আমাদের রাজনৈতিক দলগুলি উদারতা ও সহনশীলতার কথা বলিয়া থাকে। তাহাদের নানান দাবিদাওয়ার কথা শুনিতে পাওয়া যায়; কিন্তু দেখা যায়, তৃণমূল স্তর পর্যন্ত কোনো মিটিং-মিছিলের আয়োজন করা হইলে সেইখানে শুরু হইয়া যায় সহিংসতা। এমনকি নিজ দলের সভা-সম্মেলনও অনেক সময় সহিংসতা হইতে মুক্ত হইতে পারে না। এই পরিস্থিতি কি দেশে কোনো ইতিবাচক ফল বহিয়া আনিতে পারে?
দক্ষিণাঞ্চলের একটি জেলার উপজেলা পর্যায়ে ক্ষমতাসীন দলের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হইয়াছেন এক জন এবং আহত হইয়াছেন অন্তত ১৫ জন। ইউনিয়ন পর্যায়ের এই সম্মেলনে পূর্ব হইতেই সংঘর্ষের আশঙ্কা করা হইয়াছিল। এমনকি ইহার জন্য মোতায়েন ছিল ২০০ পুলিশ। তাহার পরও সংঘর্ষের ঘটনা এড়ানো যায় নাই। তৃণমূল পর্যায়ে এমনকি নিজ দলের মধ্যেও গোলাগুলির ঘটনায় যে কাহারও কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়িবারই কথা। একদিকে বলা হইতেছে, বিরোধীদের পাত্তা দেওয়া হইবে না, অন্যদিকে নিজ দলের নেতাকর্মীদের সামাল দেওয়া যাইতেছে না। ইহাতে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে উদ্বেগ ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়াটা কি স্বাভাবিক নহে?
আমরা জানি, দীর্ঘ ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়া বাংলাদেশের অভ্যুদয় হইয়াছে। তাহা সত্ত্বেও এইখানে কনফ্লিক্ট রেজুলেশন হয় নাই। বরং এইখানে ‘আনফিনিশড রেভল্যুশন’-এর কথা বলা হইয়া থাকে। এই কারণে এইখানে সর্বত্র ‘মোস্ট সিভিলাইজড সিস্টেম’ বা সর্বোচ্চ সভ্য পদ্ধতি গড়িয়া উঠে নাই। একে অপরকে উৎখাত ও মূল উৎপাটনের কথা বলিতে শুনা যায় আজও। এই অবস্থানে থাকিয়া একটি গণতান্ত্রিক, সহনশীল ও উদারনৈতিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা টিকাইয়া রাখা দুরূহ। যখন একদলের সহিত আরেক দলের বাহাস হয়, তখন ব্যাপারটা আমরা সহজেই বুঝিতে পারি; কিন্তু নিজ দলের মধ্যেও কেন এত সংঘাত-সংঘর্ষ? অবশ্য এই ধরনের ঘটনা নিকট অতীত, এমনকি বাংলাদেশ জন্মের পূর্বেও ঘটিয়াছে; কিন্তু নিজ দলের মধ্যে সহনশীলতার অভাব আজিকার মতো এতটা প্রকট ছিল না। ইহাতে বুঝা যায়, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের সমাজব্যবস্থার প্রতি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর আস্থা নাই।
উল্লেখ্য, ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের অধিকাংশ ঘটনাই ঘটিতেছে দলের তৃণমূলের সম্মেলন ও কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করিয়া বিবাদের কারণে। আগামী ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হইবে দলটির জাতীয় সম্মেলন। এই উপলক্ষ্যে জেলা, মহানগর, উপজেলা, থানা ও অধীন শাখা কমিটিগুলির সম্মেলন চলিতেছে। এই সকল সম্মেলনের আয়োজন করা দলের মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চা ও দলকে অধিকতর শক্তিশালী করিবারই নামান্তর; কিন্তু এই সকল সম্মেলনকে কেন্দ্র করিয়া যেইভাবে দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধ মাথাচাড়া দিতেছে তাহা মোটেও কাম্য নহে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের কারণেও বাড়িতেছে অভ্যন্তরীণ এই সংঘাত। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নকে সম্মুখে রাখিয়াও অনেক এলাকায় ছড়াইয়া পড়িতেছে গৃহবিবাদ। আগামী দিনগুলিতে এই প্রবণতা আরো বাড়িতে পারে। তাই এখন হইতেই সতর্কতা অবলম্বন করিতে হইবে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করিয়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহিত সংঘর্ষে প্রাণ হারান ৪৪ জন। তাহাদের অধিকাংশই সরকারি দলের নেতাকর্মী। আরেক পরিসংখ্যান হইতে জানা যায়, চলতি বৎসরে এই দলটি এবং তাহার সহযোগী সংগঠনগুলির নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ হইয়াছে অন্তত ৮৪ বার। ইহাতে ১৩ জন নিহত ও ৯৮২ জন আহত হইয়াছেন। অবশ্য অভ্যন্তরীণ এই অসহিষ্ণুতা অন্য দলগুলির মধ্যেও রহিয়াছে কমবেশি। এই জন্য পরমতসহিষ্ণুতা ও অন্যের প্রতি সম্মানবোধের রাজনৈতিক শিষ্টাচারের সংস্কৃতি গড়িয়া তুলিতে হইবে। যে কোনো আন্ত ও অন্তর্দলীয় দ্বন্দ্ব-সংঘাত অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনিভেপ্রেত। অতএব, দলের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখিতে দলের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের কোনোভাবে প্রশ্রয় দেওয়া উচিত হইবে না।