আন্তর্জাতিক বাজারে তেল-গ্যাসের সংকট। তেল-গ্যাসের সংকট আরো বড় হয়ে দেখা দেওয়ার আশঙ্কা তো আছেই। একদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, তারপরে আবার প্রধান তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর তেলের মজুত কমে আসছে। মূল কথা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জ্বালানিসংকট ক্রমেই বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে। আর এই সংকটের মধ্যে পড়ছে বাংলাদেশ। আমাদের দেশে স্থাপিত বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা (নবায়ন যোগ্য জ্বালানিসহ) প্রায় সাড়ে ২৫ হাজার মেগাওয়াট। এর মধ্যে সর্বোচ্চ উৎপাদনক্ষমতা ছিল ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। আমদানি ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট। পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা গেছে যে, ইতিমধ্যে উত্পাদনক্ষমতা কমে গেছে সাড়ে ৩ হাজার মেগাওয়াট। হয়তো আরো কমবে, এটাই স্বাভাবিক। কারণ, জ্বালানিসংকট যত বাড়বে, বিদ্যুৎ উৎপাদন ততই কমে। এমতাবস্থায় আমাদের করণীয় কী?
গ্যাস হলো আমাদের জ্বালানির প্রধান উৎস। আর গ্যাসসংকট বাড়ছে। জ্বালানি গ্যাসের চাহিদা বাড়ছে, কমছে উৎপাদন। দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে মজুতকৃত গ্যাসের পরিমাণ। বর্তমানে দৈনিক চাহিদা ৩৭০ কোটি ঘনফুটের বেশি থাকলেও সরবরাহ করা যাচ্ছে প্রায় ৩০০ কোটি মিলিয়ন ঘনফুট। পেট্রোবাংলার গত জুলাই মাসের এমআইএস রিপোর্টে বলা হয়ছে, ২০২০ সালে গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছিল ২১৭ কোটি ১০ লাখ ঘনফুটের বেশি; যা ২০২১ সালের জুনে ২০৮ কোটি ১০ লাখ ঘনফুটে কমে আসে। চাহিদা অনুযায়ী গ্যাসের সরবরাহ করা যাচ্ছে না। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে গ্যাসের চাহিদা, অন্যদিকে কমছে উৎপাদন। ফলে অচিরেই গ্যাসসংকট তীব্র আকার ধারণ করতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, আগামী ২০২৫ সালেই উত্তোলনকৃত মজুত ফুরিয়ে যেতে পারে। তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী বর্তমানে গ্যাস মোট জ্বালানি খাতে ৬৫ শতাংশ ভূমিকা রাখছে। গত ১ জুন ২১ তারিখ পর্যন্ত উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের মজুত ছিল ১১ দশমিক ৪৭ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ), আর বছরে উত্তোলন হচ্ছে ১ টিসিএফ। যদি তাই হয় তাহলে তো আগামী ১১ বছরেই উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের মজুত শেষ হয়ে যাবে। কমিশন আরো বলেছে, গত এক দশকে এক টিসিএফ গ্যাসও রিজার্ভে যুক্ত হয়নি। এমতাবস্থায় চাহিদা মেটাতে বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি করে চাহিদা মেটাতে হচ্ছে। পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, আগামী ২০২৫ সালে গ্যাসের রিজার্ভ ৬ টিসিএফ এবং ২০৩০ সালে ৫ টিসিএফএ নেমে আসবে, যা ব্যাপকভাবে এলএনজি আমদানিনির্ভর করে তুলবে এবং জ্বালানিনিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে। পেট্রোবাংলা সূত্রে আরো জানা যায়, বর্তমানে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৪ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট, যার বিপরীতে দেশি-বিদেশি কোম্পানিগুলোসহ মোট ২ হাজার ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট, সেই সঙ্গে সাড়ে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট আমদানিকৃত এলএনজিসহ দৈনিক মোট ৩ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট সরবরাহ করা হচ্ছে। আগামী ২০২৫ সালে গ্যাসের সরবরাহ হবে ১ হাজার ৩০০ বিসিএফ (বিলিয়ন ঘনফুট) এবং ২০৩০ সরবরাহ হবে ৬৫০ বিলিয়ন ঘনফুট। এ সময় গ্যাসের চাহিদা হবে প্রায় ২ হাজার বিলিয়ন ঘনফুট, যা চাহিদার তুলনায় সরবরাহ হবে ১ হাজার ৩০০ বিলিয়ন ঘনফুট। আর তখন চাহিদা থাকবে ২ হাজার বিলিয়ন ঘনফুট। ঘাটতি থাকবে ৭০০ বিলিয়ন ঘনফুট। ২০৩০ সালে চাহিদা হবে ২ হাজার ২২৭ বিলিয়ন ঘনফুট আর সরবরাহ হবে ১ হাজার ৩০৮ বিলিয়ন ঘনফুট। ঘাটতি থাকবে ৯০০ বিলিয়ন ঘনফুট। ঐ সময়ে এলএনজি আমদানি করেও চাহিদা মেটানো কঠিন হয়ে পড়বে। এনার্জি লেগুলেটরি কমিশন সূত্রে আরো জানা যায়, গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে এলএনজি আমদানি হয়েছিল ৫৫০ এমএমসিডিএফডি। তাতে আমদনি ব্যয় হয় বছরে ১১ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। ২০২৫ সালে এ খাতে ব্যয় দাঁড়াবে সাড়ে ২৭ হাজার কোটি টাকা। আর ২০৩০ সালে ব্যয় হবে ৩৭ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা। গত দুই দশকে গ্যাস অনুসন্ধান তেমন হয়নি, যার ফলে মজুতভান্ডারে নতুন করে গ্যাস যোগ হয়নি। গত ২০২০ সালের হিসাব অনুযায়ী প্রতি বছর গ্যাস উত্তোলন হচ্ছে ৯০০ বিলিয়ন ঘনফুট। ফলে অচিরেই মজুতভান্ডার শেষ হয়ে যাবে। আর বাড়বে এলএনজি আমদানিনির্ভরতা, যার প্রভাবে বিদ্যুৎ খাতে আরো সমস্যা দেখা দিতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত এখনো গ্যাসনির্ভর। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে ৪৫ দশমিক ৮৩ শতাংশ বিদ্যুৎ গ্যাসনির্ভরশীল। ক্যাপটিভ বিদ্যুতে গ্যাসের চাহিদা ১৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ। গৃহস্থালি খাতে গ্যাসের ব্যবহার ১৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ, সার খাতে ৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ, সিএনজি খাতে ৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ, বাণিজ্যিক খাতে শূন্য দশমিক ৫৫ শতাংশ, চা-শিল্পে শূন্য দশমিক ১১ শতাংশ আর ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প খাতে ১৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ গ্যাসের চাহিদা রয়েছে বা বর্তমানে ব্যবহৃত হচ্ছে।
পেট্রোবাংলার গত ২০২১ সালের মাসিক এমআইএস রিপোর্টে জানা যায়, গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মোট গ্যাসের উৎপাদন ছিল ২৭ হাজার ৫৫৯ দশমিক ২৫৫ এমএমসিএফ (মিলিয়ন ঘন ফুট), যা ২০২০-২১ সালের মে মাসে কমে দাঁড়ায় ২৩ হাজার ৯১ দশমিক ৮৬৭ এমএমসিএফ-এ। একই সময়ের ব্যবধানে দেশীয় কোম্পানিগুলো উৎপাদন ১১ হাজার ১৯৪ দশমিক ৩৮৩ এমএমসিএফ থেকে কমে ৭ হাজার ৯৮৭ দশমিক ৬৫৮ এমএমসিএফএ দাঁড়ায়। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলোর (আইওসি) উৎপাদনও একই সময়ের ব্যবধানে ১৬ হাজার ৬৪ দশমিক ৮৭২ থেকে কমে ১৫ হাজার ১০৫ দশমিক ২০৯ এমএমসিএফ-এ দাঁড়ায়। এক কথায় গ্যাসের উৎপাদন দ্রুত কমে আসছে। গ্যাসের উৎপাদন ও সরবরাহ কমার সঙ্গে সঙ্গে পেট্রোবাংলার মুনাফাও কমছে বলে জানা গেছে। গত ২০২১ সালে গ্যাস বিক্রয় বাবদ আয় ছিল ১ হাজার ২৬ কোটি ৯৪ লাখ টাকা, যা পরের মাসে বেড়ে ১ হাজার ১১৫ কোটি ৫০ লাখ ৯৪ হাজার টাকা হয়। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে মোট আয় ছিল ১০ হাজার ৯৫২ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। পেট্রোবাংলা গ্যাস, কয়লাসহ অন্যান্য উৎপাদিত দ্রব্য বিক্রি করে গত অর্থবছরে কর-অন্তে নিট মুনাফা করে ১ হাজার ৬৫১ কোটি ৯০ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। আর রাষ্ট্রীয় কোষাগারে দিয়েছে ৭ হাজার ৯১৭ কোটি ১ লাখ ২৪ হাজার টাকা। সরকার গ্যাসে মুনাফা করলেও সংকট মোকাবিলায় এলএনজি আমদানিতে ভর্তুকি দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম বাড়ছেই। আর এলএনজি আমদানি করতে গিয়ে সরকারকে মোটা অঙ্কের লোকসানও গুনতে হচ্ছে। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকার ১৭ হাজার কোটি টাকার এলএনজি আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যাতে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ ধরা হয় ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকার বেশি। আর জাতীয় বাজেটের আওতায় এলএনজি আমদানি মূল্য পরিশোধ বাবদ পেট্রোবাংলাকে দেওয়া হয় ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে গ্যাস উৎপাদন ও এলএনজি আমদানিসহ গ্যাস সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ হাজার ৭৯ বিসিএফ। প্রতি ঘনমিটারে ভর্তুকি যাচ্ছে ২ টাকা ২১ পয়সা। এতে করে ভর্তুকি গুনতে হবে প্রায় ৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এর আগের অর্থবছরে ভর্তুকি দেওয়া হয় আড়াই হাজার কোটি টাকা।
গ্যাস-সংকট মোকাবিলায় নতুন করে উদ্যোগ নিতে হবে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্সকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হবে। বাপেক্স বেশ কয়েকটি ক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে। আর নিজেরাও আটটি ক্ষেত্রের সাতটিতে গ্যাস উৎপাদন করছে। তাদের দৈনিক উৎপাদিত গ্যাসের পরিমাণ প্রায় ৩ দশমিক ৬৯২ মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফ)। তবে বাপেক্সের রয়েছে নানা সীমাবদ্ধতা। এই সীমাবদ্ধতাগুলো দূর করতে হবে। তাদের উৎপাদিত গ্যাসের দামও কম দেওয়া হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ। বাপেক্সের একজন সাবেক কর্মকর্তা জানান, আটটি গ্যাস ফিল্ডের পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্রেও এই স্তর থেকে গ্যাসের সন্ধান মেলেছে। এই স্তরের আরো নিচে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এর জন্য প্রয়োজন ডিপ ড্রিলিং বা মাটির আরো গভীবে খনন কাজ চালানো। তিনি আরো বলেন, বাপেক্সের রিগগুলোর গড়ে ৫ হাজার মিটারে খনন করার ক্ষমতা রয়েছে। ৭ হাজার মিটারের বেশি গভীরতায় খনন করতে হলে নতুন রিগ দরকার। কিন্তু তাদের রিগ-সংকট রয়েছে বলেও তিনি জানান। এ বিষয়টির প্রতি সরকারের নজর দিতে হবে। অন্যদিকে ভারত ও মিয়ানমার সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশকেও সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনে মনোনিবেশ করতে হবে।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কর কমিশনার ও পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড