলে তাকে ‘অসাধারণ’ বলা ছাড়া আর কী-ই বা করার থাকবে! 

লেখক: ‘দ্য হাউজ’ ম্যাগাজিনের সম্পাদক, দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফের সাবেক পলিটিক্যাল এডিটর ও ‘থেরেসা মে :দ্য এনিগম্যাটিক প্রাইম মিনিস্টার’ এবং ‘কমরেড করবিন :আ ভেরি আনলাইকলি কপ’ বইয়ের লেখক

সিএনএন থেকে অনুবাদ: সুমৃৎ খান সুজন 

ইত্তেফাক/জেডএইচডি

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন