শনিবার, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৪ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্সগুলি কেন আইসিইউতে?

আপডেট : ২৩ নভেম্বর ২০২২, ০০:০৪

একটি জনপ্রিয় বাংলা প্রবাদ রহিয়াছে—হায় রে কপাল মন্দ চোখ থাকিতে অন্ধ। বাঙালি জাতির মন্দ কপালের জন্য তাহার স্বভাবও বহুলাংশে দায়ী। কোভিডের সময় যখন সারা দেশে নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র তথা আইসিইউয়ের জন্য একধরনের আশঙ্কা ও হাহাকার দেখা দিয়াছিল এবং আইসিইউ সুবিধাসংবলিত অ্যাম্বুলেন্স যখন জীবন রক্ষা করিবার অন্যতম হাতিয়ার হইয়া পড়িয়াছিল, তখন আমরা বন্ধুপ্রতিম দেশ ভারতের নিকট হইতে ১০৯টি লাইফ সাপোর্ট অ্যাম্বুলেন্স উপহার পাইয়াছিলাম। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসিয়া ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই শতাধিক বিশেষ অ্যাম্বুলেন্স উপহার দেওয়ার ঘোষণা দিয়াছিলেন। সেই অনুযায়ী আমরা এই অত্যাধুনিক অ্যাম্বুলেন্সগুলি উপহার পাই। জীবন রক্ষাকারী অ্যাম্বুলেন্সগুলির নিঃসন্দেহে বিপুল গুরুত্ব রহিয়াছে, একই সঙ্গে এইগুলি বন্ধুপ্রতিম দেশের উপহার। সুতরাং বিশেষ অ্যাম্বুলেন্সগুলির যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও সর্বোত্তম ব্যবহার করা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। কিন্তু যাহা আমরা ক্লেশ ছাড়াই আয়েশ করিয়া পাই, আমরা তাহার মর্ম বুঝি না। 

ভারতের উপহারের ১৬৩ কোটি টাকা মূল্যের ১০৯টি অত্যাধুনিক লাইফ সাপোর্ট অ্যাম্বুলেন্স অনাদরে এখন নষ্ট হইতেছে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত এই সংক্রান্ত বিস্তারিত প্রতিবেদন হইতে জানা গিয়াছে, এই সকল বিশেষায়িত অ্যাম্বুলেন্স চার ধাপে দেশের ৬৪ জেলায় দেওয়া হইলেও দেড় বৎসরেও কাজে লাগানো যায় নাই ৪০টি অ্যাম্বুলেন্স। এইগুলি পড়িয়া রহিয়াছে খোলা আকাশের নিচে। বাকি ৬৯টিও যে যথোপযুক্তভাবে কাজে লাগানো হইয়াছে—তাহাও নহে। সেইগুলি মাসে দু-একদিন সাধারণ রোগী বহন করিতেছে। একটি সুপার কম্পিউটারকে কেবল কম্পোজ করিবার জন্য টাইপরাইটারের মতো ব্যবহার করিলে যাহা হয়—এই ক্ষেত্রে তাহাই হইতেছে। 

প্রতিবেদনগুলি বলিতেছে, অ্যাম্বুলেন্সগুলি ব্যবহারের জন্য নীতিমালা না থাকা, জ্বালানি বরাদ্দে জটিলতা, নার্স ও চালকসংকটের কারণে উহাদের কাজে লাগানো যাইতেছে না। রোদ-বৃষ্টির মধ্যে হাসপাতাল চত্বরে খোলা পড়িয়া থাকিতে থাকিতে অ্যাম্বুলেন্সগুলির কার্যক্ষমতা ও আয়ুষ্কাল কমিয়া যাইবার আশঙ্কা দেখা দিয়াছে। অথচ এই সকল অ্যাম্বুলেন্সে একটি আইসিইউ পোর্টেবল ভেন্টিলেটর, জরুরি ওষুধ, ইনকিউবেশন সেট, অক্সিজেন সিলিন্ডার, সাকশন মেশিন, নেবুলাইজার মেশিন, ক্যাথেটার, বিপি স্টেথো, পালস অক্সিমিটার, কার্ডিয়াক মনিটর পালস, স্যাচুরেশন, তাপমাত্রা পরিমাপক যন্ত্র, মনিটর ব্যবস্থা, পথেই রোগীর  হৃত্স্পন্দন ভেন্ট্রিকুলার টাকাইকার্ডিয়া (ভিটি) এবং ভেন্ট্রিকুলার ফাইব্রিলেশন (ভিএফ) প্রভৃতি সুবিধা রহিয়াছে। দুঃখজনকভাবে অনাদর-অবহেলায় পড়িয়া থাকিবার ফলে বেশির ভাগ অ্যাম্বুলেন্সের গায়ে ধুলার আস্তরণ জমিয়াছে। দীর্ঘদিন একই জায়গায় পড়িয়া থাকায় ব্যাটারি অকেজো হইয়া গিয়াছে। কোনো কোনো অ্যাম্বুলেন্সের ভেন্টিলেশন, অক্সিজেন ও পালস অক্সিমিটার উধাও হইয়া গিয়াছে। অন্য যন্ত্রপাতিও অ্যাম্বুলেন্সে ঠিকমতো নাই। 

যদিও সংশ্লিষ্টরা বলিতেছেন, এই সকল জিনিস খুলিয়া রাখা হইয়াছে। বিশেষায়িত এই সকল অ্যাম্বুলেন্স চলাচলের সময় রোগীর নিবিড় পরিচর্যার জন্য একজন চিকিৎসক ও নার্স থাকাটা বাধ্যতামূলক। কিন্তু এই অ্যাম্বুলেন্সগুলি কীভাবে পরিচালিত হইবে, এই বিষয়ে কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয় নাই। প্রবাদ আছে—ইচ্ছা থাকিলে উপায় হয়। সুতরাং এই প্রশ্ন উত্থাপন করাটাই সংগত যে, এই সকল মূল্যবান বিশেষায়িত অ্যাম্বুলেন্সের যথাযথ ব্যবহারের ক্ষেত্রে যাহা যাহা করিতে হইবে—তাহা কেন করা হইল না? সময় তো কম পার হয় নাই—প্রায় দেড় বৎসর চলিয়া গিয়াছে। যাহাদের দায়িত্বে এই অ্যাম্বুলেন্সগুলি রহিয়াছে—তাহারা কেন এত দীর্ঘ সময় ধরিয়া এতখানি দায়িত্বজ্ঞানহীন হইবেন? কেন এই জন্য তাহারা জবাবদিহি করিবেন না? অথচ চিকিৎসকরাই জানাইয়াছেন, উন্নত চিকিৎসার জন্য মুমূর্ষু রোগীদের মফস্বল হইতে ঢাকায় স্থানান্তরের সময় বহু ক্ষেত্রেই সার্বক্ষণিক আইসিইউ সেবার দরকার হয়। সেই সকল ক্ষেত্রেও এই অ্যাম্বুলেন্সগুলি জীবনদায়ী ভূমিকা রাখিতে পারিত। জানা গিয়াছে, দ্রুত সময়ের মধ্যে অ্যাম্বুলেন্সগুলি কীভাবে সচল করা যায়, তাহার নীতিমালা তৈরির কাজ করিতেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কিন্তু প্রশ্ন হইল—মরা গাঙে বান আসিবে আর কত প্রতীক্ষার পর?

ইত্তেফাক/ইআ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন