বান্দরবান ও রাঙামাটির পাহাড়ে কুকি বিদ্রোহীদের আস্তানায় নতুন জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের প্রশিক্ষণের বিষয়টি একটি নতুন ঘটনা বলে জানিয়েছেন জঙ্গি বিষয়ক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, এটা আদর্শিক নয়, ‘কমার্শিয়াল ডিল’।
তবে এই কর্মাাশিয়াল ডিলকে এখনো স্বাধীনভাবে যাচাই করে দেখেননি বাংলাদেশের সাংবাদিকরা। বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই সংক্রান্ত যেসব তথ্য সংবাদমাধ্যমে ছাপা হয়েছে তা একই সূত্র থেকে পাওয়া। এটা স্বাধীনভাবে যাচাই হওয়া প্রয়োজন।
কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) যাদেরকে সংক্ষেপে কুকি বিদ্রোহী বলা হয় তারা বাংলাদেশের পাহাড়ি এলাকার একটি অংশকে বিচ্ছিন্ন করার তৎপরতায় লিপ্ত। এর প্রধান নাথান বম নামে একজন। আর ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ নামে নতুন যে জঙ্গি সংগঠনটির নাম সামনে এসেছে তার আমির আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ। কিন্তু এর মাস্টারমাইন্ড হলেন প্রধান উপদেষ্টা শামীন মাহফুজ ওরফে শামীন স্যার। শামীন মাহফুজ আনসার আল ইসলামের সাবেক নেতা।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়নের (র্যাব) সদস্যরা বান্দরবান ও রাঙামাটির দুর্গম পাহাড়ে অক্টোবরে টানা অভিযান চালিয়ে ১০ জনকে গ্রেপ্তার করে। এদের মধ্যে সাতজন প্রশিক্ষণ নেয়া জঙ্গি এবং তিনজন কুকি বিদ্রোহী গ্রুপের সদস্য বলে র্যাব ব্রিফিং-এ জানায়। তাদের কাছ থেকে ৯টি বন্দুক, ৫০ রাউন্ড বন্দুকের গুলি, কার্তুজ, কেইস ৬২টি, হাত বোমা, কার্তুজ বেল্ট, দেশীয় পিস্তল, ওয়াকিটকি সেট, কুকি চিন লিখা ১০টি মানচিত্র উদ্ধার করা হয়। ২১ অক্টোবর র্যাব সংবাদ সম্মেলন করে এই তথ্য প্রকাশ করে।
র্যাব যা জানিয়েছে
বান্দরবানে ২১ অক্টোবর ব্রিফিং-এ র্যাবের মিডিয়া উইং-এর পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া নামের জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের বান্দরবানের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর ছত্রছায়ায় তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। তাদের আগ্নেয়াস্ত্র চালানো, আইইডিসহ বিভিন্ন ধরণের বোমা তৈরি, চোরাগুপ্তা হামলা, প্রতিকুল পরিবেশে বেঁচে থাকার বিভিন্ন কৌশলসহ বিভিন্ন ধরণের শারীরিক ও তাত্ত্বিক জ্ঞান বিষয়ক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘তারা পার্বত্য অঞ্চলের একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন থেকে তাদের খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি অর্থের বিনিময়ে সংগ্রহ করত।’
এর আগে আরে দুই দফা অভিযানে আরও সাত জনকে গ্রেপ্তার করা করে র্যাব।
সিটিটিসি যা বলেছে
কাউন্টার টেররিজম ইউনিটও পাহাড়ে প্রশিক্ষণ নেয়া পাঁচ জঙ্গিকে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছে।
নতুন এই জঙ্গি সংগঠন নিয়ে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি) প্রধান মো. আসাদুজ্জামান ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় এক প্রেস ব্রিফিং-এ জানান, শামীন মাহফুজ ২০১৭ সালে কারাগার থেকে জামিনে বের হয়ে পাহাড়ি এলাকায় একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প খুঁজতে থাকেন। সে জানতে পারে পাহাড়ি এলাকায় কুকি-চিন নামে একটি সংগঠন আছে। সেই সংগঠনটির প্রধান হলেন নাথান বম। নাথান বম হচ্ছেন শামীন মাহফুজের বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘনিষ্ঠতম বন্ধু।
শামিন মাহফুজ ও নাথান বম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। নাথান বমের সঙ্গে যোগাযোগ করে শামীন তাকে তার সংগঠনের সদস্যদের প্রশিক্ষণের জন্য প্রস্তাব দেন। ২০১৯ সালে কক্সবাজারের একটি হোটেলে তারা মিলিত হয়।
মিটিংয়ে অর্থের বিনিময়ে প্রশিক্ষণের সিদ্ধান্ত হলে নতুন জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা বান্দরবানের পাহাড়ি এলাকায় প্রশিক্ষণ শিবিরে কাটআউট (পরস্পরকে বিচ্ছিন্ন করা) পদ্ধতিতে যাওয়া শুরু কর।
সিটিটিসি প্রধান আর বলেন, ‘পার্বত্য অঞ্চলকে প্রশিক্ষণ শিবির হিসেবে বেছে নেওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে- যেন তাদের সদস্যদের নিরাপত্তা এবং গোপনীয়তা বজায় থাকে।’
জঙ্গি ও পাহাড়ে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আস্তানা প্রশিক্ষণের এই বিষয় নিয়ে আরও বিস্তারিত জানতে র্যাব ও সিটিটিসির সঙ্গে বৃহস্পতিবার যোগাযোগ করেও তাদের ব্রিফিং-এর বাইরে বাড়তি কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
সাংবাদিকরা যেভাবে তথ্য পেয়েছেন
বাংলাদেশে জঙ্গি বিষয়ক প্রতিবেদন করে যেসব সাংবাদিক আলোচিত তাদের একজন হলেন নুরুজ্জামান লাবু। তিনি বলেন, ‘আমরা চার-পাঁচ বছর আগে থেকেই বিভিন্ন সূত্র থেকে জানতে পারছিলাম তখনকার জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলাম কুকি বিদ্রোহীদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নেয়। তাদের আদর্শিক অবস্থান ভিন্ন হলেও এটা অর্থের বিনিময়ে করা হচ্ছিল। প্রশিক্ষণ ছাড়াও অর্থের বিনিময়ে নানা ইকুইপমেন্টও বিনিময় হয়। বাংলাদেশে জঙ্গিদের নিজস্ব নিয়ন্ত্রিত এলাকা নেই, যেটা কুকিদের আছে। তাই তারা নিরাপত্তার ঝুঁকি এড়িয়ে কুকিদের এলাকায় প্রশিক্ষণ নেয়। জঙ্গিদের অর্থের উৎস বন্ধ হয়নি। আগে ছিল, এখনো আছে। ফলে তারা কুকিদের অর্থ দিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘এখনকার জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার মাস্টরমাইন্ড শামীন মাহফুজ আগে আনসার আল ইসলামের নেতা ছিলেন। তিনি এবং কুকি নেতা নাথান বম একই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। তাদের মধ্যে সেই সময়ে সম্পর্ক ছিলো।’
এইসব তথ্যের সূত্র জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যারা গ্রেপ্তার হয়েছেন তারা পুলিশকে তথ্য দিয়েছেন এবং আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। সেখান থেকেই আমরা তথ্য পেয়েছি। মামলার এজাহারও তথ্যের উৎস হিসেবে ব্যবহার করেছি।’
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এই সব তথ্য যে স্বাধীনভাবে যাচাই করার সুযোগ একদম নেই, তা নয়। তবে আমরা স্বাধীনভাবে যাচাই করিনি। কারণ যেখানে প্রশিক্ষণ হয় সেটা দুর্গম পাহাড়ি এলাকা। সেখানে গিয়ে এটা নিয়ে কাজ করা বেশ কষ্টসাধ্য এবং অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। ওই এলাকা অশান্ত থাকে।’
স্বাধীন সূত্র থেকে তথ্য যাচাই করা দরকার
বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতা ও জঙ্গিদের দীর্ঘদিন ধরে পর্যবেক্ষণ করে আসছেন মানবাধিকার কর্মী নূর খান। তিনি মনে করেন, ‘জঙ্গিদের নিয়ে এই সময়ে যেসব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তা স্বাধীনভাবে যাচাই হওয়া দরকার। আমরা যেসব তথ্য সংবাদমাধ্যমে পাচ্ছি তা একই জায়গা থেকে আসা বলে আমার মনে হচ্ছে।’
তার কথা, ‘বাংলাদেশে অতীতে জঙ্গিদের সাথে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সম্পর্ক বা সহযোগিতার সম্পর্কের কথা আমরা শুনিনি। এটা নতুন শুনছি। আর জঙ্গি ও কুকি বিদ্রোহীরা ভিন্ন আদর্শের। জঙ্গিরা চায় তাদের মত করে দেশেই ধর্মীয় ব্যবস্থা কায়েম করতে। আর বিচ্ছিন্নতাবাদীরা চায় আলাদা ভূখন্ড। এই আদর্শিক পার্থক্য ঘুঁচাবার নয় কোনোভাবেই। তারপরও যদি ধরে নেই কুকিরা জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, সেই তথ্য স্বাধীন সূত্র থেকে যাচাই বাছাই করার দরকার আছে। তা না হলে দেশের বর্তমান অস্থির রাজনীতির প্রেক্ষাপটে মানুষের মনে সন্দেহ তৈরি হতে পারে।’
জঙ্গি ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ‘কমার্শিয়াল ডিল’
তবে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস এন্ড সিকিউরিটি স্ট্যাডিজের চেয়াম্যান মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনিরুজাজামান বলেন, ‘জঙ্গিরা বিছিন্নতাবাদীদের সহায়তা নিচ্ছে এটা বাংলাদেশে নতুন হলেও পৃথিবীতে নতুন নয়। ফিলিপাইনে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। আদর্শিক মিল না থাকলেও অর্থের জন্য এটা হয়। এটা কমার্শিয়াল ডিল। কুকিরা পয়সার বিনিময়ে ট্রেনিং দিয়েছে। এটা আর্মস-এর ক্ষেত্রেও হতে পারে। বাংলাদেশে আর্মস ডিল হয়েছে কি না জানিনা, তবে আশঙ্কা আছে।’
তার কথা, ‘বাংলাদেশে জঙ্গিরা মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশ এবং এনজিওদের কাছ থেকে অর্থ পাচ্ছে। এই ধরনের ভাড়ায় প্রশিক্ষণ নেয়ার মতো অর্থ তাদের আছে।’
পাহাড়ে কেন এই প্রশিক্ষণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘কুকিরা কম পরিচিত, আর দুর্গম পাহাড় জঙ্গিদের সেফটি সিকিউরিটির জন্য ভালো। তাই জঙ্গিরা ওই এলাকা বেছে নিয়েছে। তাদের দিক থেকে তাদের সিলেকশন ভালো বলে আমি মনে করি।''
জঙ্গিদের নতুন ব্র্যান্ডিং হচ্ছে
নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া' সম্পর্কে মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনিরুজাজামানের পর্যবেক্ষণ হলো, ‘জঙ্গিদের নতুন ধারা আবার আসছে। জঙ্গিদের এখন নিউ ব্র্যান্ডিং হচ্ছে। বাংলাদেশে এই ঘটনা তার বহিঃপ্রকাশ বলে মনে হচ্ছে। এই অঞ্চলে এখন আইএস-এর প্রভাব কমে যাচ্ছে এবং একিউআইএস-এর (আল কায়েদা ইন্ডিয়ান সাব কন্টিনেন্ট) প্রভাব বাড়ছে। জাওয়াহিরি মারা যাওয়ার পর নতুন নেতা হয়েছে তাদের। একটা নতুন স্পিরিট তাদের মধ্যে আসছে। আর একিউআইএসের একটা উদ্দেশ্য হচ্ছে ভারত ও কাশ্মিরে মুসলমানদের ওপর যে নির্যাতন হচ্ছে তার প্রতিশোধ নেওয়া। ফলে এই এলাকার ওপর তাদের নজর আছে।’
বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের মধ্যেও জঙ্গিদের রিক্রুটমেন্ট শুরু হওয়ার প্রমাণ থাকার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তবে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যাপারে এখনো আমাদের হাতে কোনো তথ্য নেই। রোহিঙ্গাদের রিক্রুট করতে দেশি-বিদেশি জঙ্গিরা সক্রিয়।’
তিনি মনে করেন, জঙ্গিদের এই নিউ ব্র্যান্ডিং-এর ব্যাপারে বাংলাদেশের আরও সতর্ক হতে হবে। বিশেষ করে ক্রস বর্ডার নজরদারি বাড়াতে হবে।
জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের বাংলা সংস্করণের হয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন হারুন উর রশীদ স্বপন। এই প্রতিবেদনের সব ধরনের দায়ভার ডয়চে ভেলের।