২০২০ সালের এপ্রিল, প্রাণঘাতী করোনার প্রথম ঢেউয়ে সেই বিভীষিকাময় দিনগুলোতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অন্যদের সঙ্গে চারটি হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও করোনা রোগীদের চিকিৎসায় দায়িত্ব পালন করেছিলেন। কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতাল, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল, হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতাল এবং কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স ও কর্মকর্তা-কর্মচারীর সে সময় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে ৩৫টি হোটেলে কোয়ারেন্টাইনে ছিলেন। করোনার সেই ভয়াবহ আতঙ্কের সময় দেশের বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই বন্ধ ছিল। আবাসিক হোটেলগুলোও সে সময় বন্ধ হয়ে যায়। তবে সরকারের একটি সংস্থার মধ্যস্থতায় চিকিৎসক, নার্স ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কোয়ারেন্টাইনের জন্য ৩৫টি হোটেলের মালিক তাদের হোটেল খুলে দেন। হোটেল মালিকরা চিকিৎসক, নার্স ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু, দুই বছরেও হোটেল মালিকরা তাদের বকেয়া ২১ কোটি ৮৬ লাখ ৩২ হাজার ১৩ টাকা এখনো পাননি।
চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের থাকা-খাওয়া বাবদ হোটেলগুলো ২০২০ সালের ৩০ জুলাই পর্যন্ত সরকারের কাছ থেকে বিল পেয়েছিল। তবে ঐ বছরের আগস্ট ও সেপ্টেম্বর দুই মাসের ২১ কোটি ৮৬ লাখ ৩২ হাজার ১৩ টাকা এখনো বকেয়া। বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল হোটেল অ্যাসোসিয়েশন (বিআইএইচএ) বিল দাখিল করে বকেয়া অর্থ পেতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও অর্থ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরে একের পর এক চিঠি লিখে দিনের পর দিন ঘুরলেও এর কোনো সুরাহা হয়নি।
বিআইএইচএয়ের নেতারা জানান, বকেয়া পেতে হোটেল মালিকরা বিল জমা দেওয়ার পর নিয়ম অনুযায়ী সেটি প্রথমে যাচাই-বাছাই করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। যাচাই-বাছাই শেষে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বিল অনুমোদন করে পাঠানো হয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পুনরায় বিল যাচাই-বাছাই করে অর্থ ছাড়ের অনুরোধ জানিয়ে ২০২০ সালের ৩ নভেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে। কিন্তু, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি প্রজ্ঞাপনের কারণে অর্থ মন্ত্রণালয় অর্থ ছাড় করতে পারেনি। তখন অর্থ মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত ফাইলটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠিয়ে দেয়।
বিআইএইচএয়ের নেতারা ইত্তেফাককে জানান, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ফাইল ফেরত পাঠানোর জন্য দায়ী স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি পরিপত্র। ২০২০ সালের ২৯ জুলাই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ থেকে জারিকৃত এক পরপিত্রে ঢাকা মহানগরের চিকত্সক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ১৫ দিন কর্মকালীন কোয়ারেন্টাইনের জন্য হোটেলের পরিবর্তে ছয়টি সরকারি প্রতিষ্ঠানকে নির্ধারণ করে দেয়। ঐ ছয়টি প্রতিষ্ঠান ছিল—বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (প্রশাসন) একাডেমি (বিসিএসএএ), বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ম্যানেজমেন্ট (বিআইএএম-বিয়াম), জাতীয় পরিকল্পনা ও উন্নয়ন একাডেমি (এনএপিডি), ন্যাশনাল একাডেমি অব এডুকেশনাল ম্যানেজমেন্ট (এনএইএম-নায়েম), টিচার্স ট্রেনিং কলেজ (টিটিসি) ও জাতীয় স্থানীয় সরকার ইনস্টিটিউট (এনআইএলজি)। কিন্তু এই ছয়টি স্থানে থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা না থাকায় চিকিৎসকরা সেখানে থাকতে আপত্তি জানান। তখন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের তৎকালীন সিনিয়র সচিবের মৌখিক নির্দেশনায় চিকিৎসকরা আগের মতো হোটেলেই অবস্থান করেন।
কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ২০২০ সালের ২৯ জুলাইয়ের ঐ পরিপত্রের কারণে অর্থ মন্ত্রণালয় অর্থ ছাড় না করে বকেয়া বিলের ফাইল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। এনিয়ে হোটেল মালিকরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার যোগাযোগ করলে গত ২ অক্টোবর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ২০২০ সালের ২৯ জুলাই জারিকৃত সেই পরিপত্র বাতিল করেছে। পরিপত্র বাতিলের কথা জানিয়ে এবং হোটেল মালিকদের বকেয়া পরিশোধের লক্ষ্যে অর্থ ছাড়ের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে নতুন করে চিঠি দিতে হবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে। অথচ, এই কাজটিই এখন পর্যন্ত করেনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ফলে হোটেল মালিকরা তাদের বকেয়া পাচ্ছেন না।
আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় বকেয়া না পেয়ে হোটেল মালিকদের সংগঠন বিআইএইচএয়ের পক্ষ থেকে সর্বশেষ গত ১২ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেককে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়, বকেয়া পেতে হোটেল মালিকদের বারবার লিখিত অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে, বিশেষ করে ২০২১ সালের ২৯ নভেম্বরের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের বাজেট-১ শাখা থেকে অতিরিক্ত সচিবকে (উন্নয়ন) আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের একটি কমিটি করে দেওয়া হয়। সুনির্দিষ্ট কার্যপরিধি প্রণয়নপূর্বক এক মাসের মধ্যে সুপারিশ দাখিল করার বাধ্যবাধকতা দিয়ে অফিস আদেশ জারি করেছিল স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। কিন্তু আট মাস পেরিয়ে গেলেও কমিটির কাজে কোনো অগ্রগতি নেই। ১২ সেপ্টেম্বরের বিআইএইচএয়ের এই চিঠিতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য নির্দেশ দিলেও এখন পর্যন্ত কোনো কাজ হয়নি।
হোটেল মালিকরা জানান, চুক্তির ভিত্তিতে তারা চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের হোটেলে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। চুক্তির অন্যতম শর্ত ছিল হোটেল কর্তৃপক্ষ প্রতি ১০ দিন অন্তর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে বিল সাবমিট করবে এবং সাত কর্মদিবসের মধ্যে বিল পরিশোধ করা হবে। সেই অনুযায়ী ২০২০ সালের ৩০ জুলাই পর্যন্ত তারা বিল পেয়েছেন। কিন্তু কোভিড-১৯-এর সময় করোনা রোগীদের চিকিৎসায় দায়িত্ব পালনকারী কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতাল, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল, হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতাল এবং কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হোটেলে থাকা-খাওয়া বাবদ ২০২০ সালের আগস্ট ও সেপ্টেম্বরের বকেয়া ২১ কোটি ৮৬ লাখ ৩২ হাজার ১৩ টাকা তারা এখনো পাননি। অথচ, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়াধীন স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগের অধীনস্থ যারা একই সময়ে বিভিন্ন হোটেলে ছিলেন তাদের সমুদয় অর্থ ইতিমধ্যে পরিশোধ করা হয়েছে। তবে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের কাছে পাওনা ৩৫টি হোটেলের বকেয়া পরিশোধ করা হচ্ছে না। হোটেল মালিকরা জানান, বিপুল অর্থ বকেয়া থাকার কারণে অনেক হোটেল বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। অন্যদিকে, সরকারের কাছে অর্থ বকেয়া থাকলেও সেটির ওপর হোটেল মালিকদের রাজস্ব দিতে হয়েছে।