জমকালো আয়োজনের মধ্য দিয়ে কাতারের দোহায় শুরু হয়েছে ফুটবল বিশ্বকাপের এবারের আসর। এর মধ্য দিয়ে ইতিহাস রচনা করল কাতার! ২০১০ সালে ‘২০২২-বিশ্বকাপ’-এর আয়োজক হিসেবে কাতারের নাম ঘোষণা করা হয়। ফিফার এই ঘোষণা মরুর কাতারকে এনে দেয় এক বিশেষ উপলক্ষ্য। বিশ্বকাপের সফল আয়োজনে কোমর বেঁধে নেমে পড়ে মরুর দেশ কাতার। ২২০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে ফুটবল ভেন্যুসহ পুরো কাতারকে রাঙিয়ে তুলতে শুরু হয় তোড়জোড়। ভিন্ন ভিন্ন রং ও ডিজাইনে তৈরি করা হয় সাতটি বিশাল স্টেডিয়াম। নির্মাণ করা হয় নতুন বিমানবন্দর। মেট্রো সিস্টেম গড়ে তোলার পাশাপাশি চোখধাঁধানো উন্নয়ন ঘটানো হয় যোগাযোগ অবকাঠামোয়। নতুন নতুন রাস্তাঘাট নির্মাণ করা হয়। তৈরি করা হয় শ খানেক হোটেল। আরো মজার ব্যাপার, যে স্টেডিয়ামে ফাইনাল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা, তার চারপাশে গড়ে তোলা হয় গোটা একটি শহর!
যা হোক, কাতারে অনুষ্ঠিত এবারের বিশ্বকাপ রেকর্ড গড়েছে ওপরের বিষয়গুলোর জন্য নয়। কারণ অন্যখানে। কাতার বিশ্বকাপের মধ্য দিয়ে কোনো মুসলিম দেশে প্রথম বারের মতো ফুটবল বিশ্বকাপ মঞ্চায়িত হলো। ফুটবল বিশ্বকাপ শুরুর এতটা দীর্ঘ সময় পর মুসলিম বিশ্বের মাঠে বল গড়ানোর চিত্র নিঃসন্দেহে ইতিহাসই! ২০১০ সালে ফিফা যখন কাতারকে বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ হিসেবে ঘোষণা করে, তখন থেকেই শুরু হয় নানা আলোচনা-সমালোচনা। বিশেষ করে দুটি বিষয় মানুষকে যারপরনাই আগ্রহী করে তোলে। মুসলিম জাহানের বহু মানুষ ইন্টারনেটে পণ্ডিতদের কাছে জানতে চান, পেশাদার ফুটবল নিয়ে ধর্মীয় বিধিবিধান কী বলে? টুর্নামেন্ট জুড়ে ৬৪টি ম্যাচ চলাকালীন আয়োজক কর্তৃপক্ষ অ্যালকোহল বিক্রি করতে পারবে কি না, তথা মুসলিম দেশ হিসেবে কাতারে অ্যালকোল-সংক্রান্ত কী কী বিধিনিষেধ থাকবে? সত্যিকার অর্থে, অনলাইন ও অফলাইনে এ দুটি প্রশ্নই এসেছে ঘুরেফিরে। এবারের বিশ্বকাপ নিয়ে গুগলে এ দুটি প্রশ্নই সবচেয়ে বেশি জিজ্ঞাসিত। উল্লেখ করার মতো বিষয়, প্রশ্ন দুটির জবাবে বহু ব্যাখ্যা এসেছে অনলাইন ও অফলাইন উভয় প্ল্যাটফরম থেকে। প্রথম সওয়ালের জবাবে বলা হয়, খেলার ধরন সম্পর্কে না জেনে আগে থেকেই কোনো কথা বলা তথা ফতোয়া (ইসলামি বিধিনিষেধ) জারি করা জায়েজ হবে না। কারণ এর ফলে ‘ফিতনাহ (আপত্তিকর, মানহানিজনক) সৃষ্টি হতে পারে। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর—কাতারের হোটেল বা রেস্তোরাঁয় অ্যালকোহলযুক্ত পানীয় কেনা ও পান করা যাবে, যদি তা আপনার নিজের দেশে নিষিদ্ধ বা সীমাবদ্ধ না থাকে! শেষ পর্যন্ত, নির্ধারিত জায়গা ছাড়া অ্যালকোহল পানে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
শুধু মুসলিম দেশ বলেই যে কাতার বিশ্বকাপ ইতিহাস সৃষ্টি করছে, ব্যাপারটা এমন নয়। বরং সবচেয়ে ছোট আয়োজক দেশ হিসেবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রীড়া ইভেন্টের আয়োজন করার রেকর্ড এটি। আগের বিশ্বকাপগুলোর আয়োজক দেশগুলোর তালিকা গুগলে সার্চ করলে এর প্রমাণ মিলবে। রেকর্ড গড়ার আরেকটি দিক হলো ‘অর্থ ব্যয়’। আয়োজক দেশ হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর ২০১৩ সালে পদত্যাগ করার আগ পর্যন্ত কাতারের আমির শেখ হামাদ এবং পরবর্তীকালে তার ছেলে বর্তমান আমির শেখ তামিম ইবনে হামাদ আল থানি বিশ্বকাপের মঞ্চ প্রস্তুতিতে কীভাবে দুই হাত ভরে অর্থ ঢেলেছেন, তার সাক্ষী পুরো বিশ্ব। এ কথা সত্য, কাতার যে অর্থ ব্যয় করেছে, তার বেশির ভাগই ফেরত আসবে। যেসব স্থাপনা, হোটেল, স্টেডিয়াম, পার্ক নির্মাণ করা হয়েছে, তার সবই স্থায়ীভাবে যোগ হবে কাতারের জাতীয় সম্পদে। কিন্তু অন্য দৃষ্টিতে দেখলে, এই ঐতিহাসিক বিশাল আয়োজনযজ্ঞের সফল ব্যবস্থাপনা ইতিহাসের পাতায় কাতারের নাম লিপিবদ্ধ থাকবে।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই বিশ্বকাপে কাতার এখন পর্যন্ত আতিথেয়তা এবং অন্যান্য পরিষেবার পেছনে কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে, যার কানাকড়িও ফিফা বা প্রতিযোগী দলগুলো থেকে নেওয়া হয়নি। অধিকন্তু, অপারেটিং খরচের জন্য অতিরিক্তি প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার ব্যয় চাপে কাতারের ঘাড়ে। এই ব্যয় আংশিকভাবে ফিফা বহন করছে বটে, কিন্তু আন্তর্জাতিক টেলিভিশন সম্প্রচার লাইসেন্স ফি থেকে অর্জিত ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের পুরোটাই যাবে ফিফার পকেটে! বিশেষজ্ঞদের অনুমান, এই ইভেন্ট থেকে কাতারের ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি রাজস্ব আয় হবে না। বস্তুত, চোখধাঁধানো বিশ্বকাপ আয়োজন করতে গিয়ে দেশের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফাঁকা করে ফেলেছে কাতার। গত ১২ বছরে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে পিছপা হননি আমির শেখ তামিম। আশ্চর্যজনকভাবে সফল বিশ্বকাপ আয়োজনে পুরো সমর্থন ছিল কাতারিদেরও। এই ব্যয় সংস্থান করতে গিয়ে তারা দৈনন্দিন খরচ কমাতে বাধ্য হবে কি না—এমন প্রশ্নে তাদের বিন্দুমাত্র উদ্বেগ ছিল না। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বিশ্বকাপ আয়োজন করতে গিয়ে কাতার যে ২২০ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে, তা এক কথায় ‘বিপুল পরিমাণ অর্থ’।
সুতরাং, প্রশ্ন উঠতে পারে, এত বিপুল অর্থ কেন খরচ করতে গেল কাতার? এর পেছনে কি কোনো উদ্দেশ্য বা কারণ আছে? আমার কাছে মনে হয়েছে, প্রতিটি পয়সা ব্যয় করার পেছনে আসল কারণ হলো, কাতার কেবল দেশ জুড়ে রাস্তাঘাট, হোটেল, স্টেডিয়াম, পার্কই গড়ে তুলতে চেষ্টা করেনি, বরং আমির শেখ তামিমের সুদূরপ্রসারি চিন্তায় ছিল অতিমাত্রায় ‘সফট পাওয়ার (শক্তি প্রদর্শনের পথে না হেঁটে পারস্পরিক সহযোগিতা, বিশেষ কোনো দিক উপস্থাপনের মাধ্যমে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা প্রভৃতির মাধ্যমে নিজের অবস্থান জানান দেওয়া)’ সঞ্চয় করা। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এই শব্দকে এনসাইক্লোপিডিয়া নতুন নাম দিয়েছে ‘স্মার্ট পাওয়ার’, যা ‘হার্ড পাওয়ার’ ও ‘সফট্ পাওয়ার’-এর সংমিশ্রণ হিসেবে আখ্যায়িত।
উল্লেখ করতেই হয়, বিশ্বে কাতারের নাম এখন বৃহত্তম প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদনকারী দেশের তালিকাতেই শুধু নয়, সর্বোচ্চ মাথাপিছু আয়ের দেশের খেতাবের পাশে বড় হরফে আরেকটি অর্জন যুক্ত হলো—ফুটবল বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় ‘সফল আয়োজক’। বিশ্ব রাজনীতি কিংবা ভূ-কৌশলগত প্রশ্নে এই অঞ্চলে কাতারের যেহেতু বিশালাকৃতির সামরিক বাহিনী নেই; তাই জোট, অংশীদারত্ব ও স্তরভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রচুর পরিমাণে বিনিয়োগের মাধ্যমে ‘সফট্ পাওয়ার’ প্রদর্শনের পথে হাঁটবে মরুর দেশটি—এ তো সহজ হিসাব। অর্থাৎ, বিশ্বকাপে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করাকে কাতারের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা কিংবা তার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডকে বিশ্বরাজনীতিতে ‘বৈধ’ করে নেওয়ার প্রতিষ্ঠা হিসেবে দেখে থাকবেন অনেকে।
সৌদি আরবের মোহাম্মদ বিন সালমান এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মুহাম্মাদ বিন জায়েদ—এই দুজনের কথা কি কাতার ভুলতে পারবে? কয়েক বছর আগে কাতারিদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিলেন এই দুজন। কাতারের বিরুদ্ধে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলা হয়েছিল। এই অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে মুসলিম ব্রাদারহুড গ্রুপ, দায়েশ, আল-কায়েদাসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে অর্থায়ন ও সমর্থন করার জন্য কাতারের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাঁড় করানো হয়। এমনকি কাতারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দিয়ে বসে দেশ দুটি।
ফুটবল বিশ্বকাপ একটি জাদুকরি মঞ্চ। বিশ্বকাপ আয়োজনের সুযোগ পেলে স্বাভাবিকভাবেই যে কোনো দেশই তার পুরোটা উজাড় করে দিয়ে সফলতা অর্জনের সর্বোচ্চ চেষ্টাটাই করবে। যদিও কাতার এক্ষেত্রে একটু বেশিই এগিয়ে। তবে দিন শেষে তো লাভ কাতারেরই—এ কথা বলাই বাহুল্য। বিশ্বকাপ আয়োজনের সিঁড়ি বেয়ে অত্যাধুনিক অবকাঠামো, রাস্তাঘাট, পরিবহন ও প্রযুক্তির বিচারে কাতার এখন বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক মুসলিম দেশ। উপরন্তু, এই বিশ্বকাপ কাতারকে বিশ্বব্যাপী কূটনৈতিক প্রতিপত্তি তথা ‘সফট্ পাওয়ার’ প্রদর্শনের মহাসুযোগ করে দিয়েছে। কাতার ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক লার্বি সাদিকি যেমন বোমা ফাটিয়েছেন—‘একটি মুসলিম দেশ যে বিশ্বকাপের মতো বিশাল অনুষ্ঠান আয়োজন করতে পারে, কাতার তা প্রমাণ করতে পেরেছে। উপনিবেশবাদ-উত্তর আখ্যানের অংশ হিসেবে আমি সবাইকে মনে করিয়ে দিতে চাই, নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে বলা হয়েছিল, মুসলিম দেশকে কোনো একটা মহাদেশের মাঝখানে এসে দাঁড়ানোকে বরদাস্ত করা হবে না কোনোভাবেই! অথচ আজ একটা মুসলিম দেশ বিশ্বকাপের মতো বিশাল মঞ্চের আয়োজন করে দেখিয়ে দিল, কতটা ভুল ছিল সেই চিন্তা!’
সুতরাং, এ কথা বলতেই হয়, ২০২২ বিশ্বকাপের সফল আয়োজনের মধ্য দিয়ে কাতার এক মহাকাব্যের জন্ম দিয়েছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ভিন্ন ধাঁচের পরিবেশনার প্রশ্নেই হোক, বহু দাবি-দাওয়ার জোর দাবির কাছে মাথা নত না করার প্রশ্নেই হোক, কাউকে জবাব দিতেই হোক কিংবা বয়কটের শঙ্কাকে পাত্তা না দেওয়ার নিরিখেই হোক—কাতার বিশ্বকাপ ইতিহাসে এক অনন্য নজির হিসেবে পাকাপোক্ত স্থান করে নিয়েছে।
লেখক : রাজনীতি বিশ্লেষক ইংরেজি থেকে অনুবাদ :সুমৃৎ খান সুজন