নদী নিজে মরে না। মানুষ ওদের মেরে ফেলছে। ফলে মরা নদীর সঙ্গে সংযুক্ত খাসজমির সব ধরনের জলাশয় একশ্রেণির লোভী মানুষ দখল করে নিচ্ছে। পেশিশক্তির সঙ্গে রাজনৈতিক যোগসাজশ এবং সরকারি সংস্থার নাম ভাঙিয়ে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রাতারাতি গ্রাস করে ফেলা হচ্ছে মরা জলাশয়।
সারা দেশে এসব মরা জলাশয়ে কৃত্রিম সেচ দিয়ে বোরো ধানের আবাদ করা হয়ে থাকে। অপেক্ষাকৃত শুকনো জমিগুলো ব্যবহূত হয় সবজি, তরমুজ, মিষ্টিকুমড়া, ক্ষীরা, পেঁয়াজ-রসুন চাষের জন্য। এতে অনেক ভূমিহীন দরিদ্র মানুষ জীবন-জীবিকার উত্স খুঁজে পায়। কিন্তু গত কয়েক বছর যাবত্ সেসব জমির দখল চলে গেছে স্থানীয় পেশিশক্তির হাতে। তারা নিজেরা বিত্তশালী ও রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে আঁতাঁত করে আরো ধনী হওয়ার জন্য নদী-খালগুলোতে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষের প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর ফলে খালগুলো পানিপ্রবাহ হারিয়ে মরে গেছে। কোথাও আবর্জনা স্তূপ তৈরি করা হয়েছে খালের মধ্যে।
উদাহরণস্বরূপ, পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার ছোট বাইশদিয়া ইউনিয়নের চর ইমারশন খালের কথা ধরা হোক। বাঁধ দিয়ে খালটিকে পুকুর বানিয়ে চলছে মাছ চাষ। ফলে রীতিমতো অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে খালটি। চর ইমারশন খাল দিয়ে একসময় বড় বড় নৌকা চলাচল করত। ব্যবসায়ীরা মালামাল নৌকা বোঝাই করে নিয়ে আসতেন। এখন ১০ বছরের বেশি সময় ধরে সরকারি খালটি কিছু ব্যক্তির দখলে চলে গেছে। অন্তত ১০টি স্থানে বাঁধ দিয়ে দখল করে তারা মাছ চাষ করছেন।
এভাবে অবৈধ বাঁধ দিয়ে জলাবদ্ধতা তৈরি করে মাছ চাষের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে খালের পানিপ্রবাহ। শুষ্ক মৌসুমে কৃষকদের সেচকাজে পানি ব্যবহার করতেও দেওয়া হচ্ছে না। যেমন সামনে তরমুজ চাষ নিয়ে শঙ্কায় পড়েছেন কৃষকেরা। এছাড়া বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ায় চরম ভোগান্তিতে পড়ছেন দুই পাড়ের বাসিন্দারা। দুই পাড়ে অন্তত ৮০ একর ফসলি খেত আছে। জলাবদ্ধতার কারণে এসব খেত ডুবে গিয়েও ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। বাঁধ অপসারণ করে একসময়ের খরস্রোতা খালটি রক্ষা করতে এবং পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক করতে ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দারা কৃষি বিভাগের প্রতি আবেদন জানিয়েছেন।
অন্যদিকে ঝালকাঠি শহরের বাঁশপট্টি খাল নিয়েও আমাদের উদ্বিগ্ন হতে হয়। শহরের উদ্বোধন মাধ্যমিক বিদ্যালয়সংলগ্ন খালটি পৌরসভার আবর্জনার আস্তাকুঁড়ে পরিণত হয়েছে। আবর্জনার দুর্গন্ধে বিদ্যালয়টির পড়াশোনার পরিবেশে দারুণ ব্যাঘাত ঘটছে। শহরের কোথাও ময়লা ফেলার নির্দিষ্ট স্থান বা ডাস্টবিন না থাকায় খালটির এ করুণ অবস্থা। বৃষ্টির কারণে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েও ভোগান্তি তৈরি হয়। পৌরসভাটির বর্জ্য অব্যবস্থাপনার কারণে ঐতিহ্যবাহী খালটি কোথাও ছোট নালায় পরিণত হয়েছে।
এসব কাজের সঙ্গে স্থানীয় পেশিশক্তি জড়িত থাকায় এলাকার মানুষ ভয়ে মুখ ফুটে কিছু বলতে সাহস পাচ্ছেন না। সেই সঙ্গে আছে স্থানীয় বাসিন্দাদের অসচেতনতা ও সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষের যোগসাজশ এবং দায়িত্বহীনতা। এ তো গেল গ্রামাঞ্চলের কথা।
শহরাঞ্চলে বৃহদায়তন ভৌত উন্নয়নের জন্য রাস্তা, বসতবাড়ি, নর্দমা, অফিস ভবন ইত্যাদি তৈরি ও মেরামতের হিড়িক চলছে। এজন্য অপেক্ষাকৃত নতুন রাস্তা কেটে আবার নতুন করে বানানো হচ্ছে। অনেক জায়গায় সেসব কাজ সমাপ্ত হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। নির্মাণসামগ্রী রাস্তার ওপরে স্তূপ করে রেখে কাজ করার ফলে জনগণের চলাচলে চরম যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। বৃষ্টির পানিতে বালু, মাটি ইত্যাদি গলে নিকটস্থ নালা-নর্দমার মুখ বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে সামান্য বৃষ্টিতে শহরের রাস্তায় বন্যার মতো হাঁটু বা কোমরপানি জমে যাচ্ছে।
রাজপথে ও বিভিন্ন শহরের এসব জলাবদ্ধতা খুবই বিরক্তিকর ও সময়বিনাশী। রাজপথের জলাবদ্ধতার মধ্যে একটি রিকশা বা গাড়ির চাকা ম্যানহোল বা খাদে আটকে গেলে যাত্রীরা মারাত্মক আহত হচ্ছেন। গাড়ি উলটে গেলে শুরু হচ্ছে ভয়ানক যানজট। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা যশোর, রংপুর কোথায় নেই জলজটসঞ্জাত যানজট? এ থেকে মুক্তি নেই যেন কোনোমতেই। আমাদের দেশে উন্নয়নকাজ চলে বারো মাস। আজকাল বৃষ্টিও হয় প্রায় সারা বছর জুড়ে। শহরের মাটিতে প্রাকৃতিক শোষণের জন্য কোনো জমি বা মাটি ফাঁকা না রাখায় সামান্য বৃষ্টির পানিতে জলজট তৈরি হয় খুব দ্রুত। শহর-গ্রাম সব জায়গায় জলাবদ্ধতা ও জলজট এবং সেখান থেকে মশকের বংশবৃদ্ধি ও ডেঙ্গু মহামারি আমাদের দেশের মানুষের চরম ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
খাল-নদীতে অবৈধ বাঁধ দিয়ে পানি চলাচল বন্ধ করে মাছ চাষের ফলে জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে। বিলে পানি জমিয়ে নিষ্কাশন করতে না দেওয়ায় ধানের আবাদ হচ্ছে না। সতী নদীতে বাঁধ দিয়ে মরাসতী বানানোর ফলে তীরবর্তী নিম্ন এলাকার মানুষ সেচের পানি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এতে পরিবেশ বিপন্ন হচ্ছে, পাশাপাশি কর্মসংস্থান কমে যাওয়ায় দারিদ্র্য বেড়ে যাচ্ছে। এজন্য জবরদখলকারীদের হাত থেকে এসব নদী-খাল উদ্ধার করে প্রয়োজনীয় খননকাজ দ্রুত সম্পন্ন করা করা প্রয়োজন।
কিছুদিন আগে কুমিল্লায় এক অনুষ্ঠানে কৃষিমন্ত্রী বলেন, ‘বর্তমানে আমরা সেচকাজে ভূপৃষ্ঠের পানি ব্যবহার করে থাকি। আমাদের দেশে শীতকালে যখন বোরো ধান লাগানো হয় তখন সেচকাজে বেশি পানি প্রয়োজন হয়। কারণ বোরো ধান পুরোটাই সেচনির্ভর ফসল। তাছাড়া অন্যান্য ফসলের খেতেও বৃষ্টিপাত কম হলে সেচের প্রয়োজন হয়। ভূপৃষ্ঠের পানি ব্যবহারে সেচ খরচ কম হয়। সেজন্য যদি আমরা নদী বা খালের পানিকে সংরক্ষণ করে সম্পূরক সেচকাজে ব্যবহার করতে পারতাম, তবে অল্প সেচখরচে অধিক ফসল ফলাতে পারতাম।’(দৈনিক ইত্তেফাক, ০৮.০৮.২০২২)।
গঙ্গা-কপোতাক্ষ, ডালিয়া ইত্যাদি পুরোনো প্রকল্পের কথা বাদ দিলেও ২০২২ সালে নোয়াখালীর চাটখিল, বরিশালের আগৈলঝাড়া, বরগুনার বেতাগী প্রভৃতি এলাকায় সেচকাজের সুবিধার্থে খালের মাধ্যমে সেচকাজ চালু করা হয়েছে। সারা দেশে সব মরা নদী ও খাল খনন করে পুরোদমে সেচ চালু হলে কৃষকরা সস্তায় নদীর পানি ব্যবহার করে কৃষি উত্পাদন বাড়াতে পারবে। এসব প্রকল্পে কাজের খরচের পরিমাণ খুব বেশি। কোনো কোনো প্রকল্পে কাজ সম্পন্ন না করে বিল উত্তোলনের ঘটনা সংবাদ হয়েছে। তাই এসব কাজে অতীতের মতো স্বেচ্ছাশ্রমের চিন্তাভাবনা থাকতে হবে।
দেশে হাজারো খাল, ছোট নদী অবৈধ দখলদারদের কারণে নিখোঁজ হয়ে গেছে। নদী ভরাট করে বহুতল বাড়ি, মার্কেট, বাজার, দলীয় কার্যালয়, সমিতি ইত্যাদি গড়ে তোলা হয়েছে। কোথাও আবাসিক এলাকার প্লট বানিয়ে বিক্রি করে গ্রাহকের নামে ভুয়া দলিল তৈরি করে বিক্রি করা হয়েছে। অনেক পৌর এলাকাতেও নদীর সীমানা চিহ্ন নেই। নদীগুলোর দুই পাড় কংক্রিটের বাঁধ দিয়ে বাঁধানোর কথা বলা হলেও অনেক বড় শহর এলাকার বড় নদীতেও এই কাজ পুরোপুরি করা হয়নি। সারা দেশের কৃষিতে ভূগর্ভের পানি উত্তোলন করে শস্যোত্পাদন করা হচ্ছে। ভূগর্ভের পানি উত্তোলন করে শস্যোত্পাদন এখন বেশ ব্যয়বহুল। ২০২২ সালে জ্বালানি তেলের দাম বাড়াতে এটাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।
আমাদের মরা নদীও প্রচুর। মরা খাল অগণিত। এসব খাল সংস্কার করা প্রয়োজন। খাল কেটে সেচের মাধ্যমে নদীর পানি ব্যবহার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল আশির দশকে। গঙ্গা-কপোতাক্ষ, তিস্তা ব্যারাজ, মুহুরী ইত্যাদি বহুমুখী পরিকল্পনায় খালের মাধ্যমে বড় বড় নদীর পানি ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষি-উত্পাদন বৃদ্ধি ও পরিবেশ সংরক্ষণ নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল।
কৃষি ও পরিবেশকে বাঁচাতে হলে ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগের পানি ব্যবহার করতে হবে। আমাদের সার্বিক পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষার জন্য এর বিকল্প নেই। এতদিন পর এই বোধোদয় খুব ভালো কিছুর দিকে তাকানোর নামান্তর। কারণ কৃষির উন্নতি ঘটানো ছাড়া আমাদের মেরুদণ্ড সোজা রাখার ভালো উপায় নেই। ধানের দেশের মানুষকে বিদেশ থেকে ধান-চাল তথা খাদ্য আমদানি করতে হয়—এটা বেশ লজ্জা ও কষ্টের।
এই কষ্ট থেকে বাঁচতে সারা দেশে সব পতিত জমিতে চাষাবাদ করতে হবে। ভূমিদস্যুদের কবল থেকে দখলকৃত নদী-খাল উদ্ধার করে সেগুলোতে পর্যাপ্ত খনন ও সংস্কার সাধন করে স্রোতধারা সচল করতে হবে। দখলকৃত খাসজমি উদ্ধার করে আসল ভূমিহীনদের নামে রেজিস্ট্রি করে দিতে হবে। প্রান্তিক কৃষকগণ চারদিক থেকে বঞ্চনার শিকার হয়ে থাকেন। এই অসহ্য অবস্থার নিরসন ব্যতিরেকে দরিদ্র চাষিদের অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন সম্ভব নয়।
কৃষি উত্পাদনের উন্নয়নে সেচকে বেগবান করতে নদী ও খাল খনন কাজকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে আমাদের দেশে ভঙ্গুর নদী ব্যবস্থাপনার পুনর্জাগরণের মাধ্যমে দেশ ও দেশের কৃষককে বাঁচাতে হবে। এতে দেশের জলাবদ্ধতা কমবে, সেচসুবিধাবঞ্চিত কৃষকরা সস্তায় জমিতে সেচ দিতে পারবে, দেশের খাদ্যোত্পাদন বাড়বে এবং পুষ্টিহীনতা কমবে। সামনে মহামন্দা ও বিশ্ব-দুর্ভিক্ষের সংকেতকে পাশ কাটাতে হলে দেশের খাদ্যচাহিদা মেটাতে দেশের অভ্যন্তরীণ খাদ্যোত্পাদন বাড়ানোর বিকল্প নেই।
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন