মঙ্গলবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১১ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

নিরাপদ সড়কের জন্য দ্রুত পদক্ষেপ চাই

আপডেট : ২২ অক্টোবর ২০২২, ০৫:৩২

‘আইন মেনে সড়কে চলি, নিরাপদে ঘরে ফিরি’—এই প্রতিপাদ্য নিয়ে দেশে ষষ্ঠ বারের মতো আজ ২২ অক্টোবর জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস-২০২২ পালন করা হবে। দুর্ঘটনামুক্ত নিরাপদ সড়ক যোগাযোগ গড়ে তোলাই এ দিবসের মূল উদ্দেশ্য।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কোনো মানদণ্ডেই কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাসে বাংলাদেশের সূচকের উন্নতি হয়নি। বরং অবনতি হয়েছে।

বিশ্বব্যাংক বলছে, সড়ক দুর্ঘটনার দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। আর দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে প্রথম। অথচ বাংলাদেশের চেয়ে বেশি যানবাহন যেসব দেশে চলে সেখানেও কিন্তু এত দুর্ঘটনা হয় না। প্রতিবেশী দেশ ভারতের চেয়ে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা বেশি।

ব্যক্তিগত গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য ১৬০ বর্গফুট জায়গা নেয় এবং বাইরে যতক্ষণ থাকে, তার ৯০ শতাংশ সময় পার্ক করা থাকে। গবেষণা-প্রতিষ্ঠান ‘নামবিও’ কর্তৃক প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ট্রাফিক ইনডেক্স-২০১৯-এর তথ্য অনুযায়ী, যানজটের দিক দিয়ে ঢাকার অবস্থান প্রথম। ২০১৮ সালে এর অবস্থান ছিল দ্বিতীয়। মাত্র তিন বছর আগেও ঢাকা তৃতীয় স্থানে ছিল। যানজটের মূল কারণ হিসেবে ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার বৃদ্ধিকে দায়ী করা হচ্ছে। ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ এবার ৬২টি সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সম্মিলিত উদ্যোগে বিশ্ব ব্যক্তিগত গাড়িমুক্ত দিবস পালন করলেও দিন দিন গাড়ির সংখ্যা কিন্তু বেড়েই যাচ্ছে; যা সত্যিই উদ্বেগের। কেন ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণে সরকার কঠোর হতে পারছে এর জবাব হয়তো সরকারের নীতি নির্ধারকরাই ভালো দিতে পারবেন।

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা বলছে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে মৃত্যু ১২ হাজার। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে, ২০২১ সালে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৫ হাজার ৩৭১টি। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৬ হাজার ২৮৪ জন এবং আহত হয়েছে ৭ হাজার ৪৬৮ জন। নিহতদের মধ্যে ৮০৩ জন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রী!

বিশ্বব্যাংক ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বিশ্বে সড়কপথে বাস সম্পৃক্ত দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি। দেশে সড়কপথে চলাচলরত প্রতি ১০ হাজার বাসের বিপরীতে বাস সম্পৃক্ত দুর্ঘটনায় প্রতি বছর প্রাণহানি ঘটে ২৮৭ জনের। এদিক থেকে বাংলাদেশের কাছাকাছি অবস্থানে রয়েছে কেবল জিম্বাবুয়ে। দেশটিতে প্রতি ১০ হাজার বাসের বিপরীতে বাস-সম্পৃক্ত দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ২১৭ জনের। এর বাইরে আর কোনো দেশে বাস সম্পৃক্ত দুর্ঘটনায় এত বেশি প্রাণহানির নজির নেই।

দেশে জাতীয়, আঞ্চলিক ও জেলা সড়কের বিপরীতে কত যানবাহন চলতে পারে—এ ধরনের কোনো হিসাব ছাড়াই যানবাহনের রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হচ্ছে। প্রতিদিন রাস্তায় নামছে পাঁচ শতাধিক নতুন যানবাহন। নিবন্ধিত ৫৪ লাখ যানবাহনের মধ্যে ৭০ শতাংশই হলো মোটরসাইকেল। প্রায় ৪০ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটছে এই যানে। বিপজ্জনক এই যানে একটি দেশের মূল জনশক্তি হিসেবে বিবেচিত তরুণদের মৃত্যু আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে; যা সত্যিই বড় রকমের উদ্বেগের কারণ। তাই এই মৃত্যুযান নিয়ন্ত্রণে আরো কঠোর হওয়ার বিকল্প নেই।  

সারা দেশে নিরাপদ সড়কের দাবিতে সাম্প্রতিক সময়ে দুই দফা আন্দোলনের পর সরকার সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাসে পরামর্শ দিতে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে। সেই কমিটি পুরোনো সুপারিশের আলোকে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ১১১ দফা সরকারের কাছে জমা দেয়। সুপারিশে নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি নানামুখী প্রকল্প নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে এসব সুপারিশ বাস্তবায়নের কথা ছিল।

সেসব কাজ কত দূর? সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনার চিত্র কিন্তু সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়েছে বা হচ্ছে তা বলছে না। অর্থাত্ সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে মাঠের অবস্থাই প্রমাণ দেবে। দুর্ঘটনা কমবে। তা হয়নি। কয়েকটি মহাসড়কে রাস্তার বাঁক সোজা করা ছাড়া কাজের কাজ কিছু হয়েছে বলে জানা নেই।

সড়ক দুর্ঘটনা রোধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও কয়েকটি নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেসব নির্দেশনা সপ্তাহ খানেক বাস্তবায়নের পর ডিপ ফ্রিজে চলে গেছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ এখন পর্যন্ত পুরোপুরি কার্যকর করা গেল না। আইনের শাস্তিযোগ্য প্রায় ২৯টি ধারা নিয়েই আপত্তি জানিয়েছে পরিবহন মালিক ও শ্রমিক নেতারা। সরকার সেগুলো বছরের পর বছর ধরে সংশোধনের জন্য তালাবন্দি করে রেখেছে। এর সুরাহা চাই।  কথা হলো সড়ক নিরাপত্তার জন্য সব সিদ্ধান্তই কি একসঙ্গে বাস্তবায়ন করতে হবে? মোটেই না। কিছু সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করলেই কিন্তু পরিস্থিতির দৃশ্যমান উন্নতি ঘটানো যায়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে, সবার আইন মানা বাধ্যতামূলক করতে হবে অর্থাত্ আইন সমার জন্য সমান। চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স, গাড়ির ফিটনেস ও রেজিস্ট্রেশন ছাড়া কোনো যানবাহন চলতে দেওয়া যাবে না। নিষিদ্ধ যান চলাচল বন্ধ ও উত্পাদন বন্ধের বিকল্প নেই। মোটরসাইকেল চলাচলে নিয়ন্ত্রণ আনা। চালক ও শ্রমিকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ ও ট্রাফিক আইন, দুর্ঘটনা সম্পর্কে সচেতন করা, সড়কের সাইন-সিগন্যাল সম্পর্কে আলাদা প্রশিক্ষণ। সড়কের কারিগরি ত্রুটি দূর করা ও রাস্তা সংস্কার করতে হবে। স্পিড গান বাড়ানোসহ স্বয়ংক্রিয়ভাবে দ্রুত গতির যান চলাচল রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া। সড়কে সিসিটিভি স্থাপনসহ মনিটরিং জোরদার করা।

নানা অনিশ্চয়তার মধ্যে হাত গুটিয়ে বসে থাকার কিন্তু কোনো সুযোগ নেই। সড়ক যেমন নিরাপদ করতে হবে তেমনি গণপরিবহন বাড়িয়ে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা কমানোর চিন্তা মাথা থেকে ছেড়ে ফেলে দিলে চলবে না। দুটি কাজই কঠিন। তাই বাস্তবায়নে অনেক চ্যালেঞ্জ বা বাধা আসবে। কিন্তু একটি দেশের মেগাসিটি ঢাকার অবস্থান যদি সবসময় যানজটের শীর্ষে থাকে তবে শহরের মানুষের দুর্ভোগই বাড়ে না, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। তাছাড়া দুর্ঘটনা হ্রাস টেনে ধরতে না পারলে আগামী দিনের বাংলাদেশ আরো বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হবে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক

ইত্তেফাক/জেডএইচডি

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন