ছোট্ট জীবন পেয়েও নশ্বর পৃথিবীতে কেউ কেউ রেখে যান অবিনশ্বর কীর্তি। একের পর এক অমর সৃষ্টির স্বাক্ষরে ছোট্ট জীবনকে করে তোলেন তাত্পর্যময়। শরীরী অস্তিত্ব না থাকলেও মননশীল সৃষ্টিকর্মের মধ্য দিয়ে মানুষের মনে বেঁচে থাকেন যুগ যুগ ধরে। সৃষ্টিশীলতার নেশায় প্রকৃতি দাঁপিয়ে বেড়ানো এমনই এক চিত্রশিল্পী মবিনুল আজিম। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ভাবশিষ্য মবিনুল আজিম বাস্তবিক অর্থেই ছিলেন রং-তুলির জাদুকর। আজিম তার শিল্পের রং খুঁজে নিতেন প্রজাপতির ডানা থেকে। তিনি রং নিতেন ভোরের আকাশ থেকে, শীতের শিশিরবিন্দু থেকে, পড়ন্ত গোধূলি থেকে। কখনো অন্ধকারের জ্যোত্সনা, কখনো-বা তারার ঝলকানি থেকে রং নিয়ে প্রকৃতির কোলে বসে ছবি আঁকতেন আজিম। তার তুলির নিপুণ ছোঁয়ায় জীবন্ত হয়ে ধরা দিত প্রকৃতি ও প্রকৃতির মানুষ।
আজিম ছিলেন বাস্তবধর্মী চিত্রশিল্পী। বাংলাদেশে চারুকলার পথিকৃৎ হিসেবে তিনি সর্বজনস্বীকৃত। চারপাশের বিভিন্ন অনুষঙ্গ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে একমনে আঁকতে বসে যেতেন আজিম। তার আঁকা ছবি নিয়ে প্রথম প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় ১৯৬১ সালে। এরপর ১৭টি একক ও ৩৭টি যৌথ প্রদর্শনীর মাধ্যমে দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে আজিমের নাম। প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় পাকিস্তান, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।
১৯৩৪ সালের ২৪ নভেম্বর বিক্রমপুরে জন্মগ্রহণ করা আজিম ১৯৫৫ সালে বাংলাদেশ চারুকলা ও কারুশিল্প কলেজ (বর্তমানে চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে চারুকলায় স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। উল্লেখ করতেই হয়, আজিমের বাবা-মায়ের ইচ্ছা ছিল ছেলে বড় হয়ে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বা বড় কোনো আমলা হবে। কিন্তু সেই পথে হাঁটেননি প্রকৃতিপ্রেমিক আজিম। রঙ-তুলি বেছে নেন তিনি।
আধুনিক চিত্রশিল্পী বলতে যা বোঝায়, আজিম ছিলেন তা-ই। রং করার কাজে ব্রাশ ও প্যালেট ছুরিই শুধু ব্যবহার করেননি তিনি, আঙুলের চাপে প্রাণের সঞ্চার ঘটিয়েছেন একেকটা চিত্রকর্মে। বস্তুত তিনি হয়ে উঠেছিলেন চিত্রশিল্পের পরীক্ষক, গবেষক। বালু, সিমেন্ট, কাপড়, নাইলনের জাল, পাটসহ বিভিন্ন ক্যানভাসে নানা উপকরণের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতেন জীবন ও প্রকৃতির ছবি। পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের সংগ্রামী জীবনের সৌন্দর্যকে যেমন তিনি তুলির জাদুতে ফুটিয়ে তুলেছেন, তেমনি তার তুলির আঁচড়ে জীবন্ত হয়ে ধরা দিয়েছে জীবন ও চলার পথের প্রতিদিনকার জীবনচিত্র।
শুধু চিত্রাঙ্কনেই নয়, বাংলাদেশের মুক্তিকামী কৃতী সন্তান আজিমের সক্রিয় ভূমিকা ছিল ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনেও। সে সময় তিনি ঢাকা আর্ট কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের ওপর গুলি চালানোর প্রতিবাদে আজিম বেশ কিছু সভার আয়োজন করেন। সেই সময়কালে ভাষা আন্দোলনের ওপর বহু পোস্টার ও চিত্রকর্ম তৈরি করেছিলেন তিনি।
শিল্পচর্চার জন্য ১৯৫৭ সালে আজিম পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি শহরে চলে যান এবং সেখানে ১৬ বছর কাটান। আজিম পাকিস্তানের অ্যালায়েন্স ফ্রান্সিস করাচিতে শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। তিনি পাকিস্তানের করাচির পাকিস্তান-আমেরিকান সেন্টার এবং ঢাকার শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজের প্রভাষকও ছিলেন। আজিম ১৯৬৫ সালে মমতা আজিমের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দম্পতির দুই কন্যা হুমায়রা আজিম ও সুমায়রা আজিম।
ষাটের দশক জুড়েই পাকিস্তানের শিল্পজগতের পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন আজিম। পরিবেশগত ও মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলো যত্নসহকারে ফুটিয়ে তুলতে আজিমের কাজের জুড়ি ছিলনা। আধুনিক জীবনের এমন সব শৈল্পিক ছাপ তৈরি করে গেছেন আজিম, যা আজও সবার মনে দাগ কেটে যায়। শুরু থেকেই প্রকৃতি ছিল আজিমের রচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। তিনি যেসব চিত্রকর্ম, জলরং ও স্কেচ তৈরি করেছেন, আজকের দিনে দাঁড়িয়েও তা বিস্ময় ছড়িয়ে চলেছে। ১৯৫০ থেকে ১৯৭০-এর দশকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পূর্ব ও স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ভারত উপমহাদেশের অন্যতম চিত্রশিল্পী হিসেবে যে আলো ছড়ান আজিম, তার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পেয়েছেন অসংখ্য স্বীকৃতি-পুরস্কার। ১৯৬৩, ১৯৬৪ ও ১৯৬৭ সালে করাচি আর্ট কাউন্সিলের বার্ষিক চিত্র প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করে প্রথম পুরস্কার লাভ করেন আজিম। স্বভাবতই বাংলাদেশের চিত্রকলার অগ্রগণ্য এই চিত্রকরকে সম্মানিত করেছে আপন মাতৃভূমি। চিত্রকলায় তার অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার ২০১২ সালে তাকে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে (মরণোত্তর) ভূষিত করে। বাংলাদেশ সরকার সম্মানের প্রতীক হিসেবে তার একটি বিশ্বমানের চিত্রকর্ম যুক্তরাজ্যের লন্ডনের সোনালী ব্যাংক শাখায় এবং একটি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে টাঙিয়ে রেখেছে।
গুণীজনেরা শিক্ষা নেন প্রকৃতি থেকে, চারপাশের জগত থেকে। তারা খেলা করেন প্রকৃতির সঙ্গে। খেলতে খেলতে মিশে যান গাছের সঙ্গে, পাখপাখালির সঙ্গে। এভাবেই একসময় প্রকৃতির সঙ্গে হয়ে যান ‘একাত্মা’। ক্ষণজন্মা আজিমের বেলায়ও ঠিক এমনটাই ঘটে। যে নভেম্বরে তিনি ধূলিধরায় পা রেখেছিলেন, সেই নভেম্বরেই তিনি যাত্রা করেন না ফেরার দেশে। ১৯৭৫ সালের ১ নভেম্বর মধ্যরাতে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান এই শিল্পী। আজ শিল্পী নেই, কিন্তু দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে আছে তার অসংখ্য শিল্পকর্ম। শিল্পীপত্নী মমতা আজিম শিল্পীর সৃষ্টিকর্ম দিয়ে সাজিয়েছেন বাড়ির চার দেওয়াল। নদীর ঘাটে সারি বাঁধা নৌকা, ছন্দোময় বসন্তের দৃশ্যকাব্য, আবহমান গ্রামবাংলার মন ভোলানো নিসর্গ—শিল্পীর আঁকা এমন বহু ছবি এখনো পরম মমতায় আগলে রেখেছেন মমতা আজিম।
স্বল্প জীবনের পথচলায় মাত্র ৪১টি বসন্ত পার করা আজিম আজও সমহিমায় ভাশ্বর। তিনি যে ছোট্ট জীবন পেয়েছিলেন, তাকেই রাঙিয়েছিলেন কর্মে, সৃজনে। তুলির প্রতিটি আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলেছিলেন অনেক না বলা কথা। শিল্পীর আরো অনেক কিছু দেওয়ার ছিল আমাদের। কবিগুরু, নজরুল, পল্লিকবি কিংবা জীবনানন্দের সৃষ্টিগুলোকে রং-তুলিতে ফুটিয়ে তোলার আগ্রহ ব্যক্ত করেছিলেন। কাজ শুরুও করেছিলেন। কিন্তু হেরে যান নিয়তির নিয়মের কাছে। থেমে যেতে হয় তাকে। তা না হলে কে জানে—আরো অগণিত শিল্প জীবন পেত মবিনুল আজিমের তুলির আঁচড়ে!
লেখক : সাংবাদিক