শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

‘জীবে দয়া করে যেই জন’

আপডেট : ২৪ নভেম্বর ২০২২, ০১:৩৯

এ বছরের সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে বেঙ্গালুরু ভ্রমণ করি। এটা দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক প্রদেশের রাজধানী শহর। কলকাতা থেকে বিমানযোগে সেখানে পৌঁছি। আগের দুই দিন কলকাতায় ছিলাম। একটি বেসরকারি বিমান ফ্লাইট ছিল। বিমানে বেঙ্গালুরু যেতে দুই ঘণ্টার একটু বেশি সময় লাগে। বিমানবন্দরের নাম ক্যাম্পেগোড়া। সেখান থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দক্ষিণে নারায়াণা হাসপাতাল। কেবল হৃদরোগের বড় হাসপাতাল বা হৃদয়ালয় নয়, এক বিশাল স্বাস্থ্যসেবা কমপ্লেক্স, এক উপশহর। যার তত্ত্বাবধানে এই প্রতিষ্ঠানসমূহ গড়ে উঠেছে, তথা যিনি এর বোর্ড চেয়ারম্যান, তাকে আজকের চিকিৎসা-দুনিয়ার সবাই চেনে এবং জানে। তার নাম—ডা. দেবীপ্রসাদ শেঠি। একজন বিস্ময়সৃষ্টিকারী মানব ও জীবন্ত কিংবদন্তি। যিনি মানবিকতা, সংবেদনশীলতা ও আন্তরিকতা দিয়ে মানুষের কল্যাণে নিরন্তর কাজ করে চলছেন। ইতিমধ্যে তিনি মানবসেবায় এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। ৬৯ বছর বয়সি সৌম্যদর্শন এই চিকিৎসককে সরাসরি দেখলে যে কারো বুঝতে কষ্ট হবে যে, তিনি এখন একজন সিনিয়র সিটিজেন। তার দীর্ঘ অবয়বের সর্বত্র যেন ঈশ্বরের হাতের স্পর্শ লেগে আছে। যে কারণে সব মানুষই তার হাতের স্পর্শ পেতে চায়।

গত ২৭ সেপ্টেম্বর সকালবেলায় স্থানীয় এসআরটি আলপিন নামের একটি মাঝারি মানের হোটেল থেকে নারায়ণা কমপ্লেক্সের দিকে হেঁটে এগোতে থাকি। পথে নানা বর্ণের মানুষের মুখোমুখি হই। সহজেই অনুমান করা যায়, আগতদের বেশির ভাগই বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, বিহার, ওড়িশার মানুষ। আমার এক বন্ধুর হৃদরোগ জটিলতা নিয়ে এখানে আসা। নিজে রোগী নই, তবে রোগীর সহযোগী একজন। খুব সকালে উঠে সে যথারীতি এনজিওগ্রাম করার ব্যবস্থা নেয়। এদিকে আমি চেষ্টা করছি স্বয়ং দেবীপ্রসাদ শেঠির সামনে তাকে উপস্থাপন করা যায় কি না। এতেই নাকি সে অর্ধেক সুস্থ হয়ে যাবে। ব্যক্তিগত স্টাফদের মাধ্যমে তার পর্যন্ত পৌঁছার ইচ্ছে পোষণ করায় তারা আমাকে আন্তর্জাতিক ডেস্কে রিপোর্টিং শেষে আসতে বললেন। আমি যথারীতি তা-ই করলাম। তারা আমার সম্পর্কে বিস্তারিত জানার কৌশল অবলম্বন করেন। লক্ষ করে দেখেছি, এ জায়গায় আমার ৩২ বছরের দীর্ঘ চাকরিটা বেশ কাজে দিয়েছে। মনে হলো, সিভিল সার্ভিস, ডিএম, ডিভকম, সেক্রেটারি এগুলোর মূল্য ওদের দেশে এখনো ফুরিয়ে যায়নি। একসময়ে এ পদবিগুলোর নামের খ্যাতি ও জ্যোতি উপমহাদেশ জুড়েই ছড়িয়েছিল। শিক্ষিত মধ্যবিত্তের কাছে লোভনীয় ও চিত্তাকর্ষক ছিল। এদের আন্তরিকতায় আমি আনন্দিত ও বিমোহিত। ভাবছিলাম, একেবারে বৃথা যায়নি আমার বহমান জীবনের পেছনের পর্বগুলো।

দুপুরের আগেই বিশ্ববরেণ্য এই কার্ডিয়াক সার্জনের সঙ্গে আমার সরাসরি সাক্ষাৎ ঘটে। যিনি স্বহস্তে ১৬ হাজার হৃদরোগীর বুকের পাঁজর কেটেও স্থির ও স্বাভাবিক আছেন। একই সঙ্গে প্রায় ৫ হাজার শিশুরও সার্জারি করেছেন। তিনি আপাদমস্তক পেশাদার একজন চিকিৎসক। বিগত ৩৫ বছরের প্রবহমান সময়ের প্রতি সেকেন্ডকে মূল্য দিয়ে চলেছেন। সোজা অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয়ে এসে তার চেয়ারে আসন গ্রহণ করেন। তবে আমি চেয়ে আছি দরজায় লেখা তার নেমপ্লেটের দিকে। Dr. Devi Shetty MS, FRCS (England)। অনুমতিসহ রুমে প্রবেশ করতেই আমাকে সহাস্যে এক অভাবনীয় ভঙ্গিতে বরণ করেন। তার করমর্দনের উষ্ণতা ও চোখের আলোতে আমি এ হৃদয়ালয়ে এসে হৃদয় নিংড়ানো সৌজন্যে অভিভূত হই। আমি যেন বসে আছি এক দীর্ঘদেহী গৌরবর্ণের পৌরুষের মূর্ত প্রতিচ্ছবির বিপরীতে, যার মুখের দিকে চেয়ে থাকা যাবে অনেকক্ষণ ধরে। বাংলাদেশ, বাঙালি জাতি, কর্ণাটকে জন্ম নিয়েও বাংলা ভাষা জানা, হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা, নিম্ন আয়ের সাধারণ মানুষের জন্য তার নিবেদিত কর্মসূচি, আমার বন্ধুর টেস্ট রিপোর্ট ইত্যাদি বিষয়ে অল্প সময় নিয়ে হলেও কথা বলি। স্বদেশে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব হিসেবে কাজ করেছি শুনে তার বিশেষ ভিজিটিং কার্ডের গায়ে লিখে দিলেন একটা বিশেষ ফোন নম্বর। বললেন, ‘গণমানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে তোমার দেশে কিছু করতে চাইলে আইডিয়া দিতে পারো, আমি শুনব।’ আমি কার্ডটি সযত্নে সংরক্ষণ করি এবং বিদায় নিই। ভাবছিলাম, তার সময় মানে মৃত্যুপথযাত্রী রোগীর সময়। তা নষ্ট করার অধিকার আমার কেন, কারো নেই।

দুই দিন ধরে নারায়ণা হৃদয়ালয় এলাকায় ঘোরাঘুরি করছি। ২৬টি পৃথক সেন্টার নিয়ে গঠিত এটা একটি হেলথ সিটি। বোমাসেন্দ্র শিল্প এলাকা (Bommasandra Industrial Area), হসুর রোড, বেঙ্গালুরুর। এখানে কেবল এই চেইন হসপিটালকে কেন্দ্র করে চারদিকে প্রচুর হোটেল রেস্তোরাঁ, আবাসিক ভবন, রাস্তাঘাট, ট্র্যাভেল এজেন্সির ছড়াছড়ি। সবকিছু বহিরাগত রোগীবান্ধব করে নির্মাণ করা হয়েছে। একই কমপ্লেক্সের অভ্যন্তরে নির্মিত হয়েছে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, গুরুদুয়ারাসহ নানা ধর্মীয় উপাসনালয়। যে যার মতো সৃষ্টিকর্তার কাছে নিজেকে সমর্পণ করে চলেছেন। কোথাও কোনো সাংঘর্ষিক পরিবেশ বা বক্তব্যের লেশমাত্র নেই। নিরাপদে মানুষ আসছে, সেবা নিচ্ছে, ফিরে যাচ্ছে। তবে দৃশ্যমান নয়, এর প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড, চলছে আড়ালে-অন্তরালে। অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের নিমিত্ত সার্বক্ষণিক বাস, মিনিবাস, ট্যাক্সি সার্ভিস চালু রয়েছে। হাসপাতাল বিষয়ে গাইড করার মতো সহযোগী হাত বাড়ালেই পাওয়া যাচ্ছে। মনে হয় যতই দিন যাচ্ছে নারায়াণা হাসপাতাল আর বেঙ্গালুরুর সমার্থক শব্দে পরিণত হচ্ছে।

পদ্মভূষণ, পদ্মশ্রী ও কর্ণাটকরত্ন উপাধি পাওয়া ডা. শেঠি একজন অপরাজেয় ব্যক্তিত্ব। ভারতের মাটির সঙ্গে মিশে আছে তার জীবনাচার। ভারতবর্ষের সাধারণ শ্রেণির কাছে তিনি দেবী নন, দেবতা। প্রায় বিনা মূল্যে গরিব হূদেরাগীর চিকিৎসা করার আলাদিনের প্রদীপ হাতে তিনি সর্বদা জাগ্রত রয়েছেন। শুনেছি তার যোগ্য পরম্পরা পুত্র বরুণ শেঠির হাতেও অসংখ্য সফল অপারেশন সম্পন্ন হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘পৃথিবীটা আসলে ব্যাকবেঞ্চারদের দখলে। পরিশ্রমী হওয়া এবং স্বপ্ন দেখতে জানলে মানুষ একদিন বড় হবেই। সাধনা কখনো বৃথা যায় না। ইউরোপ-আমেরিকার দিকে তাকিয়ে থাকলে কিছু হবে না। নিজের দেশে থেকেই ওদের মতো করে স্বপ্ন দেখতে হবে এবং বদলে দিতে অপারগতার বদ্ধমূল ধারণা। যুগে যুগে যারা পৃথিবীকে বদলে দিয়েছেন, তারা সবাই সর্বোচ্চ মেধাবী ছিলেন না, ছিলেন মধ্যম পর্যায়ের। কাজেই আত্মপ্রত্যয় হারানো যাবে না, সাহসী ও স্বপ্নবান হতে হবে।’ স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘জীবে দয়া করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।’ দেবী শেঠি এভাবেই সেবা করছেন ঈশ্বরের। জয়তু দেবীপ্রসাদ শেঠি। তোমার তুলনা শুধু তুমি।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও গল্পকার

ইত্তেফাক/ইআ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন