ন্যাটো চায় না এই অঞ্চলে উত্তেজনা আরো বাড়ুক, স্থাপনা-অবকাঠামো আরো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠুক। তবে পরিস্থিতি প্রতিনিয়ত যেদিকে গড়াচ্ছে, তাতে ন্যাটোর উচিত হবে সংশ্লিষ্ট পক্ষকে এই সতর্কবার্তা দেওয়া—বাড়াবাড়ি মাত্রা ছাড়ালে অতি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বাহিনী মোতায়েন করার কোনো বিকল্প থাকবে না। বাস্তবিক অর্থে, উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে সংঘর্ষ বাড়ানোর পথে হাঁটলে ন্যাটোর গ্রিন সিগন্যাল পাওয়ামাত্রই সেকেন্ডের ব্যবধানে ঝাঁপিয়ে পড়বে ন্যাটো সেনা।
পোল্যান্ড, স্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, মলদোভা, রোমানিয়াসহ ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে ইউক্রেনের সীমান্ত পরিস্থিতি কতটা নাজুক হয়ে উঠতে পারে, চলতি সপ্তাহের ঘটনাগুলোর দিকে দৃষ্টি দিলে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। ইউক্রেন যুদ্ধের হাত ধরেই যে এই বাজে অবস্থার সৃষ্টি—এতে কোনো সন্দেহ নেই। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের মধ্য দিয়ে যে যুদ্ধের শুরু হয়, ক্রমশ তা ‘সর্বাত্মক’ আকার ধারণ করে চলেছে। এই সংঘাত ঘিরে শুরু থেকেই একটি বড় ভয় ছিল। পশ্চিমের সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ সামরিক জোট তথা ন্যাটো ইউক্রেন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে—সত্যিকার অর্থে এই আশঙ্কা কিংবা ভয় কখনোই মাথা থেকে নামানো যায়নি। বিশ্লেষকেরা বারবার সতর্ক করে বলেছেন, ‘ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর যে কোনো একটিতে এই যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লেই তা ন্যাটোর হস্তক্ষেপকে অনিবার্য করে তুলবে। এর ফলে সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হবে ন্যাটো। অর্থাত্, সংঘর্ষ-সংঘাত বৃহত্ আকার ধারণ করবে।’
১৫ নভেম্বর পোলিশ সীমান্তের অভ্যন্তরের কয়েক মাইলের মধ্যে একটি মিসাইল পড়েছে। পোল্যান্ডের প্রজেওডো গ্রামে রাশিয়ার তৈরি এই মিসাইল ছোড়া হয়। এতে দুই জন কৃষক নিহত হয়েছেন। মিসাইলটি রাশিয়ান বাহিনীর পক্ষ থেকে ছোড়া হতে পারে—এমন ধারণা করা হচ্ছে। ন্যাটোভুক্ত পোল্যান্ডের মাটিতে রাশিয়ার তৈরি ক্ষেপণাস্ত্র এসে পড়া নিছক ছোট বিষয় নয়। কেননা, এর ফলে পোল্যান্ড ন্যাটো চুক্তির ‘আর্টিক্যাল-৫’ অনুযায়ী সাহায্যের আবেদন জানালে তা ন্যাটো ও এর সদস্য দেশগুলোকে ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য করবে। এর ফলে কী হতে পারে, তা কারো অজানা নয়।
‘আর্টিক্যাল-৫’-এর মাধ্যমে মূলত ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর কাছ থেকে কোনো সামরিক তত্পরতা দাবি করা হয় না। কিন্তু এর একটি অন্য দিক রয়েছে। এই আর্টিক্যালের মর্মকথা—ন্যাটোভুক্ত কোনো একটি দেশ আক্রান্ত হলে ধরে নেওয়া হবে, সব দেশই আক্রান্ত এবং সেক্ষেত্রে আলাপ-আলোচনার পর তাত্ক্ষণিকভাবে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েনসহ প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণে দেশগুলো একসঙ্গে কাজ করবে বা কাজ করতে বাধ্য হবে। উল্লেখ্য, ন্যাটোভুক্ত কোনো একটি দেশ আক্রান্ত হলে পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাকি দেশগুলোর সক্রিয় অংশগ্রহণ অনেকটা বাধ্যতামূলক।
‘আর্টিক্যাল-৫’-এর বাস্তব চিত্র বিশ্ব একবারই দেখেছে। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কে আল-কায়েদার সন্ত্রাসী হামলার পর তথা নাইন-ইলেভেনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ‘আর্টিক্যাল-৫’-এর বাস্তবতা প্রত্যক্ষ করেছে বিশ্ববাসী। ১৯৯৯ সালে ‘কৌশলগত ধারণা’ হিসেবে সন্ত্রাসবাদকে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করে ন্যাটো। ন্যাটোর আশঙ্কা ইতিমধ্যে সত্য বলে প্রতীয়মান হয়েছে—বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদের বহু ঘটনা প্রত্যক্ষ করছি আমরা। আল-কায়েদার কমান্ড ও নিয়ন্ত্রণকাঠামো গুঁড়িয়ে দিতে ইউরো-আটলান্টিক অঞ্চলের বাইরে আফগানিস্তানে প্রথম বারের মতো ‘বাহিনী’ পাঠায় ন্যাটো। শুরু হয় প্রথম অপারেশন তথা ‘আর্টিক্যাল-৫’-এর বাস্তব প্রয়োগ-প্রক্রিয়া।
নাইন-ইলেভেনের মতো আবারও ‘আর্টিক্যাল-৫’-এর অবতারণা শুরুর জন্য এখন শুধু এটা প্রমাণ হওয়াই যথেষ্ট, পোল্যান্ডে ইচ্ছাকৃতভাবে মিসাইল ছুড়েছে রাশিয়া। শত্রুতামূলকভাবে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়েছে—এমন স্পষ্ট প্রমাণ পেলেই নেমে আসবে ‘আর্টিক্যাল-৫’! পোল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেজ ডুডা অবশ্য বলেছেন, ‘ইউক্রেনের বিমান প্রতিরক্ষা রকেটটি রুশ ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করার জন্য ইউক্রেনের তরফ থেকে ছোড়া হয়েছে বলেই আপাতত মনে হচ্ছে।’ ন্যাটোর সেক্রেটারি জেনারেল জেনস স্টলটেনবার্গও পোল্যান্ডের ঘটনাকে ইউক্রেনের বিমান প্রতিরক্ষা কার্যক্রমের অংশ বলে মনে করছেন। উল্লেখ করা প্রয়োজন, গত কয়েক দিনে পোল্যান্ড-ইউক্রেন সীমান্তের কাছাকাছি অঞ্চলে কিয়েভ, লভিভসহ ইউক্রেনের বেশ কিছু শহরে বেসামরিক অবকাঠামো লক্ষ্য করে ক্রুজ ও ব্যালিস্টিক মিসাইল ছোড়া হয়েছে। পোল্যান্ডে আছড়ে পড়া মিসাইলটি এরই অংশ বলে মনে করা হচ্ছে।
এখন প্রশ্ন হলো, এ ঘটনা কত দূর গড়াতে পারে, কিংবা পোল্যান্ডের হাতে কী কী বিকল্প রয়েছে এবং ন্যাটোরই বা কী করার আছে? এক্ষেত্রে পোল্যান্ড ন্যাটো চুক্তির ‘আর্টিক্যাল-৪’-এর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে। ‘আর্টিক্যাল-৪’-এর সারকথা, যখনই কোনো একটি সদস্যের আঞ্চলিক অখণ্ডতা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা বা নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে, তখনই দেশগুলো একসঙ্গে আলোচনায় বসে করণীয় ঠিক করবে। ‘আর্টিক্যাল-৪’-এর প্রয়োগ আগেও দেখা গেছে। সিরিয়া যুদ্ধের যুগে সন্ত্রাসী হামলার পর ২০১৫ সালে তুরস্ক ‘আর্টিক্যাল-৪’ আহ্বান করেছিল। ‘আর্টিক্যাল-৪’-এর প্রয়োগ দেখা গেছে ২০২২ সালেও। মার্চে ন্যাটোভুক্ত আটটি দেশ—বুলগেরিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, পোল্যান্ড, রোমানিয়া ও স্লোভাকিয়া—ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে আহ্বান করে ‘আর্টিক্যাল-৪’।
‘আর্টিক্যাল-৫’-এর মতো ‘আর্টিক্যাল-৪’-এরও বিষয়বস্তু সামরিক তত্পরতা নয়। অর্থাত্, অনেকটা হঠাত্ করেই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়বে—এমন আশঙ্কার কোনো কারণ নেই। পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মাতেউস মোরাউইকিকে উদ্ধৃতি করে বিবিসি এক প্রতিবেদনে বলেছে, ‘এখন পর্যন্ত যা জানা গেছে তাতে মনে হচ্ছে, ‘আর্টিক্যাল-৪’-এর আহ্বান জানানোর দরকার পড়বে না। তবে প্রতিবেদনে এ-ও বলা হয়েছে, ‘এই যন্ত্র (আর্টিক্যাল-৪) আমাদের হাতে থাকছেই এবং আমরা প্রয়োজনবোধে অবশ্যই এর সাহায্য নেব।’ অর্থাত্ এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, সতর্কবাণী উচ্চারণের মধ্য দিয়েই ঘটনা ‘আপাতত সমাধান’ করা গেছে।
ন্যাটো যেহেতু সরাসরি মাঠে নামতে পারছে না (যেহেতু রাশিয়ার বিরুদ্ধে স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি এখনো), তাই এখন বড় প্রশ্ন—এই পরিস্থিতিতে ন্যাটো বিকল্প উপায়ে কীভাবে ভূমিকা রাখতে চেষ্টা করবে? আমরা দেখে আসছি, জোটের বিভিন্ন সদস্য দেশ ইউক্রেনকে সীমিত কিন্তু ক্রমবর্ধমান কার্যকর বিমান প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহ করছে। ট্যাংক, এনএলএডব্লিউ অ্যান্টি-ট্যাংক মিসাইল, গোলাবারুদসহ বিভিন্ন ধরনের অত্যাধুনিক অস্ত্র তুলে দেওয়া হচ্ছে ইউক্রেনীয় যোদ্ধাদের হাতে। এমনকি ন্যাটোর সদস্য দেশগুলোর গোয়েন্দা সংস্থার সরবরাহকৃত তথ্য থেকেও বেশ উপকার পাচ্ছে ইউক্রেন। ২০১৪ সালে রাশিয়ার দনবাস ও ক্রিমিয়া আক্রমণের পর থেকে ইউক্রেনীয় সেনাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে ন্যাটো। উপরন্তু, ইউক্রেনের সেনাবাহিনীকে এমন এক শক্তিশালী বাহিনীতে রূপান্তরিত করতে সাহায্য করেছে ন্যাটো, যা প্রতিরক্ষার প্রশ্নে ইউক্রেনকে ব্যাপক সুবিধা এনে দিচ্ছে। বস্তুত, এর ফলে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী অতিমাত্রায় কার্যকর হয়ে উঠেছে, যার ফলাফল দেখা যাচ্ছে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে—ইউক্রেনীয় সেনারা যারপরনাই আক্রমণাত্মক ও দুর্দমনীয়। সেপ্টেম্বরে স্কাই নিউজের এক প্রতিবেদনে উঠে আসে, প্রায় ৪ হাজার ৭০০ ইউক্রেনীয় সেনা ইতিমধ্যে যুক্তরাজ্যের সামরিক ঘাঁটিতে প্রশিক্ষণ নিয়েছে। নিউজিল্যান্ড, সুইডেন, নেদারল্যান্ডসসহ অন্যান্য পশ্চিমা মিত্রও ইউক্রেনীয় সেনাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে সাহায্য করছে।
মনে রাখতে হবে, পোল্যান্ডের ঘটনায় ইউক্রেন বা রাশিয়ার সীমান্তবর্তী দেশগুলোতে ন্যাটোর উল্লেখযোগ্যভাবে সেনা মোতায়েনের সম্ভাবনা কম। এ-ও মনে রাখতে হবে, ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু থেকে এখন অবধি সংঘর্ষে জড়ানোর কোনো রাস্তাতেই হাঁটেনি ন্যাটো। এমনকি এমন কোনো তত্পরতাও দেখায়নি ন্যাটো, যাতে সংঘাত আরো লম্বা হয়। এর কারণ, ন্যাটো চায় না এই অঞ্চলে উত্তেজনা আরো বাড়ুক, স্থাপনা-অবকাঠামো আরো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠুক। তবে পরিস্থিতি প্রতিনিয়ত যেদিকে গড়াচ্ছে, তাতে ন্যাটোর উচিত হবে সংশ্লিষ্ট পক্ষকে এই সতর্কবার্তা দেওয়া—বাড়াবাড়ি মাত্রা ছাড়ালে অতি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বাহিনী মোতায়েন করার কোনো বিকল্প থাকবে না। বাস্তবিক অর্থে, উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে সংঘর্ষ বাড়ানোর পথে হাঁটলে ন্যাটোর গ্রিন সিগন্যাল পাওয়ামাত্রই সেকেন্ডের ব্যবধানে ঝাঁপিয়ে পড়বে ন্যাটো সেনা।
২০২২ সালের মার্চ মাসে নরওয়েতে অনুষ্ঠিত ‘ব্রিলিয়ান্ট জাম্প-২০২২’-এর মহড়ায় ন্যাটোভুক্ত ১২টি দেশের নৌ, বিমান ও স্থলবাহিনীর ৩ হাজার ৩০০ সেনা অংশ নেয়। মহড়ায় ন্যাটো সেনাদের দক্ষতা, সক্ষমতা ও আন্তঃকার্যক্ষমতা দেখে সবার চোখ কপালে ওঠে! সুতরাং, বিষয়টিকে কোনোভাবেই মাথা থেকে বের করে দিলে চলবে না। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির বারবার আবেদন সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত ইউক্রেনকে যুদ্ধক্ষেত্রে ‘কাঙ্ক্ষিত মাত্রায়’ সহায়তা দেওয়া হয়নি এটা যেমন সত্য, তেমনি এ কথাও সত্য, ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোকে যদি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন টার্গেট করে বসেন, তবে তাকে প্রস্তুত থাকতে হবে চূড়ান্ত পরিণতি বরণের জন্য। ইউক্রেন যুদ্ধের বাস্তবতা এখন এটাই।
লেখক: ‘ইউনিভার্সিটি অব রিডিং’-এর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনসের শিক্ষক
দ্য কনভারসেশন থেকে অনুবাদ: সুমৃৎ খান সুজন