ভারতীয় বংশোদ্ভূত ঋষি সুনাকের ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হওয়া যুক্তরাজ্যের সামাজিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিট থেকে নিজের প্রথম বক্তৃতায় সুনাক ঘোষণা করেছেন যে তিনি তার পূর্বসূরি সদ্য বিদায়ি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসের অর্থনৈতিক ভুলভ্রান্তি সংশোধনে হাত দেবেন। একই সঙ্গে রাজনীতিতে ‘আস্থা’ পুনরুদ্ধারেও কাজ করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন সুনাক। ইতিমধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নিতে শুরুও করেছেন তিনি। উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, সুনাক প্রথম ব্রিটিশ এশীয় প্রধানমন্ত্রী বা যুদ্ধ-পরবর্তী প্রথম জাতিগত সংখ্যালঘু প্রধানমন্ত্রী হলেও এ প্রসঙ্গ তিনি তার বক্তৃতায় তোলেননি। বিষয়টি তিনি এড়িয়ে গেছেন যদিও, কিন্তু এটি নজর এড়াতে পারেনি আমাদের। বৃহত্তর জনসাধারণের মধ্যে, বিশেষ করে শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশ জনসংখ্যা, জাতিসত্তা ও এসংক্রান্ত বিশ্বাস অত্যধিক পরিমাণ না বাড়ানোর বিষয়ে সতর্ক থাকতেই প্রধানমন্ত্রী এরকমটি করেছেন বলে মনে করা স্বাভাবিক। এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, সুনাক সতর্ক থেকেছেন যদিও, কিন্তু ‘সকলের জন্য ন্যায্য সুযোগ’—এই আলোচনা থেমে নেই। বস্তুত, বৈচিত্র্যময় ব্রিটেনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের প্রশ্নে এহেন একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুকে উপেক্ষা করা হলে তা হবে বেশ বেমানান।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সুনাকের উত্থানের মধ্য দিয়ে ব্রিটেনের রাজনৈতিক পটভূমিতে লেখা হলো একটি গুরুত্বপূর্ণ গল্প। কীভাবে ব্রিটেন তিন প্রজন্ম ধরে বদলে আজকের পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, সুনাকের হাত ধরে সেই গল্পের বাস্তব চিত্র দেখল বিশ্ববাসী। বিভিন্ন প্রজন্মের প্রত্যেকেরই সুনাকের প্রধানমন্ত্রিত্বের তাত্পর্য সম্পর্কে আলাদা আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে পারে। যেমনটা আছে আমার নিজের পরিবারেই। আমার বাবা মনে করেন, এটি তার জীবদ্দশায় ব্রিটেনের সামাজিক অগ্রগতির একটি বিশাল চিহ্ন। বাবা ১৯৬৮ সালে ভারত থেকে ইংল্যান্ডে আসেন। চিকিত্সা প্রশিক্ষণ শেষ করে তিনি ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসে ডাক্তার হিসেবে কাজ খুঁজতে থাকেন ইংল্যান্ডে। এ সময় এনোক পাওয়েল তার সমালোচিত বক্তৃতা, যা ‘রিভারস অব ব্লাড’নামে পরিচিত, দেওয়ার মাত্র এক সপ্তাহ পরেই চরম বেকায়দায় পড়ে যান আমার বাবার মতো বহু অভিবাসী। এর ধাক্কা পরের কয়েক দশক ধরে অভিবাসীদের বেসামাল করে তোলে। আমার বাবার মতে, পাওয়েলের যুক্তি ছিল, ব্রিটেনে আসা হাজার হাজার ভারতীয় ও কমনওয়েলথ অভিবাসীকে তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে হবে। পাওয়েলের ভয় ছিল, ব্রিটেনের মাটিতে জন্ম নেওয়া অভিবাসীদের সন্তান যুক্তরাজ্যকে ‘বহু জাতিগত’ ভূখণ্ডে পরিণত করতে সময় নেবে না। অর্থাত্, অভিবাসীদের তাড়াতে না পারলে ব্রিটিশ জাতির স্বাতন্ত্র্যের মৃত্যু অবধারিত। পাওয়েলের এই ধারণা অনেকটা সেকেলে, এমনটাই মনে করেন অধিকাংশ এশীয় ব্রিটিশ। আর এ কারণেই সুনাকের মতো কোনো এক জনের ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হওয়াটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল শুধু এটা প্রমাণ করার জন্য যে, ‘কতটা ভুল ছিল পাওয়েলের চিন্তা’।
গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি যখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে বের হই, তখনো ব্রিটিশ ক্যাবিনেটে কোনো ব্ল্যাক বা এশীয় ক্যাবিনেট মন্ত্রী ছিলেন না। তখন আমার মতো অনেকেই মনে করতেন যে, এমন একদিন আসবে, যখন এই চিত্রের পরিবর্তন ঘটবে। সবার কল্পনায় ছিল—ব্ল্যাক ব্রিটিশ শিক্ষাসচিব, এশীয় স্বরাষ্ট্রসচিব কিংবা বিরোধী দলের নেতা। সেই আশা আজ সত্যে পরিণত হয়েছে। খোদ প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে এখন একজন এশীয়!
বাস্তবিক অর্থে, দীর্ঘ পথ হাঁটতে হলেও বিগত বছর পাঁচেক সময়ে দৃশ্যপটের পরিবর্তন ঘটেছে অতি দ্রুত গতিতে। বেশ কয়েক জন জাতিগত সংখ্যালঘু চ্যান্সেলর এবং স্বরাষ্ট্রসচিবের পর প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে ব্রিটিশ এশীয় বসার মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, ব্রিটেনের ইতিহাসে একজন ব্রিটিশ এশীয় প্রধানমন্ত্রী থাকা কোনো অলীক স্বপ্ন নয়। এই প্রবণতা আরো প্রসারিত হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। বিস্মিত হওয়ার মতো বিষয় হলো, ২০১০ সাল পর্যন্ত কোনো ব্রিটিশ এশিয়ান ব্রিটেনের মন্ত্রিসভায় দায়িত্ব পালনের সুযোগ পাননি। ডেভিড ক্যামেরন (অনির্বাচিত) হাউজ অব লর্ডস থেকে সাঈদা ওয়ার্সিকে নিজ পার্টির চেয়ার করেছিলেন। সেই থেকেই মূলত পথচলা শুরু। ২০১৪ সালের শেষের দিকে মন্ত্রিসভায় কাজ করার জন্য প্রথম বারের মতো ব্রিটিশ এশীয় এমপি নির্বাচিত হন সাজিদ জাভিদ।
বারাক ওবামার মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর আগেকার যুগের প্রায় সব ব্রিটিশ এশীয়ই হিসাব মেলাতে থাকেন যে, আমাদের এতটা লম্বা সময় লাগছে কেন? তাদের মধ্যে যারা অনেকেই এখনো জীবিত আছেন, তারা এই প্রশ্নের উত্তর জানেন খুব ভালোভাবে। তবে এই পথ পরিক্রমা অজানা এই প্রজন্মের কাছে। এ কারণে বিশেষ করে এশীয় ও ব্ল্যাক ব্রিটিশ ব্যাকগ্রাউন্ডের তরুণেরা সুনাকের প্রধানমন্ত্রিত্বকে ঘটা করে উদ্যাপন কিংবা এ নিয়ে কথা বলার কারণ খুঁজে পাবে না। তাদের অনেকেই হয়তো এই প্রশ্ন তুলবে যে, এতটা সময় পরও কেন সমান সুযোগের প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি? মূলত এ কারণেই বেশির ভাগ তরুণ-ব্ল্যাক, সাদা ও এশিয়ান ২০২০ সালের বর্ণবাদ বিরোধী বিক্ষোভকে সমর্থন করেছিল।
সুনাকের প্রধানমন্ত্রী হওয়া উপলক্ষ্যে আমাদের উদ্যাপন দেখে বিরক্ত হওয়া প্রজন্মকে অন্তত এ বিষয়টা স্মরণে রাখা উচিত যে, তারা হয়তো তাদের দাদা-দাদির মতো বর্ণবাদী সহিংসতা ও বৈষম্যের মুখোমুখি না-ও হতে পারে। অনেকেই হয়তো জানতে চাইবেন, সুনাক তাদের জন্য কী করবেন? যারা শিক্ষাগত সুযোগ-সুবিধার ঘাটতির সম্মুখীন, তাদের জন্যই বা সুনাকের উদ্যোগ ও চিন্তা কী?
আমার বাবা এবং আমি মনে করি, আজকের ব্রিটেন অনেক দূর এগিয়ে গেছে। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সংশয় এখনো রয়েই গেছে বলেই মনে করেন কেউ কেউ। তবে এ কথাও সত্য, আগামী দিনগুলোতে বহু ইতিবাচক সূচক সামনে আসবে। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে প্রতিটি বিষয়ের দ্রুত অগ্রগতি। আমাদের নতুন প্রধানমন্ত্রী অতীতের অগ্রগতি থেকে উপকৃত হয়েছেন, এ কথা বলাই বাহুল্য। এমতাবস্থায় সবাই প্রত্যাশা করেন, পরবর্তী প্রজন্মের চ্যালেঞ্জগুলোর উত্তর জানা আছে সুনাকের। সমান সুযোগ নিশ্চিতে অসমাপ্ত যাত্রার অগ্রগতি কত দূর কিংবা সমাধিকারের প্রশ্নে আরো কী কী পরিবর্তন ঘটানো আবশ্যক—এসব প্রশ্নের জবাব সুনাক ভালোমতোই জানেন বলেই আমরা মনে করি।
লেখক: মুক্ত-নির্দলীয় থিংক ট্যাংক খ্যাত ‘ব্রিটিশ ফিউচার’-এর পরিচালক ও ‘অবজারভার’ পত্রিকার সাবেক অনলাইন সম্পাদক
সিএনএন থেকে অনুবাদ: সুমৃৎ খান সুজন