ডোনাল্ড ট্রাম্প ফিরে আসার ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, কোনো সাবেক প্রেসিডেন্টকে টানা মেয়াদ ছাড়া হোয়াইট হাউজে দেখা যায়নি—এমনটা চলে আসছে লম্বা সময় ধরে। দ্বিতীয় বার নির্বাচনে হেরে কিংবা খানিক বিরতি নিয়ে আবারও নতুন মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হওয়ার নজির যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে বিরল। এর ব্যত্যয় ঘটে সর্বশেষ ১৮৯৩ সালে। ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড ১৮৮৫ সালে ২২তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথম বার আমেরিকার নেতৃত্বে আসেন। এরপর এক দফা বিরতি নিয়ে ১৮৯৩ সালে আবারও ২৪তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে হাউজে ফেরেন তিনি। ক্লিভল্যান্ডের পর এমন ঘটনা আর ঘটেনি যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে। সুতরাং, ট্রাম্প কোন যুক্তিতে ইতিহাসের দীর্ঘ ধারাবাহিকতা উলটে দেওয়ার দুঃসাহস করছেন, তা গবেষণা সাপেক্ষ।
প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, ট্রাম্প কি সত্যি সত্যিই যুক্তরাষ্ট্রকে নতুন করে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা ভাবছেন, নাকি এর পেছনে অন্য কোনো ফন্দি আছে? তার মনে কি সত্যিই মার্কিনদের নিয়ে ‘কল্যাণ চিন্তা’ আছে, নাকি নিছক নিজে বাঁচার জন্যই নির্বাচনের পথে হাঁটার চিন্তা করছেন? প্রকৃতপক্ষে, ট্রাম্পের বয়স এখন ৭৬—যদিও এটা কোনো সমস্যা নয়। তবে সত্যি বলতে, তিনি যারপরনাই কর্মবিমুখ, ফাঁকিবাজ ও অলস। আশ্চর্যজনকভাবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন ব্রিফিং বা কথাবার্তায় তাকে আশানুরূপ মনোযোগী হতে দেখা যায়নি। ‘হোমওয়ার্ক’ ছাড়াই অধিকাংশ মিটিংয়ে হাজির হওয়ার মতো তার বহু বাজে অভ্যাস ছিল চোখে পড়ার মতো। রাষ্ট্র পরিচালনায় মনোনিবেশ বাদ দিয়ে গলফ খেলতেই তিনি অধিক সময় ব্যয় করেছেন, যা তার অজস্র বাজে স্বভাবের একটি। আগেভাগে অফিস ত্যাগ, গুরুত্বপূর্ণ কাজে তড়িঘড়ি করা, সিদ্ধান্ত গ্রহণে অপরিণামদর্শিতা এবং অকারণ বাচালতার কারণে ওভাল অফিসের অস্বস্তি প্রভৃতির বিচারে ট্রাম্পের দিকে আঙুল ওঠা স্বাভাবিক—প্রেসিডেন্টের চেয়ারে তিনি কি মানানসই, উপযুক্ত?
২০২৪ সালের নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হয়ে হোয়াইট হাউজে ফিরতে চান ট্রাম্প। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, ট্রাম্প নির্বাচনে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন মাত্র। কিন্তু এর জন্য তাকে হাঁটতে হবে দীর্ঘ পথ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ম্যারাথন দৌড়ে তাকে যে বেশ ভুগতে হবে, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। কারণ তিনি এমন কোনো নীতি বা আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি, যা তাকে টিকিয়ে রাখবে, নতুন করে ক্ষমতার মসনদে বসাবে। এমনকি আমেরিকাকে নতুন করে ‘মহান ও গৌরবময়’ হিসেবে গড়ে তোলার যে গালগল্প তিনি আবারও শুরু করেছেন, তা মার্কিন জনগণকে আদৌ আকৃষ্ট করবে কি না, ভেবে দেখার বিষয়। বাস্তবিক অর্থেই সত্য সব সময়ই কঠিন।
স্বীকার করতে হবে, দাম্ভিক ট্রাম্প একাধিক তদন্তের খড়্গ মাথায় নিয়ে ঘুরছেন। এখন তিনি মার্কিন নাগরিকদের কাছে কোনো তারকা নন, বরং সাবেক প্রেসিডেন্ট হিসেবে যতটা মর্যাদা তার থাকার কথা, তেমনটাও নেই—কারণ তিনি ধরে রাখতে পারেননি। অর্থাৎ, তারকা থেকে অনেকটা সাধারণে পরিণত হয়ে ক্রমশ উপেক্ষার পাত্রে পরিণত হয়েছেন ট্রাম্প, যা প্রতাপশালী সাবেক প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার জন্য মেনে নেওয়া কষ্টসাধ্য। তাছাড়া তার চরিত্রের আরেকটি বাজে দিক হলো তিনি ব্যাপক পরশ্রীকাতর। অন্যের ভালো দেখতে পারেন না তিনি। তিনি ভিন্ন অন্য কারো জয় যেন তার চিন্তারও বাইরে! আর সব থেকে বড় বিষয় হলো, তিনি জেলে যেতে চান না স্বভাবতই। যতগুলো তদন্ত তার বিরুদ্ধে চলছে, তাতে অভিযোগ প্রমাণিত হলে কারবরণ তার জন্য অবধারিত। সুতরাং, এসব থেকে রেহাই পেতেই নির্বাচনে নামার ঘোষণার পথ বেছে নিয়েছেন বলে মনে করছেন অনেকে।
২০২৪ সালের নির্বাচনে প্রার্থিতা সম্পর্কে ঘোষণা দিতে নিজ বাসভবন মার-এ-লাগোতে ট্রাম্প অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আবারও মার্কিন জনগণকে ‘মুগ্ধ করা’র চেষ্টা চালান। এমনকি এ সময় তিনি স্বভাবসুলভ ‘আপ্লুত ভাবভঙ্গি’ প্রদর্শনেও খামতি রাখেননি। কিন্তু তার এসব প্রচেষ্টা খুব একটা কাজে এসেছে বলে মনে হয় না। অনুষ্ঠানে অতিথিদের তেমন একটা উপস্থিতি দেখা যায়নি। বড় মাপের রিপাবলিকান নেতার উপস্থিতিও ছিল হাতেগোনা। উপরন্তু, গণমাধ্যমও খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি। যা হোক, ট্রাম্পের অবাস্তব-উদ্ভট কথাবার্তা উপস্থিত লোকজনকে আকৃষ্ট করতে পারেনি—এটা সন্দেহাতীতভাবে স্পষ্ট হয়ে গেছে।
ট্রাম্পের প্রার্থিতা ঘোষণার পর কেবল নিউ ইয়র্ক টাইমসেরই হাফ ডজনের বেশি কলামিস্ট তার বিরুদ্ধে কলাম লেখেন। অবস্থাদৃষ্টে দেখা যাচ্ছে, তার প্রার্থী হওয়ার ঘোষণায় খুশি না হওয়া লোকের সংখ্যাই বেশি। উল্লেখ করার মতো বিষয়, মার-এ-লাগো থেকে যখন ট্রাম্প তার প্রার্থিতার বিষয়ে কথা বলছিলেন, তখন অনেক সাংবাদিক চোখের সামনে দেখছিলেন একটি জীবন্ত দৃশ্য—সাপ ইঁদুরের দিকে তেড়ে আসছে আর সাপ দেখে ইঁদুর প্রাণরক্ষায় পালাচ্ছে!
ট্রাম্প শেষ পর্যন্ত রিপাবলিকান পার্টির মনোনয়ন হাসিল করে চূড়ান্ত প্রার্থী হিসেবে ভোটের মাঠে নামতে সক্ষম হলেও নির্বাচনে জিততে পারবেন না। কেন জিততে পারবেন না? এই প্রশ্নের ব্যাখ্যায় মার্কিন জনগণের কাছে পেছনের দৃশ্যপট তুলে ধরছেন স্বয়ং মার্কিন বিশ্লেষকেরা। বস্তুত, কেন তিনি আর জিততে পারবেন না—এর উত্তর জনগণের কাছেও অজানা নয়। ভোটাররা ট্রাম্পের অনবরত মিথ্যা শুনতে শুনতে ক্লান্ত। প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসে ট্রাম্প এত সব খামখেয়ালি কাজকর্ম করেছেন যে, জনগণ চায় না আরো চার বছর ট্রাম্পের নেতৃত্বে দেশ বিশৃঙ্খলার স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠুক। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, বড় বড় প্রচারণাগোষ্ঠী ট্রাম্প থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ট্রাম্পের কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলেছে তার সাবেক মিত্ররা। আরো বিস্ময়ের ব্যাপার, সঙ্গে নেই ট্রাম্প-তনয়া ইভাংকাও। সন্তানদের সঙ্গে সময় কাটানোর পরিকল্পনা করেছেন ট্রাম্পের এই সাবেক প্রধান সহকারী!
ইতিমধ্যে সবার জানা হয়ে গেছে, রিপাবলিকান পার্টির মনোনয়ন দৌড়েই হোঁচট খেতে হবে ট্রাম্পকে। তার প্রতি জনসমর্থন যেমন তলানিতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, বিপরীতক্রমে ফ্লোরিডার গভর্নর রন দিসান্তিসের প্রতি জনসমর্থন আকাশচুম্বি হয়েছে। অর্থাৎ, মনোনয়ন পেতে ট্রাম্পকে আগে মোকাবিলা করতে হবে নিজ দলের শক্তিশালী দিসান্তিসকে। দিসান্তিসের সঙ্গে লড়াইয়ে ট্রাম্পকে যে বিরাট ধাক্কা খেতে হবে, দিসান্তিসের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তায় তা ক্রমশ পরিষ্কার হয়ে উঠছে।
একবার বোকামি করলে তাকে লজ্জা হিসেবে মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু জেনেশুনে বারবার বোকামি করলে তা আর লজ্জার পর্যায়ে থাকে না, ‘বোকামি’ হিসেবেই রয়ে যায়। তাই মার্কিন জনগণ ‘বোকার তকমা’ মাথায় নিয়ে লজ্জিত হতে চায় কি না, তা তাদেরই ভেবে বের করতে হবে। বিভিন্ন জরিপ বলছে, বেশির ভাগ ভোটার চান না ২০২৪ সালে ট্রাম্প প্রার্থী হোক। এই সংবাদ ডেমোক্রেটিক পার্টির জন্য স্বস্তিদায়ক বটে। কিন্তু এ-ও উল্লেখ্য, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রতিও মার্কিন ভোটারদের আস্থা নিচের দিকে নামছে। এ রকম অবস্থায় দাঁড়িয়ে আবারও যদি বাইডেন-ট্রাম্প ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়, তবে ফলাফল কী হতে পারে তা নিশ্চিত করে বলতে পারা বেশ মুশকিল।
মধ্যবর্তী নির্বাচনের পর বাইডেন বিশ্বকে বার্তা দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমেরিকা ফিরে এসেছে।’ বাইডেনের ঘোষণার পর মনে হচ্ছিল, ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে ভোটে আসার খায়েশ মুখ থুবড়ে পড়েছে। কিন্তু বাস্তবে ট্রাম্প ফিরে আসার চেষ্টায় মরিয়া। বাইডেনের কথার বাস্তব চিত্র যেহেতু উলটে গেছে, সুতরাং তাকেও বুঝেশুনে পা ফেলতে হবে। মধ্যবর্তী নির্বাচনের আগে ডেমোক্রেটিক পার্টির ভবিতব্য নিয়ে বহু কথা বলা হয়েছে। নির্বাচনের ফলাফল হাতে আসার পর পুতিন ও ট্রাম্পের ভক্তরা এখন জোরেশোরে কথা বলতে শুরু করেছেন। যেমন—হাঙ্গেরির নেতা ভিক্টর অরবান মন্তব্য করেছেন, বাইডেন যেভাবে ইউক্রেনকে সাহায্য করছেন, তা কমাতে বাধ্য করবে মার্কিন জনগণ।
ভুলে গেলে চলবে না, ট্রাম্প বেশ আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলেছেন, ‘২০২৪ সালে জিততে চাই আমি।’ অর্থাৎ, ধরে নিতে হবে, এটি পুরো গালগল্প নয়। বাস্তবতা হলো, অধিকাংশ রাজনীতিবিদ রক্ত, ঘাম ঝরিয়ে জিততে চেষ্টা করেন। অন্যদিকে, ট্রাম্পের মতো নেতারা হট্টগোল বাধিয়ে, ব্যাঘাত সৃষ্টি করে, বিভ্রান্তি ছড়িয়ে এমনকি বিভাজনের জাল বিস্তার করে হলেও বিজয় ছিনিয়ে আনতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। সুতরাং, মার্কিন জনগণকে ভেবেচিন্তে পা ফেলতে হবে। ট্রাম্পের মতো নেতার অহংকার তার নিজের ওপর, জনসেবা বা দেশসেবায় নয়। এমতাবস্থায়, জনগণের কী করা উচিত? এর উত্তর বেশ সহজ। ট্রাম্পকে উপেক্ষা করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। ট্রাম্পের মতো শাসকদের ওপর থেকে সরাসরি মুখ সরিয়ে নেওয়া কঠিন ও বিপজ্জনক যদিও, কিন্তু সবার কল্যাণের জন্য এটা করা ছাড়া ভিন্ন পথ নেই।
লেখক :পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষক ও কলামিস্ট
দ্য গার্ডিয়ান থেকে অনুবাদ :সুমৃত্ খান সুজন