বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

জলবায়ুসংকট মোকাবিলায় বেসরকারি অর্থায়ন

আপডেট : ২৮ নভেম্বর ২০২২, ০০:৪০

মিশরের শার্ম আল-শেখে জাতিসংঘ আয়োজিত এবারের জলবায়ুবিষয়ক শীর্ষ সম্মেলনে (কপ-২৭) জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সংকটাপন্ন দেশগুলোর জন্য ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ তহবিল গঠনে চুক্তি করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট দুর্যোগের ঝুঁকিতে থাকা বিপর্যস্ত ও দরিদ্র দেশগুলো দীর্ঘদিন ধরেই সহায়তা ও ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়ে আসছিল। অবশেষে কপ-২৭ সম্মেলনে আলোর মুখ দেখল ‘জলবায়ু তহবিল’। বিরূপ জলবায়ুর শিকারে পরিণত হওয়া বিধ্বস্ত উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষয়ক্ষতি পূরণ করতে তহবিল গঠনের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। তবে এ ঘটনা অতীতের একটি স্মৃতিকে সামনে আনছে। ২০০৯ সালের কোপেনহেগেন জলবায়ু সম্মেলনে উন্নত বিশ্বের দেশগুলো একমত হয়ে বলেছিল, জলবায়ুসংকটের প্রভাব মোকাবিলায় সাহায্য করতে দরিদ্র দেশগুলোকে ১০০ বিলিয়ন পাউন্ড প্রদান করা হবে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হয়নি। দেশগুলো তা ভুলে গেছে অবলীলায়!

এখন প্রশ্ন হলো, জলবায়ু পরিবর্তনের কবলে পড়া দরিদ্র দেশগুলোকে সাহায্য করার জন্য এবারের কপ সম্মেলনে যে অঙ্গীকার করা হলো, তা কি সত্যিই পূরণ করা হবে? নাকি প্রতিশ্রুতিগুলো খাতা-কলমেই থেকে যাবে? মনে রাখতে হবে, ১০০ বিলিয়ন পাউন্ডের জলবায়ু তহবিল গঠনে যে চুক্তি করা হলো, তার যথাযথ বাস্তবায়ন না ঘটলে তা হবে বিশ্বাসঘাতকতার শামিল। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় আগামী বছর কপ-২৮ সম্মেলনে খালি হাতেই দাঁড়াতে হবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর সামনে, যা হবে নতুন প্রহসন। 

সত্যিকার অর্থে, গত দশক ছিল প্রতিশ্রুতি প্রদান ও ভঙ্গের ইতিহাসে পূর্ণ। কোভিড মহামারির আগে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে ব্যয় ধরা হয় বছরে ২ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। কোভিড-পরবর্তী সময়ে প্রতিকূলতা বেড়েছে। সব দিক দিয়ে অবস্থা দিনে দিনে খারাপ হয়ে উঠছে। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, দাবানল, খরার মতো দুর্যোগগুলো অতিমাত্রায় বেড়েছে। স্বভাবতই এসবের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার খরচও বেড়েছে। উপরন্তু, নিম্ন আয়ের দেশগুলোর ওপর রয়েছে বিপুল ঋণের বোঝা। সব মিলিয়ে এসডিজি অর্জনে এখন বার্ষিক ব্যয় বাড়বে, যা বার্ষিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলার। 

উল্লেখ করার মতো বিষয়, গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনের প্রভাব ঠেকাতে ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতি বছর প্রায় ২ ট্রিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোর। এজন্য বৈশ্বিক কর বৃদ্ধির মাধ্যমে হলেও এই অর্থ জোগাড় করে দেশগুলোকে সাহায্য করতে হবে। বিশেষজ্ঞ অভিমত হলো, অবিলম্বে ধনী দেশগুলো থেকে দরিদ্র দেশগুলোতে অর্থায়ন সচল করতে হবে। ধনী দেশগুলোর উচিত হবে দরিদ্র দেশগুলোতে ‘সবুজ প্রকল্প’ ছড়িয়ে দিতে অর্থের সংস্থান করা।

বাস্তবতা হলো, জনসাধারণের তহবিল যথেষ্ট হবে না কখনোই। বিভিন্ন দেশ থেকে যে পরিমাণ তহবিল পাওয়া যাবে, তা পরিস্থিতির উত্তরণে আশানুরূপ কাজে আসবে না। কারণ আমরা জানি, জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকানোর মতো আরো বেশ কিছু তহবিলের অর্থসংস্থানে পাউন্ড, ডলার ও ইউরো খরচ হয়ে যাচ্ছে। তাই এই মুহূর্তে অত্যাবশ্যক বিষয় হলো ভিন্ন উৎসর সন্ধান করা। এই অবস্থায় দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে আইএমএফ ও ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকগুলোর ২০১৫ সালের একটি সমীক্ষার দিকে। আইএমএফ ও ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকগুলো মনে করে, জলবায়ু তহবিল গঠনে ব্যাপকভাবে সহায়তা করতে পারে ‘প্রাইভেট ফাইন্যান্স’। তাই বেসরকারি অর্থায়নের দিকে ঝুঁকতে হবে। 

বেসরকারি খাতকে সচল করতে হবে। জলবায়ুর পরিবর্তন ও উন্নয়নে বিনিয়োগে আগ্রহী করে তুলতে সরকারগুলোর উচিত হবে বেসরকারি অর্থায়নকে উত্সাহিত করা। এজন্য সঠিক প্রণোদনা দেওয়ার বিষয়েও সরকারগুলোকে চিন্তা করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে ব্যাংক, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ও তহবিল ব্যবস্থাপকদের কাছে থাকা আর্থিক সম্পত্তি থেকে আমরা যদি বছরে মাত্র ১ শতাংশ হারেও সংগ্রহ করতে পারি, সেটাই হবে প্রত্যাশার বেশি! এমনকি এর ফলে এসডিজি তহবিলের চাহিদা পূরণ করাও সম্ভব হবে। এ কথা সত্য, বেসরকারি বিনিয়োগের বিষয়ে কোটি কোটি প্রতিশ্রুতি শোনা যায়। কিন্তু সত্ উদ্দেশ্য নিয়ে দায়িত্বশীল তৎপরতা চোখে পড়ে না খুব একটা। সত্যিকার অর্থেই বহু বেসরকারি বিনিয়োগচিন্তা শুধু চিন্তাতেই সীমাবদ্ধ। 

সত্যি বলতে, এসব চিন্তার সফল বাস্তবায়নের জন্য চাই লম্বা সময়। কিন্তু আমাদের হাতে কি এতটা সময় আছে?  জলবায়ু অর্থায়ন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে বহু আগেই। আমরা অনেক দেরি করে ফেলেছি। অর্থাৎ, আরো দেরি করা মানে আরো বিপদ ডেকে আনা। এ কারণে বিশ্বব্যাংককে জরুরি ভিত্তিতে একটি ‘গ্লোবাল পাবলিক গুডস ব্যাংক’ হিসেবে রূপান্তর করতে হবে। ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন (আইডিএ) নিম্ন আয়ের দেশগুলোর জন্য সব সময়ই নিবেদিতপ্রাণ। এই সংস্থার হাত ধরে বহু ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। ১০০ বিলিয়ন ডলারের তহবিল গঠনে আইডিএ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। একইভাবে এগিয়ে আসতে পারে আরো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সংগঠন ও সংস্থা।

এক্ষেত্রে কাজ করার আছে ধনী দেশগুলোর আঞ্চলিক উন্নয়ন ব্যাংকগুলোরও। এসব ব্যাংকের উদ্ভাবনী গ্যারান্টি কাজে লাগিয়ে আরো বেশি তহবিল তৈরি করা যেতে পারে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) ইতিমধ্যে ইউরোপীয় সরকারগুলোর ওপর গ্যারান্টির শর্ত জুড়ে দিয়ে সুরক্ষিত জলবায়ু প্রকল্পগুলোতে অর্থায়ন করার পরিকল্পনা করেছে। এভাবে যদি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও কাজ শুরু করে, তবে তা সামগ্রিকভাবে আমাদের কাজ সহজ করে দেবে। এর ফলে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিবছর বিলিয়ন নয়, বরং ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে পারে। একই সঙ্গে বিশ্বের ধনী দেশগুলো যদি অর্থ প্রদানের ক্ষমতার ভিত্তিতে ন্যায্যভাবে দায়িত্ব ভাগ করে নিতে সম্মত হয়, তবে টেকসই তহবিল গড়ে উঠতে সময় লাগবে না। অতিদ্রুত কাঙ্ক্ষিত তহবিল এমনকি অতিরিক্ত তহবিল গড়ে তোলা যায় এমন নিশ্চয়তাও দেওয়া যেতে পারে। ভুলে গেলে চলবে না, এটি একটি প্রমাণিত মডেল, যার সুফল আমরা অতীতে পেয়েছি। ১৯৬৬ সালে গুটিবসন্ত নির্মূল করতে এই মডেল ব্যবহার করা হয়েছিল।

বর্তমানে জাতিসংঘের অর্থায়নের ৭ বিলিয়ন ডলার ব্যবহৃত হয় শান্তি রক্ষার জন্য। দুঃখজনকভাবে মাত্র ১ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হয় স্বাস্থ্য অর্থায়নে। এই যখন অবস্থা, তখন সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এমন একটি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, যাতে ভুক্তভোগী দেশগুলোকে সত্যিকার অর্থেই সাহায্য করা যায়। এজন্য ধনী দেশগুলোকে এক কাতারে দাঁড়িয়ে দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নিতে হবে। এভাবে যদি একটি কাঙ্ক্ষিত ফান্ড গড়ে তোলা যায়, তবে আগামী দিনগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় তা হবে সব থেকে বড় শক্তি। অস্তিত্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দরিদ্র দেশগুলোকে আর বিশ্ব দাতব্যের ওপর নির্ভর করতে হবে না। এ অবস্থায় কাজ শুরু করতে হবে এখন থেকেই, যাতে সামনের কপ-২৮ সম্মেলনে একটি মানসম্মত কর্মপরিকল্পনা হাজির করা যায়। এক্ষেত্রে সক্ষমতা অনুযায়ী এগিয়ে আসতে হবে দাতাদের। গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনের জন্য ঐতিহাসিকভাবে যেসব দেশ বেশি পরিমাণে দায়ী, দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে এগিয়ে আসতে হবে তাদের। বস্তুত, জলবায়ু সম্মেলনের পরবর্তী রাউন্ডের সূচনা হওয়া উচিত এসবের ভিত্তিতেই। সহজভাবে বললে, জলবায়ু পরিবর্তন রুখতে সর্বাগ্রে জরুরি পর্যাপ্ত অর্থায়ন। কোনো সন্দেহ নেই, লক্ষ্য অর্জনে সফল হলে তা হবে সত্যিই আনন্দের বিষয়। এর ফলে জলবায়ু পরির্বতনের প্রভাবের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক লড়াই সহজতর হবে। মনে রাখতে হবে, আমরা উপায় জানি এবং যথেষ্ট জ্ঞানও আছে আমাদের। এখন শুধু দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সম্মিলিত প্রচেষ্টা। 

লেখক :যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অর্থায়নসংক্রন্ত অ্যাম্বাসেডর
দ্য গার্ডিয়ান থেকে অনুবাদ : সুমৃৎ খান সুজন 

 

ইত্তেফাক/ইআ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন