শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

কৃষকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট কতটুকু কার্যকর রয়েছে?

আপডেট : ২৪ অক্টোবর ২০২২, ০০:১০

কৃষকদের জন্য ১০ টাকায় বিশেষ ব্যাংক হিসাব খোলার উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১০ সালে এবং বিশেষ এ ব্যাংক হিসাবের ৮০ শতাংশই খোলা হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকে। এখন পর্যন্ত দেশে এমন হিসাবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ কোটিতে যদিও এসব হিসাবে কৃষকের অর্থ জমেছে খুবই সামান্য পরিমাণে অর্থাৎ এই এক যুগে ব্যাংক হিসাবগুলোয় গড় সঞ্চয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে মাত্র ৫৭৯ টাকায়। 

কৃষকদের ব্যাংক হিসাবগুলোর বড় অংশেই কোনো লেনদেন নেই। তবে এ হিসাবগুলোর মধ্যে ২৮ লাখ ৩৭ হাজার ৭৯৭টি সরকারি ভর্তুকি প্রদানের কাজে ব্যবহার হচ্ছে। ৬০ হাজার ব্যাংক হিসাবে ২০০ ও ৫০০ কোটি টাকার বিশেষ পুনঃ অর্থায়ন তহবিল থেকে ঋণ দিয়ে সচল রাখা হয়েছে। ভর্তুকি ও পুনঃ অর্থায়ন সুবিধার বাইরে থাকা কৃষকদের বেশির ভাগ ব্যাংক হিসাবই অকার্যকর বলে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জুন শেষে দেশের কৃষকদের ১০ টাকার বিশেষ ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯৮ লাখ ২০ হাজার ৬৯৯। বিপুল এ ব্যাংক হিসাবে সঞ্চয় আছে মাত্র ৫৬৯ কোটি টাকার আমানত। সে হিসেবে দেশের কৃষকদের ব্যাংক হিসাবে গড় সঞ্চয়ের পরিমাণ ৫৮০ টাকারও কম। লেনদেন না থাকায় কৃষকদের ব্যাংক হিসাবের বেশির ভাগই সক্রিয় নেই। তবে ব্যাংক হিসাবের একটি অংশ সরকারি ভর্তুকি ও পুনঃ অর্থায়ন তহবিলের মাধ্যমে সক্রিয় রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। রেমিট্যান্স গ্রহণের মাধ্যমেও সক্রিয় আছে কৃষকদের অল্প কিছু ব্যাংক হিসাব।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, গত অর্থবছরে কৃষি ও পল্লিঋণ পেয়েছেন ৩৩ লাখ ৪ হাজার ৮১১ জন। এর মধ্যে ব্যাংকগুলোর নিজস্ব নেটওয়ার্ক ও মাইক্রো ফাইন্যান্স ইনস্টিটিউশনের (এমএফআই) মাধ্যমে ১০ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা কৃষি ও পল্লিঋণ পেয়েছেন ১৭ লাখ ৯৭ হাজার ৫২ জন নারী। এছাড়া গত অর্থবছরে ২৪ লাখ ৯৯ হাজার ৯৪৫ জন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে প্রায় ২০ হাজার ১৮২ কোটি টাকা এবং চর, হাওড় প্রভৃতি অনগ্রসর এলাকার ৪ হাজার ৭৩ জন কৃষক প্রায় ১৯ কোটি ৫৯ লাখ টাকা ঋণ পেয়েছেন। এই ঋণ বিতরণের সুবিধার্থেও ঐ অ্যাকাউন্টগুলো খোলা হয়েছে।

ঝিনাইদহ সদর উপজেলার কালুহাটি গ্রামের কৃষক দুদুল আবিষ্কার করেছেন দুদুলতা নামে স্থানীয় ধানের জাত। ধান, পটোল, কলা ও বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি মিলিয়ে মোট ১০ বিঘা জমিতে চাষ করেন তিনি। কৃষি ব্যাংক, জনতা ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংকে হিসাবও খুলেছেন। তবে কোনোটিই তিনি ব্যবহার করেন না। হিসাবগুলোয় কোনো টাকাও নেই। তিনি বলেন, ব্যাংক হিসাব দিয়ে কী করব? কোনো কাজে তো আসছে না। সংসারের ব্যয় নির্বাহেই জীবন শেষ। ব্যাংক হিসাবে টাকা থাকবে কোত্থেকে। উৎপাদিত শস্য বিক্রি করে যা পাই তা পরিবারের সদস্যদের জীবিকা নির্বাহের পর আর থাকে না। অনেক সময় ধারকর্জ করেও চলতে হয়। আবার কারো কারো প্রবাসী ছেলে তাদের অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠায়। কৃষিকেন্দ্রিক লেনদেনের মধ্যে বিএডিসির কাছে বীজ বিক্রি করলে বা সরকারের কাছে ধান বিক্রি করলে অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানো হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি বছরের জুন শেষে কৃষি খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণ স্থিতি ছিল ৪৯ হাজার ৮০২ কোটি টাকা। শুধু গত অর্থবছরে ব্যাংকগুলো ২৮ হাজার ৮৩৪ কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণ করেছে। একই সময়ে কৃষকের কাছ থেকে ২৭ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা আদায় করেছে ব্যাংকগুলো। তবে কৃষকের মধ্যে বিতরণকৃত এ ঋণের ৭৫ শতাংশই গেছে এনজিওগুলোর মাধ্যমে। ব্যাংকগুলো এনজিওকে ঋণ দিয়ে নিজেদের দায়িত্ব শেষ করেছে। ব্যাংক থেকে সর্বোচ্চ ৮ শতাংশ সুদে কৃষি খাতে ঋণ বিতরণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যদিও এনজিওগুলো কৃষকের কাছে ২৫-৩০ শতাংশ সুদেও ঋণ বিতরণ করছে বলে জানা গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এক গভর্নর বলেন, দেশের কৃষকসহ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষ দেশের উন্নয়নের মূল স্রোতের বাইরে পড়ে আছে এবং এ শ্রেণির মানুষের জন্য কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। বিশেষ ভর্তুকি ও প্রণোদনার যেসব কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়ন হয়নি। এ কারণে দেশের ধনী-গরিবের বৈষম্য আরো বেড়েছে, ব্যাংকগুলো বড়দের ঋণ দেওয়ায় ব্যস্ত। কেবল কৃষকদের জন্য ব্যাংক হিসাব চালু করার মধ্যেই ব্যাংকাররা দায়িত্ব শেষ করেছেন। কৃষির নামে প্রতি বছর যে ঋণ বিতরণ দেখানো হচ্ছে, সেটিও কৃষক পাচ্ছেন কিনা তা খতিয়ে দেখা দরকার। দেশের কৃষক যে ভালো নেই, তাদের সঞ্চয়ের পরিসংখ্যানই সেটির সাক্ষ্য দিচ্ছে।

সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা যায়, ব্যাংক শাখার কর্মকর্তারা কৃষকের ১০ টাকা মূল্যের অ্যাকাউন্টগুলোকে ভালোভাবে দেখেন না যা তাদের কাছে একটি বাড়তি বোঝা বলে প্রতীয়মান হয়েছে। তাছাড়াও দারিদ্র্যপীড়িত কৃষকদের তেমন কোনো সক্ষমতা নেই যে তারা তাদের ব্যাংক হিসাবে নিয়মিত লেনদেন করবে এবং বছরের যে সময়টাতে যে কিছু কিছু সরকারি সহায়তা আসে তাও যৎসামান্য। আজ থেকে তিন দশক আগেও মনে করা হতো ক্ষুদ্র কৃষকরাই ছিল দক্ষ, বিশেষত খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে যা বর্তমানে এই ধারণাটির আর কোনো বাস্তবতা নেই। এখন যান্ত্রিকীকরণের ফলে খামারের আয়তন বৃদ্ধি জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছে যা ছোট আকারের খামারিদের জন্য একটি দুঃসংবাদ। কৃষি বাণিজ্য উদারিকীকরণ এবং খামারের আয়তন বৃদ্ধি একটি জরুরি বিষয় যা সময়ের দাবি বিশেষত খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টিকে বিবেচনায় রেখে। তাই ১০ টাকা মূল্যের কৃষকের অ্যাকাউন্ট কৃষকের স্বার্থে তার অনুশীলন যেন অনুসরণ করা হয় সে দিকে ব্যাংক ব্যবস্থাপনাকে নজর দিতে হবে।

লেখক :অধ্যাপক, ডিন ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা

 

ইত্তেফাক/ইআ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন