কেহ কেহ বলিয়া থাকেন—জীবন মানেই যন্ত্রণা, বাঁচিয়া থাকিতে উহা শেষ হইবে না। তবে মরণের পরও স্বস্তি আছে কি না—তাহাও ভাবিয়া দেখিতে হইবে। মাটির সহিত মিশিয়া যাইবার প্রক্রিয়ায় লক্ষ-কোটি জীবাণু আর পোকামাকড় ভক্ষণ করিবে আমাদের এই সুন্দর দেহখানি। দেহ না হয় মাটির সহিত মিশিয়া যাইবে, কিন্তু রুহ বা আত্মার কী হইবে? জন্মিলে মরিতে তো হইবেই। কিন্তু যেই জীবনখানি উন্নয়নশীল বিশ্বের মানুষেরা যাপন করিতেছে—সেই জীবনে ভোগান্তির শেষ নাই।
শিবরাম চক্রবর্তী তাহার একটি রম্য গল্পে যাহা লিখিয়াছেন তাহার মোদ্দা কথা এইরূপ :তুলনামূলক ভালোমানুষ হর্ষবর্ধনের একবার হার্ট অ্যাটাক হইল। তাহার ছোট ভাই গোবর্ধন ডাক্তার আনিতে ছুটিলেন। এইদিকে হর্ষবর্ধন দেখিলেন তিনি মরিয়া যমালয়ে চলিয়া গিয়াছেন। তাহার পাপপুণ্যের খেরোখাতা দেখিয়া যমরাজ বলিলেন, অল্পকিছু অন্যায় সে করিয়াছে, সুতরাং কিছুদিনের জন্য নরক হইতে ঘুরিয়া আসুক। এইদিকে ডাক্তার আসিয়া দেখিলেন হর্ষবর্ধনের নাড়ি বন্ধ হইয়া গিয়াছে। তিনি একটি ইনজেকশন আনিয়াছিলেন যাহাতে হার্ট অ্যাটাক বিপজ্জনক দিকে না যায়। ইনজেকশনটা ফেলিয়া দিলে নষ্ট হইবে ভাবিয়া ডাক্তার হর্ষবর্ধনের নিথর দেহেই পুশ করিলেন। ঐদিকে যমরাজ খেয়াল করিলেন উন্নয়নশীল বিশ্বে পথে পথে পদে পদে যন্ত্রণা, ভোগান্তি, অস্থিরতা, অনিশ্চয়তায় ভরা। যমরাজ দেখিলেন, হর্ষবর্ধনকে উন্নয়নশীল বিশ্বের একটি শহরে নরকবাসের জন্য পাঠাইয়া দিলেই হয়। তিনি তাহাই করিলেন। হর্ষবর্ধনও সুস্থ হইয়া উঠিয়া বসিলেন।
শিবরামের গল্পের মতোই উন্নয়নশীল দেশের কোনো কোনো অংশ যেন নরকের ক্ষুদ্র সংস্করণ। এইখানে পদে পদে ভোগান্তি। রাস্তায় নামিয়া বুঝা সম্ভব নহে, কখন গন্তব্যে পৌঁছানো যাইবে। আর কোথাও যদি কোনো সমাবেশ হয়, তাহা হইলে ভোগান্তি কত প্রকার ও কী কী—তাহা পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখা যাইবে। দেখা যাইবে যে, রাস্তায় ভয়াবহ যানজটের কারণে উপায় না দেখিয়া দীর্ঘক্ষণ বাসে থাকিবার পর অনেক যাত্রী বাস হইতে নামিয়া হাঁটা শুরু করিবেন। কারণ বহু এলাকায় যানবাহনগুলোকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করিতে হয়। এই অবস্থায় কাহারো বাড়িতে যদি কেহ হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হইয়া পড়ে, তাহা হইলে সেই রোগীকে আর হাসপাতাল অবধি পৌঁছাইতে হইবে না। সেই যে আমরা ছোটবেলায় ইংরেজি তর্জমায় পড়িতাম—‘ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মারা গেল’—ইহাকে একটুখানি পরিবর্তন করিয়া লিখিতে হইবে—‘যানজটে হাসপাতালে পৌঁছাইবার পূর্বে রোগী মারা গেল।’ কারণ মুমূর্ষু রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্সও এই সময় রাস্তায় অসহায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। অ্যাম্বুলেন্সের চালক যতই সাইরেন বাজাক—তাহাকে রাস্তা করিয়া দেওয়ার জন্য এক তিল জায়গা খালি থাকে না। উন্নয়নশীলের বিশ্বের চৌকশ সিএনজি রিকশাচালক, বাস কিংবা অন্য সকল যানবাহনের চালক এমনভাবে একটার সহিত আরেকটি গা ঘেঁষিয়া দাঁড়াইয়া থাকে যে, রাস্তার এক ইঞ্চি জায়গাও ফাঁকা থাকে না। ইহার অবস্থা সেই গল্পের মতো যেইখানে এক ব্যক্তি বাজি ধরিয়া ৯৯টি লুচি খাইয়াছেন, তাহার পর আর শ্বাস নিতে পারিতেছেন না। ডাক্তার আসিয়া একটি হজমের বড়ি দিলে দেখা গেল তাহা খাইবার জায়গা নাই। ঐ ব্যক্তি তখন ডাক্তারকে বলিলেন, ট্যাবলেট খাইবার জায়গা থাকিলে ঐ একটা লুচি ঠিকই খাইয়া ফেলিতাম। গল্পটির মতো যানজটে বিধ্বস্ত রাস্তাটিরও তখন হইয়া পড়ে দম বন্ধ অবস্থা। বড় বড় সমাবেশে হয়তো ১০ লক্ষ নেতাকর্মী জড়ো হন। কিন্তু ইহার বাহিরে সমাবেশের চাইতেও কয়েক গুণ বেশি লক্ষ লক্ষ মানুষ রাস্তায় বসিয়া যানবাহনে ধুঁকিতে থাকিতেছেন—তাহাদের বড় একটি অংশও তো ঐ দলের সমর্থক। এমন ভয়ংকর ভোগান্তির জন্য তাহারাও মর্মাহত হন, বিরক্ত হন।
রাজনীতি তো জনগণের জন্যই। কিন্তু উন্নয়নশীল বিশ্বে প্রায়শই এমন অনেক কর্মসূচি দেওয়া হয়—যাহাতে জনগণ ভোগান্তিতে পড়ে। সুতরাং ইহা উন্নয়নশীল বিশ্বের নেতাদের চক্ষু মুদিয়া ভাবিয়া দেখা প্রয়োজন, জনগণের স্বার্থে রাজনীতি করিতে গিয়া তাহারা কখনো-সখনো জনগণের বিরক্তির কারণ হইয়া যাইতেছেন কি না।