শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

আমি তো আছি

আপডেট : ২২ অক্টোবর ২০২২, ০৪:৩৩

জীবন যেখানে যত জটিল সেখানেই যেন আনন্দ খুঁজে পায় নাহিদ। এ এক অপার্থিব আনন্দ। জটিলতার ব্যবচ্ছেদ করে উঠে আসা, নয়তো হতাশায় ডুবে যাওয়া—এই দুটোর মাঝে প্রথমটাকেই বেছে নিয়েছে সে। বেশ বিন্দাস আছে এখন।

যে মানুষটার জন্য ভয়াবহ কষ্টে ডুবে থাকত, সে মানুষটার জন্যই মায়া হয়। শব্দটা কি মায়া হবে নাকি করুণা? সম্ভবত করুণা। মায়া একটা গভীর শব্দ, অস্বচ্ছ কোনো মানুষের সঙ্গে এটা একেবারেই যায় না।

নাসির উদ্দিন সাহেব যেদিন স্ত্রী-সন্তানকে ছেড়ে চলে যান, সেদিন বিকেলে সে প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়ছিল। তার সামনে দিয়েই বাবা বেরিয়ে গেল। রাতে খাবারের সময় একটা ফোন এলো। মা উঠে নিজের ঘরে গেলেন, বেশ কিছুক্ষণ কাঁদলেন। খেয়াল করেননি পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে নাহিদ। রাহেলা বেগম ফোনে কাকে যেন বললেন, ‘আপা, ও তো মনে হয় আর ফিরবে না, একটু খেয়াল রাখবেন মানুষটা যেন বিপদে না পড়ে।’

এরপর থেকে বাবার জন্য একটা চাপা কষ্ট হতো, বিশেষ করে সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে যখন মায়ের সঙ্গে ঘুরতে বের হতো। বাবা তাকে আইসক্রিম কিনে দিত, কখনো না বলত না। কিন্তু মা এ বেলায় কেন যে এত কঠিন! মা অনেক কিছুতেই কঠিন। তার লেখাপড়া, তার বন্ধুবান্ধব, তার সুস্থতা আর ব্যবসা—এর বাইরে যেন কোনো জগত্ই চেনা নেই মায়ের। বারো-তেরো বছর পর্যন্ত লুকিয়ে লুকিয়ে কেঁদেছে—কেন মা এমন! তারও মাঝে মাঝে ইচ্ছে করত বাবার মতো চলে যেতে, মনে হতো বাবা নিশ্চয়ই এখন অনেক আনন্দে আছে! তখন বাবার প্রতি মায়া হতো, ভীষণ মায়া।

মায়ের ডায়েরি সে কখনো পড়তে চায়নি। কিন্তু এইচএসসি পরীক্ষার ঠিক আগ মুহূর্তে সব এলোমেলো হয়ে গেল, সিঁড়ি থেকে পা পিছলে পড়ে পা ভাঙল। প্রায় পনেরো দিন হাসপাতালে থাকতে হলো, পরীক্ষা দেওয়া হলো না। বিছানায় শুয়ে শুয়ে বাবাকে খুব মিস করত। মা হয়তো সেটা বুঝেছিলেন। তার ধারণা সবসময়ই মা বুঝতেন, শুধু অপেক্ষা করেছেন সঠিক সময়ের। হাসপাতালে মা খুব একটা আসতেন না। রহমান ভাই-ই থাকত সবসময়। কোনো কিছুর কমতি থাকত না, চাওয়ার আগেই সব হাজির। তারপরও শূন্যতা, তারপরও একাকীত্ব। নাহিদ ভাবত, পরীক্ষা ড্রপ হওয়াতে মা মনে হয় বিরক্ত হয়েছেন।

একদিন বিকেলে রাহেলা বেগম এলেন, হাতে একগুচ্ছ রজনীগন্ধা, ছেলের পাশে এসে বসলেন। এটা সেটা গল্প করতে করতে বললেন, ‘বল তো খোকা—কেন রজনীগন্ধা?’

নাহিদ বলল, ‘জানি না তো মা, তোমার মতো কঠিন মানুষের সঙ্গে ফুল বেমানান।’

রাহেলা বেগম ব্যাগ থেকে একটা লাল ডায়েরি বের করলেন, ছেলের হাতে দিয়ে বললেন, ‘কিছু কথা আছে কাউকে বলা যায় না, শুধু নিজেকে ছাড়া, ভেবেছিলাম তোকে বলব, কিন্তু পারলাম না। নিজের কথা না বলাটা অভ্যাস হয়ে গেছে। ইচ্ছে হলে ডায়েরিটা পড়ে নিস, মা আছি এখানে।’

এত বছর পর মায়ের চোখে জল দেখল নাহিদ। রাহেলা বেগম চলে গেলেন। অন্ধকার ঘরে শুয়ে থাকতে খারাপ লাগছে না বরং ইচ্ছে করছে এই অন্ধকারেই থেকে যেতে। আলো জ্বাললেই ডায়েরি পড়তে ইচ্ছে করবে। কী আছে ডায়েরিতে! ভাবতে ভাবতে প্রায় মাঝ রাত। আর পারল না। বাতি জ্বেলে ডায়েরির পাতা উলটাতে শুরু করল। নাহিদ হোঁচট খেল! এ তো ডায়েরি নয়, পুরো একটা অ্যালবাম! বাবা-মায়ের বিয়ের দিন থেকে শুরু করে বাবা চলে যাওয়ার দিন পর্যন্ত ওদের সুখের দিনগুলোর প্রতিটা ছবি, সঙ্গে দিন-ক্ষণ। শেষ পাতায় লেখা ‘ছবি নয়, তুই-ই আমার সুখ। যে চলে গেছে তাকে নিয়ে কিছু বলব না। শুধু জানিস তোর মা বিশ্বাস করে—সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার নামই জীবন।’

নাহিদ বাকি রাতটুকু ঘুমায়নি, মায়ের কষ্ট অনুভব করার চেষ্টা করেছে। চোখ ভিজে এসেছে বারবার।

বেশ কিছুদিন হলো ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে মায়ের ব্যবসার হাল ধরেছে অভিমানী ছেলেটা। এখন সে ভীষণ আত্মবিশ্বাসী। অফিসের প্রথম দিনই টেবিলে রাখা মায়ের ছবির দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলেছে, ‘অনেক তো হলো, এবার একটু বিশ্রাম নাও মা, আমি তো আছি।’

ইত্তেফাক/জেডএইচডি

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন