শুক্রবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৪ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

ভোল পালটানোদের চিহ্নিত করা প্রয়োজন

আপডেট : ১৬ নভেম্বর ২০২২, ০৫:২২

দেখিবার চোখ থাকিলে দেখা যাইবে, চিন্তার প্রসারতা থাকিলে উপলব্ধি করা যাইবে যে দুর্ভাগ্যবশত উন্নয়নশীল বিশ্ব একটি ভিন্ন বিশ্ব। তাহারা যেন স্বাধীন হইয়াও স্বাধীন হয় নাই। এই সকল দেশে গণতন্ত্রের কথা বলা হয়, কিন্তু পদে পদে গণতন্ত্রের সঙ্গেই উপহাস করা হয়। এই সকল দেশের অধিকর্তারা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যতখানি আস্থা রাখেন বা না রাখেন, তাহার চাইতে অধিক ধারণায় রাখেন ক্ষমতায় টিকিয়া থাকা। ক্ষমতায় টিকিয়া থাকাই তাহাদের শেষ কথা। আর ইহা করিতে গিয়া স্বাধীনতাবিরোধী চিরশত্রুকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়া মাথায় তুলিয়া রাখিতেও কুণ্ঠিত হয় না। দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের এই সকল দেশে আমরা কী দেখিতে পাই? যেই সকল দেশ সংগ্রাম করিয়া, লড়াই করিয়া, রক্তক্ষয় করিয়া, বিদেশি শক্তির পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ শত্রুর মোকাবিলা করিয়া স্বাধীনতা লাভ করিয়াছে, তাহারাই এখন স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির উপর নির্ভরশীল হইয়া উঠিয়াছে। স্বাধীনতাবিরোধীদেরই ‘অপরিহার্য’ বলিয়া মনে করিয়া নিজেদের আত্মপরিচয় ভুলিতে বসিয়াছে। আর এই সুযোগ লইয়া স্বাধীনতাবিরোধীরাও অন্যায়, অপরাধ, চৌর্যবৃত্তির লাগাম ছাড়িয়া দিয়াছে। ঐ সকল স্বাধীনতাবিরোধী ভোল পালটাইয়া বাঘের চামড়া পরিধান করিয়াছে। শুধু রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় নহে, প্রশাসনের গভীরেও ইহাদের অনুপ্রবেশ ঘটিয়াছে। প্রশাসনিক ন্যায্য-অন্যায্য সকল সুবিধা আদায় করিয়া লইতেছে। মোটেই অস্পষ্ট নহে যে, খুঁটির জোর ছাড়া এই সকল অপশক্তির অনুপ্রবেশ সম্ভব নহে। কিন্তু ইহাদের কারণেই যখন খুঁটি নড়বড়ে হইয়া উঠে, তখন এই সকল স্বাধীনতাবিরোধীরাই তাহাদের আসল রূপ প্রকাশ করিয়া থাকে। বিশেষ করিয়া, নির্বাচন সমাগত হইলে তাহা দেখিতে পাওয়া যায়। বাংলায় মগের মুল্লুক বলিয়া একটি কথা প্রচলন আছে। ইহা ইতিহাসের সপ্তদশ শতাব্দীর একটি বিশেষ পরিস্থিতিকে নির্দেশ করে। তখন পর্তুগিজ ও মগ জলদস্যুরা পূর্ব ও ভাটি-বঙ্গের বিস্তৃত এলাকায় লুটপাট, অত্যাচার, অনাচার হইতে শুরু করিয়া হেন অপরাধ নাই যাহা সংঘটিত করে নাই। উন্নয়নশীল বিশ্বের কিছু দেশে ক্ষমতাসীনদের দুর্বলতা দেখিয়া আধুনিককালে মগের মুল্লুক প্রতিষ্ঠা পাইয়াছে বলিয়া কেহ ধারণা করিতে পারেন।

আরো বড় সমস্যা হইল, এই সকল রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দুর্বলতা লইয়া কথা বলিতে দেওয়া হয় না। ক্ষেত্রবিশেষ চিন্তাও করিতে দেওয়া হয় না। মুখ বন্ধ রাখিবার এই প্রবণতা যেন চিরাচরিত হইয়া উঠিতে দেখা যায়। কিন্তু ইহা কেহই মনে রাখে না যে, মানুষ কথা না বলিতে পারিলে ফুঁসিয়া উঠে। একটি বিড়ালকেও যদি একটি ঘরে আবদ্ধ করিয়া রাখা হয়, তাহা হইলে জীবনরক্ষায় বিড়ালটিও ফুঁসিয়া উঠিবে। ইহাই স্বাভাবিক। যেইখানে কথা বলিতে দেওয়া হয় না, অন্যায়ের প্রতিবাদ করিতে দেওয়া হয় না, সেইখানে নৈরাজ্য ছাড়া আর কিছুই আশা করা যায় না। সকল কিছু সাধারণ মানুষের ধৈর্যের বাহিরে চলিয়া যায়।

আমরা অনেকেই ইতিহাসের ছাত্র নহি। কিন্তু অন্যায়-অত্যাচার করিয়া, তথা অন্যায়-অত্যাচারকে প্রশ্রয় দিয়া এই জগতে কেহই যে টিকিয়া থাকিতে পারে না—তাহা বুঝিতে ইতিহাসবেত্তা হইবার দরকার পড়ে না। যেই সকল দেশে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন সমাসীন, তাহাদের স্পর্শকাতর সময়টিতে বুঝিতে হইবে যে, এই অবস্থার উত্তরণ করা যাইবে কি না। সিদ্ধান্ত লইতে হইবে, তাহারা ঐ সকল অপশক্তিকে উত্খাত করিতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টায় লিপ্ত হইবেন কি না। কারণ সকল কিছু সাধারণ মানুষের ধৈর্যের বাহিরে চলিয়া গেলে পরিবেশ-পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলিয়া যায়, যাইতে পারে। সুতরাং যাহাদের এখনো বোধোদয় হয় নাই তাহাদের জন্য সময় ফুরাইয়া আসিতেছে সঠিক পথে শক্ত পায়ে হাঁটিবার। মনে রাখিতে হইবে, ঘরের খুঁটি শক্ত রাখিতে হইলে আগাছা পরিষ্কার করিবার কোনো বিকল্প নাই।

 

ইত্তেফাক/ইআ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন