করোনা নিয়ে সচেতনতার ফাঁকে গেলো দুই বছরে বেশ বিস্তার ঘটিয়েছে যক্ষ্মা। গত দুই দশকে ২ শতাংশ করে যক্ষ্মা কমে আসার পর ২০২০-২০২১ সালে এটি ৩.৬ শতাংশ বেড়েছে। যা উদ্বেগজনক বলছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সে কারণে করোনা মোকাবিলায় যে প্রচেষ্টা ছিল তা যক্ষ্মার ক্ষেত্রেও প্রয়োগের তাগিদ দিয়েছে সংস্থাটি।
এদিকে যক্ষ্মার চিকিৎসা নিয়ে কাজ করেন দেশের এমন একজন চিকিৎসক ইত্তেফাক অনলাইনকে বলেছেন, ফুসফুসে যক্ষ্মা সংক্রমের হার সবচেয়ে বেশি হওয়ায় সরকারি সচেতনতামূলক প্রচারণায় সেটাকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। ফলে ফুসফুসে না হওয়া যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলছে।
২০২০ সালে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সংক্রামক ঘাতক হিসেবে কোভিড-১৯ মহামারী যখন সংক্রমণ ছড়াচ্ছিল একই সময়ে যক্ষ্মায় ১৫ লাখ ও ২০১৯ সালে এই রোগে মারা গেছেন ১৪ লাখ মানুষ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালে অন্তত ১৬ লাখ মানুষ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছিল। যা ২০২০ সালের তুলনায় ৪.৫ ভাগ বেশি। গত বছর যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত বেশিরভাগ ছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া (৪৫%), আফ্রিকা (২৩%) ও পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে (১৮%)।
গত ২০ বছরের মধ্যে চলতি বছর প্রথমবারের মতো যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা বেড়েছে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। বৃহস্পতিবার (২৭ অক্টোবর) সংস্থাটি বলছে, বছরের পর বছর কমে যাওয়ার পর এবার নতুন করে যক্ষ্মা রোগ ফিরে এসেছে। ২০২১ সালে এই রোগে ১৬ লাখ মানুষ মানুষ মারা গেছে। দুই বছরে এই সংখ্যা ১৪ ভাগ বেড়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারত ছাড়াও অন্যান্য যে দেশগুলোতে যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা বেশি সেগুলি হলো ইন্দোনেশিয়া (৯.২ শতাংশ), চীন (৭.৪শতাংশ), ফিলিপাইন (৮ শতাংশ), পাকিস্তান (৫.৮ শতাংশ), নাইজেরিয়া (৪.৪ শতাংশ ), বাংলাদেশ (৩.৬ শতাংশ ) এবং কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র (২.৯ শতাংশ)। রিপোর্ট অনুযায়ী, মৃত যক্ষ্মা রোগীর মধ্যে ১ লাখ ৮৭ হাজার রোগী এইচআইভি পজিটিভ ছিলেন। বিশ্বব্যাপী যক্ষ্মা মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি আফ্রিকায়।
ডব্লিউএইচও বলেছে, এই প্রতিবেদনের অন্যতম বিষয় হল কোভিড-১৯ মহামারী টিবি নির্ণয় ও চিকিৎসা করতে গিয়ে যক্ষ্মার ওপর নজর দেওয়া হয়নি। গত দুই দশকের বেশিরভাগ সময় ধরে বছরে প্রায় ২ শতাংশ করে যক্ষ্মা কমে আসার পর ২০২০-২০২১ সালে এটি ৩.৬ শতাংশ বেড়েছে। বিশ্বজুড়ে সংঘাত, বৈশ্বিক জ্বালানি সংকট ও খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঝুঁকি পরিস্থিতির কারণে এই অবস্থার আরও অবনতি ঘটতে পারে।
এদিকে যক্ষ্মা বিষয়ক প্রতিষ্ঠানের প্রধান মেল স্পিগেলম্যান বলেন, ইতোমধ্যে যক্ষ্মা খারাপ পরিস্থিতিতে চলে গেছে। কোভিড-১৯ এর পরিবর্তে এটি একটি একক সংক্রামক হয়ে উঠবে যেটি বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর প্রধান কারণ হয়ে উঠবে।
রিপোর্ট প্রকাশের পর ডব্লিউএইচও প্রধান টেড্রোস আধানম গেব্রিয়াসুস বলেন, মহামারী যদি আমাদের কিছু শিখিয়ে থাকে, তা হল সংহতি, সংকল্প, উদ্ভাবন ও সরঞ্জামের ন্যায়সঙ্গত ব্যবহার। আসুন সেই শিক্ষাগুলো যক্ষ্মায় প্রয়োগ করি। এই দীর্ঘকালীন হত্যাকারীকে থামানোর সময় এসেছে।
যক্ষ্মা রোগীদের সচেতনতা বৃদ্ধি নিয়ে ২৫০ শয্যার টিবি হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার বলেন, যক্ষ্মার জীবাণু যে কেবল ফুসফুসকে আক্রান্ত করে তা নয়, এটি মস্তিষ্ক থেকে শুরু করে, ত্বক, অন্ত্র, লিভার, কিডনি, হাড়সহ দেহের যেকোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গে সংক্রমণ হতে পারে। তবে ফুসফুসে যক্ষ্মা সংক্রমের হার সবচেয়ে বেশি হওয়ায় সরকারি সচেতনতামূলক প্রচারণায় সেটাকেই বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। এইটাও রোগী বৃদ্ধির কারণ হতে পারে বলে তিনি জানান।
তিনি বলেন, ‘ফুসফুসে যক্ষ্মা হওয়ার হার সবচেয়ে বেশি হওয়ায় সবার ধারণা যে যক্ষ্মা মানেই ফুসফুসের রোগ। কিন্তু আসলে তা না। আমাদের এমন কোন অর্গান (অঙ্গ) নাই, যেখানে যক্ষ্মা হয় না। কারণ যক্ষ্মা হচ্ছে একটি বায়ুবাহিত ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রামক ব্যাধি যেটা মাইকোব্যাক্টেরিয়াম টিউবারকুলোসিস জীবাণুর সংক্রমণে হয়ে থাকে।’
ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা নিয়ে তিনি বলেন, মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্স টিবি রোগীর সংখ্যা বাংলাদেশে বাড়ছে। সবচেয়ে ভয়াবহ হচ্ছে, এমন রোগীর কাছ থেকে অন্য কারও শরীরেও ওষুধ প্রতিরোধী জীবাণু সংক্রমিত হতে পারে। যক্ষ্মা হলে চিকিৎসা সম্পূর্ণ করা আবশ্যক। মাঝপথে চিকিৎসা ছেড়ে দিলে ওষুধের কার্যকারিতা ব্যাহত হয়। এ ভয়াবহ সমস্যা এড়াতে চিকিৎসকের পরামর্শমতো ওষুধ সেবন যেমন করতে হবে, তেমনি থাকতে হবে নিয়মিত ফলোআপে।
১৮৮২ সাল থেকে বিশ্বে যক্ষ্মা রোগে এ পর্যন্ত ২০ কোটিরও বেশি মানুষ মারা গেছে এবং এর সাথে প্রতি বছরই আরো লাখ লাখ লোক মৃত্যুর সারিতে যোগ হচ্ছে। ড. রবার্ট কচ ১৮৮২ সালের ২৪ মার্চে যক্ষ্মার জীবাণু আবিষ্কারকে কেন্দ্র করে এ পর্যন্ত প্রতি বছর ২৪ মার্চ ‘বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস’ পালন হয়ে আসছে।