বছরের শেষ দিকে যখন প্রকাশকেরা বইমেলার প্রস্তুতি নেবেন, অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও করপোরেট প্রতিষ্ঠান ডায়েরি ও ক্যালেন্ডার তৈরি করবে, স্কুলগুলোতে নতুন বছরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বই বিতরণের উদ্দেশ্যে বই মুদ্রণ করবে—এমন এক মুহূর্তে কাগজের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধিতে বাজারে যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে, তা প্রকাশনা শিল্প তথা মুদ্রিত সংবাদপত্রগুলোকে এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, যা দুঃখজনক।
বর্তমানে এই কাগজের দাম বাড়তে থাকায় তৈরি পণ্যে গত এক সপ্তাহে ৩০ শতাংশের মতো দাম বাড়ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কারখানায় উত্পাদন ব্যাহত হওয়ায় বাজারে সরবরাহে টান পড়েছে। আর এই সুযোগে হু-হু করে বাড়ছে খোলা ও পাইকারি বাজারে কাগজের দাম। তবে সব ধরনের কাগজের দাম একই হারে বাড়েনি। কাগজের নানা পদের মধ্যে টনপ্রতি সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা বেড়েছে লেজার কাগজের দাম।
তথ্যমতে, গত এক সপ্তাহে পাইকারি বাজারে কাগজের দাম প্রতিদিনই বেড়েছে। হোয়াইট প্রিন্ট কাগজের দাম সপ্তাহের ব্যবধানে টনপ্রতি ২৫ হাজার টাকা বেড়ে দাম দাঁড়ায় ১ লাখ ৩৫ হাজার থেকে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকায়। প্রতি টন হোয়াইট নিউজপ্রিন্ট কাগজের দাম বেড়েছে ১৫ হাজার টাকা। এই কাগজের দাম ২০ হাজার থেকে বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে প্রতি টন ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকায়। মূলত গত এক সপ্তাহে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে লেজার কাগজের দাম। প্রতি টনের দাম ৩০ হাজার টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা। প্রতি টন নিউজপ্রিন্ট কাগজের দাম ৬৪ হাজার থেকে বেড়ে ৮৫ হাজার টাকা হয়েছে। কম দামি এই কাগজের দাম গত দুই সপ্তাহে বেড়েছে ৩৩ শতাংশ।
ব্যবসায়ীরা অনেকেই বলছেন, মিল থেকে কাগজ মিলছে কম। এদিকে হুট করে দামটা বেশি বেড়ে যাওয়ায় ক্রেতাদের কাছেও তাদের জবাবদিহি করতে হচ্ছে। ফলে তারা কাগজ কিনছেন কম, যার কারণে তাদের বেচাকেনাও অর্ধেকে নেমে এসেছে। এহেন পরিস্থিতির জন্য অনেকেই জ্বালানির সংকটকে দায়ী করছেন। বর্তমানে দেশে জ্বালানিসংকটের কারণে যে গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে, তা দিয়ে রেশনিং করে নিত্যপণ্যের মিলগুলো চালুতে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। এতে করে অন্য মিলে উত্পাদন ব্যাহত হচ্ছে। এর বিশেষ প্রভাব পড়ছে কাগজের মিলগুলোতে। ফলে উত্পাদন কম হওয়ায় কাগজের সংকট তৈরি হয়েছে, এ কারণে মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে।
দৃশ্যমান পাইকারি বাজারে শুধু যে কাগজের দাম বেড়েছে তা নয়। বেড়েছে মলাট কাগজের দামও। তথ্যমতে, গত এক সপ্তাহে প্রতি ১০০টি মলাট কাগজের দাম ১ হাজার ৮০০ টাকা থেকে বেড়ে ২ হাজার ৬০০ টাকা হয়েছে। একই পরিমাণ আর্টকার্ডের দামও এখন ৫০০ টাকা পর্যন্ত বাড়তি। ১০০টি আর্টকার্ড মিলছে ৩ হাজার ৫০০ টাকায়। এক রিম রঙিন কাগজের দাম ৮৫০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা বেড়ে পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার টাকায়। পাইকারি বাজারে কলম তৈরির প্লাস্টিকের প্রতি ২৫ কেজি বস্তার দাম ৩ হাজার ৮০০ টাকা থেকে বেড়ে ৪ হাজার ৪০০ টাকা হয়েছে। কাগজসংশ্লিষ্ট অন্যান্য উপকরণের দামও বাড়তি। পাইকারিতে এক সপ্তাহ আগে ১২০ পৃষ্ঠার এক ডজন খাতা বিক্রি হয়েছিল ৩১০ থেকে ৩২০ টাকায়। এখন তা ৪০০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। বাজারে এই কাগজের মূল বৃদ্ধি পাওয়ায় ডায়েরি, নোটবুক, বিভিন্ন ফাইলপত্র, লেজার খাতা, বক্স ফাইল, খাতার মতো কাগজের উপকরণের দাম গত এক সপ্তাহে নতুন করে ৩০ শতাংশের মতো বেড়েছে। মাঝারি আকারের ১০০টি খাকি খামের দাম ২৫ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৩০ টাকা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজার স্বাভাবিক থাকলে এই সময়ে কাজের অভাব হয় না। কিন্তু কাগজের দাম বাড়তে থাকায় কাজ কমতে শুরু করেছে। অনেক গ্রাহক ইতিমধ্যে ইমেইল ও মুঠোফোনে জানিয়েছেন, নতুন করে কাগজের দাম সমন্বয় ছাড়া তারা মুদ্রণকাজ বন্ধ রাখতে বলছেন, যা দেশের মুদ্রণশিল্পের জন্য অশনিসংকেত। দ্রুত এই অবস্থার অবসান হওয়া জরুরি বলে মনে করেন তারা।
অন্যদিকে কাগজের এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে ভয়াবহ সংকটে পড়েছে দেশের সংবাদপত্র। ইতিমধ্যে অনেক সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে গেছে, অনেক সংবাদপত্র মুদ্রণসংখ্যা কমিয়ে দিয়েছে। কারণ আকস্মিকভাবেই মাত্রাতিরিক্ত দাম বেড়েছে কাগজের। এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে অনেক সংবাদপত্রই বন্ধের উপক্রম হবে। পাশাপাশি এই পেশায় সংশ্লিষ্ট অনেকেই চাকরি হারাবেন, যা কাম্য নয়। কেননা, প্রতি টন কাগজের দাম বেড়েছে ৩৫ হাজার টাকা। শিক্ষার্থীদের খাতা হিসেবে যেমন কাগজের ব্যবহার রয়েছে, তেমনি আবার বই ও সংবাদপত্র ছাপতেও প্রয়োজন কাগজের। কিন্তু এসবের অন্যতম এই উপকরণের দাম বাড়ছে লাগামহীনভাবে। মাত্র পাঁচ মাসেই পাইকারিতে প্রতি টনে দাম বেড়েছে ৩৫ থেকে ৩৭ হাজার টাকা। এতে বিপাকে পড়েছেন সংবাদপত্রের মালিক, শিক্ষার্থী ও প্রকাশনা শিল্পসংশ্লিষ্টরা।
তথ্যমতে, বাংলাদেশে মোট ২০৬টি পেপার মিল রয়েছে। এর মধ্যে চলমান ৭০ থেকে ৭৫টি। বাকি মিল নানা সংকটের কারণে এখন আর উত্পাদনে নেই। দুই দশক আগে সরকারি প্রতিষ্ঠান খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলস বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বেসরকারি খাতের মিলমালিকেরা একচেটিয়া বাণিজ্য করার সুযোগ নিচ্ছেন। নানা অজুহাত দাঁড় করিয়ে সপ্তায় সপ্তায় বাড়ানো হচ্ছে কাগজের দাম। অন্যদিকে এতে দৃষ্টি দেওয়ারও কেউ নেই। ফলে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে সংবাদপত্র ও প্রকাশনাশিল্পের ভবিষ্যত্। কাগজের সংকটের কারণ হিসেবে জানা গেছে, দেশীয় শিল্প বিকাশে দেশের বাইরে থেকে সরাসরি প্রিন্টিং হোয়াইট পেপার ও নিউজপ্রিন্ট আমদানির তেমন সুযোগ নেই। তবে কাগজ তৈরির প্রধান উপকরণ পাল্প আমদানি করতে হয়। ডলার-সংকটের কারণে পাল্প আমদানির জন্য ব্যাংকগুলোতে এলসি খুলতে পারছেন না আমদানিকারকেরা। এ ছাড়া গ্যাস ও বিদ্যুত্-সংকটের কারণে যেসব মিলের প্রতিদিন ৫০০ টন কাগজ উত্পাদনের সক্ষমতা রয়েছে, সেগুলো এখন ৭০ থেকে ৮০ টনের বেশি উত্পাদন করতে পারছে না।
মুদ্রণ ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত কয়েক মাসে কাগজের দাম অনেক বেড়েছে। প্রতি সপ্তাহে দাম বাড়ে। যে খাতা ৪০ থেকে ৪৫ টাকায় কেনা যেত, তা এখন ৬৫ থেকে ৭০ টাকা। ২৮০ টাকার রিম এখন প্রায় ৪০০ টাকা। রাজধানীর চকবাজারের পুস্তক প্রকাশক মিয়া রিয়াজুল ইসলাম বলেন, ‘কাগজের দাম টনপ্রতি বেড়েছে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। আগে কাগজের দাম ছিল ৯৫ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা। নিউজপ্রিন্ট কিনতে হচ্ছে ৭০ থেকে ৭৫ হাজার টাকায়; যা কয়েক মাস আগেও কিনেছি ৫০ থেকে ৫৫ হাজার টাকায়।’ তবে বর্তমান সরকারের প্রশংসনীয় উদ্যোগগুলোর মধ্যে একটি হলো বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের হাতে বিনা মূল্যে বই তুলে দেওয়া। কাগজের বাজারে অস্থিরতার কারণে সেটিও অনেকটা শঙ্কার মুখে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে দেরিতে কাজ পাওয়া, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে কাগজের দাম বেড়ে যাওয়া এবং বিদ্যুত্-বিভ্রাটসহ নানা চ্যালেঞ্জের কথা বলছেন মুদ্রণ ব্যবসায়ীরা। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) থেকে জানা গেছে, আগামী শিক্ষাবর্ষের জন্য এবার ৩৪ কোটি ৬১ লাখ ৬৩ হাজার কপি পাঠ্যবই ছাপার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক থেকে প্রাথমিক স্তরের ৯ কোটি ৯৮ লাখ ৫৩ হাজার কপি এবং মাধ্যমিক স্তরের জন্য ২৪ কোটি ৬৩ লাখ ১০ হাজার কপি পাঠ্যবই ছাপানো হবে।
মুদ্রাকরেরা জানিয়েছেন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের চার রঙের বই ছাপা হয় ৮০ জিএসএম কাগজে। আর মাধ্যমিকের এক রঙের বই ছাপানো হয় ৬০ জিএসএম কাগজে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবইয়ের টেন্ডার প্রক্রিয়া যখন চলছিল, তখন বাজারে এই মানের কাগজের দর ছিল প্রতি টনে ৫০ হাজার টাকা। এখন দাম বেড়েছে প্রায় দেড় থেকে দুই গুণ। দাম বাড়ার কারণে বেঁকে বসেছেন মুদ্রণ ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, বাজারে চলমান দাম অনুযায়ী তাদের টাকা দিতে হবে, তা না হলে তারা বই ছাপাতে পারবেন না।
মুদ্রণশিল্প সমিতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশে এখন যে পরিমাণ কাগজ আছে, তাতে সর্বোচ্চ ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পাঠ্যবই ছাপানো সম্ভব হবে। পাঠ্যবইয়ের কাগজ উত্পাদন করে তিনটি পেপার মিল। তাদের কাছে সর্বোচ্চ ৪০ হাজার টন কাগজ উত্পাদনের পাল্প আছে। ৩৫ কোটি বই ছাপাতে লাগবে ১ লাখ টনেরও বেশি কাগজ। এই সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায় হচ্ছে জাতীয় স্বার্থে বিদেশ থেকে কাগজ বা ভার্জিন পাল্প শুল্কমুক্ত আমদানির অনুমতি দেওয়া।
অন্যদিকে ফেব্রুয়ারির একুশে বইমেলা সামনে রেখে উদ্বেগ বাড়ছে প্রকাশকদের মধ্যে। এ অবস্থায় কাগজের আমদানি, দেশীয় উত্পাদন ও সঠিক সরবরাহ ব্যবস্থাপনা এবং এই খাত নিয়ে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য বন্ধে সরকারের সংশ্লিষ্টদের নজরদারি বাড়াতে হবে।
লেখক: কলামিস্ট ও সাবেক,
জনসংযোগ কর্মকর্তা, বিইউএফটি।